Advertisement
Advertisement

Breaking News

Kunal Ghosh

পথ-চাওয়াতেই আনন্দ

তখন তাঁর বন্দিজীবন। প্রেসিডেন্সি জেলের পয়লা বাইশ সেল ওয়ার্ডের ২১ নম্বর সেলে।

Revisit the past, Kunal Ghosh turns nostalgic about these 8 characters | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:May 22, 2023 5:00 pm
  • Updated:May 22, 2023 6:04 pm  

জীবনপথের যাত্রাটি ভারি বিচিত্র। কখনও সাদা-কালো, কখনও রঙিন, বর্ণময়। কখনও মসৃণ, কখনও নাগরদোলার চাকার মতো, উপর-নিচ। এই যাত্রাপথেই কত মুখের সঙ্গে দেখা। অনেকে হারিয়ে যায়, কিছু মুখ সঙ্গে চলতে থাকে, কিছু মুখ মনে থেকে যায়। এই মনে থেকে যাওয়া মুখগুলির মধ্যে আটটি মুখ আজকের কলমে, আপনাদের সঙ্গে আলাপ করানোর জন্য। কলমে কুণাল ঘোষ

 

Advertisement

রাজীবের পিছনেই
দৃশ্যটা মনে আছে? শ্রীলঙ্কা সফরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। ‘গার্ড অফ অনার’ চলছে। রাজীব অভিবাদন নিতে নিতে হাঁটছেন। হঠাৎ শ্রীলঙ্কার এক সেনা বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে গেল রাজীবকে। তখন দুটো ঘটনা ঘটল। এক) বাঁ-চোখের কোণ দিয়ে কিছু দেখে তৎপর রিফ্লেক্সে মাথা নিচু করলেন রাজীব। আর দুই) রাজীবের ঠিক পিছনে হাঁটা দুই ব্ল্যাক ক্যাট দেহরক্ষীর একজন বাধা দিলেন সেনাকে, ধরেও ফেললেন। এই ব্ল্যাক ক্যাটটি হলেন অসিত শীল, বাঙালি অফিসার, কলকাতা পুলিশের কর্মী, ডেপুটেশনে যাওয়া। আজকের মতো গাদাগুচ্ছের মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ হলে তাঁকে নিয়ে যে বিস্তর মাতামাতি চলত- তখন তেমন কিছু হয়নি। অথচ সেটা ওঁর প্রাপ্য ছিল।

প্রথম বাঙালি ‘ব্ল্যাক ক্যাট’। এখন কথায় কথায় যে ‘কমান্ডো’ শব্দ শোনা যায়, তাদের আদিপুরুষ। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর যখন রাজীব প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন সারা দেশের পুলিশ থেকে বাছাই অফিসার নিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই ব্ল্যাক ক্যাট বাহিনী তৈরি হয়। অসিতদা তাঁদেরই একজন ছিলেন, এবং তাঁদের মধ্যেও একেবারে রাজীবের ‘ছায়াসঙ্গী’। ডেপুটেশন পর্ব শেষের পর তিনি আবার ফেরেন কলকাতা পুলিশে। একাধিক থানার দায়িত্বে ছিলেন।

রাজীব হত্যার পর আমরা ‌‘কলকাতা’ কাগজের হয়ে একটি বিশেষ বই করেছিলাম, তাতে অসিতদার স্মৃতিচারণ ছিল। ক্রমশ আলাপ জমজমাট। রাজীব গান্ধীকে অত কাছ থেকে দেখা মানুষ, গল্প শুনতাম। অসিতদা বলতেন, ‘উনি ছিলেন একদম বড়দার মতো। আমাদের খবর নিতেন। ডিউটির ঝামেলায় খাওয়া হল কি না, খোঁজ নিতেন।’ সপরিবার রাজীবকে দেখেছেন অসিতদা। কর্মজীবনের সেসব দিন মিস করেন। আর শ্রীলঙ্কা সফরের ওই বিশেষ দিনটা তো তাঁর কাছে চিরস্মরণীয়। প্রথমে আক্রমণকারীকে আটকানো, তারপর রাজীবকে ঘিরে সরানো, তখনও তাঁরা জানেন না- আরও সেনা আক্রমণে তৈরি কি না। সব মিটলে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ শীল।’ বুক ভরে গিয়েছিল অসিতদার। রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর ভেঙে পড়েছিলেন খুব।

অনেক পরে, সোনিয়াজি আসেন একবার কলকাতা সফরে। সাধন পাণ্ডেকে বলেছিলাম অসিতদার কথা। সাধনদা বলেছিলেন, ‘ম্যাডামকে বলি। চিনতে তো পারবেনই। তাহলে ওঁকে নিয়ে যাব।’ তারপর সকালে রাজভবনের ঘরে সাধনদা নিয়ে গেলেন অসিতদাকে। আমিও গেলাম। সোনিয়া প্রথমেই বললেন, ‘শীল, হাউ আর ইউ?’ অপূর্ব এক সৌজন্য সাক্ষাৎ। আমার একটা সুন্দর ‘খবর’ হয়ে গেল।

অসিতদাকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘আচ্ছা, এই যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেশ-বিদেশ ঘোরা ব্ল্যাক ক্যাট, আর তারপর সটান কলকাতা পুলিশের থানা- কাজে মন দেন কী করে? মানাতে অসুবিধে হয় না?’ দীর্ঘদেহী ইস্পাতকঠিন চেহারার মানুষটা হাসিমুখে বলতেন, ‘ডিউটি ইজ ডিউটি। যখন যেটা করি, নিজের সেরাটা দিই।’

আরও পরের ঘটনা। রাজ্য বিধানসভায় দীর্ঘদিনের ‘মার্শাল’ জয়ন্ত মজুমদার অবসর নিচ্ছেন। নতুন মার্শাল নিয়োগ হবে। স্পিকার হাসিম আবদুল হালিমকে বললাম অসিতদার কথা। প্রথম বাঙালি ব্ল্যাক ক্যাট, ওই উচ্চতায় কাজ করেছেন, তাঁকে এই সম্মানজনক পদে আনা যায় কি না। অসিতদা আমাকে বলেননি। আমার নিজস্ব প্রস্তাব। হালিম সাহেবের বিষয়টা পছন্দ হল। আসতে বললেন অসিতদাকে। তিনি সম্ভবত তখন বড়তলা থানার উপরের কোয়ার্টারে থাকতেন। এসেছিলেন বিধানসভায়। হালিম সাহেব অনেকক্ষণ গল্প করলেন। কথা হল। কিন্তু চাকরি, প্রোমোশন, বেতন-সংক্রান্ত টেকনিক‌্যাল সমস্যায় ‘মার্শাল’ পদে আর আসেননি অসিত শীল। কলকাতা পুলিশে পরে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হন। তারপর অবসর।

এখন যখন নানা টিভিতে বহু প্রাক্তন পুলিশকর্তার ব্যাখ্যা-ট্যাখ্যা শুনি, মাঝেমধ্যেই মনে হয় অসিত শীলের কথা। এক আদর্শ সেলিব্রিটি অফিসার। অথচ তিনি থেকে গেলেন নীরবে, প্রচারের আলোর বাইরে।

প্রথম অগ্নিকন্যা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামের আগে ‘অগ্নিকন্যা’ বিশেষণটি বহুল পরিচিত এবং বহু ব্যবহৃত। এই শব্দটি কে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন, তা নিয়ে সময়ে সময়ে নানা জল্পনাও হয়েছে। একাধিক হেভিওয়েট নেতা, এক বিশিষ্ট কবি, একাধিক সাংবাদিকের নাম এসেছে। কিন্তু বাস্তব হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘অগ্নিকন্যা’ সম্বোধন করেছিলেন এক বর্ষীয়ান বামপন্থী চিকিৎসক, কলকাতা পুরসভায় কাউন্সিলরও ছিলেন। তাঁর নাম ডা. কে. পি. ঘোষ- কৃষ্ণপদ ঘোষ। ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের বামফ্রন্ট সমর্থিত নির্দল কাউন্সিলর ছিলেন তিনি। নিপাট ভদ্রলোক, জনপ্রিয় চিকিৎসক, গরিবের ভগবান ছিলেন তিনি। এবং তখনই, সিপিএমের বহু নীতির সঙ্গে তিনি একমত হতেন না। আলাদা কথা বলতেন। আজকের যুগ হলে সরকারপন্থী কাউন্সিলরের বেসুরো কণ্ঠ রোজ ‘ব্রেকিং নিউজ’ হত। মমতাদি যখন রবীন্দ্র সরোবর একটি বেসরকারি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার সরকারি উদ্যোগের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনে নামেন, তাতে খোলাখুলিভাবে যোগ দিয়েছিলেন
ডা. ঘোষ। তখনই এক সভায় তিনি ‌‘অগ্নিকন্যা’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। সেই থেকে এই বিশেষণটি চালু হয়ে যায়।

ডা. ঘোষ পরে সক্রিয় রাজনীতি করেননি, বামপন্থী শিবির থেকে দলবদলও করেননি; ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। বলা বাহুল্য, সিপিএমও আর সমর্থন দিয়ে প্রার্থী করেনি। তাৎপর্যপূর্ণ হল, তখন ডা. ঘোষ ওই এলাকায় কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হতে পারতেন। তাঁর নিজের জনপ্রিয়তা ছিল দারুণ, আর ওটা সোমেন মিত্রর হোম ওয়ার্ড। ডা. ঘোষ ওসব করেননি। চেম্বারেই সময় দিতেন। আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। আমি যেতাম ওঁর কাছে। আমার কোনও অরাজনৈতিক কর্মসূচি থাকলে তিনি আসতেন। সিপিএমের বহিষ্কৃত প্রবাদপ্রতিম নেতা নৃপেন চক্রবর্তীকে নিয়ে আমার ‘বহিষ্কৃত বিদ্রোহী’ বইটি প্রকাশেও তিনি অন্যতম অতিথি। ভাষণ ছিল একদম শিক্ষকের মতো।

ডা. ঘোষ হয়তো রাজনৈতিক নেতা হিসাবে কখনওই তথাকথিত প্রথম সারির ছিলেন না, হওয়ার চেষ্টাও করেননি; কিন্তু মানুষ হিসাবে এতটাই খাঁটি এবং সুউচ্চ অবস্থানের, চিরদিন মনে থেকে যাবেন। ‘জগৎ’ সিনেমা হলের সামনে দিয়ে যাতায়াত করলেই মনে হয়, ডাক্তারবাবু বোধহয় চেম্বারেই আছেন।

সন্ধের ক্লাস
আমি তখন ‘আজকাল’-এ। সালটা বোধহয় ১৯৯৩। একটি সূত্রে খবর এল, চন্দননগরে একটি স্কুলে সন্ধের পর অভিনব ঘটনা চলছে। সে-সময় শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি নিয়ে উদ্দাম বিতর্ক। তার মধ্যে ওই চন্দননগর বঙ্গ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল ঘোষ- অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন। স্কুলের পর আবার একটু টিফিনের জন্য সময় দিয়ে সন্ধ্যায় ক্লাস। টিউশনের বিকল্প। হেডস্যর নিজে ক্লাস নেন। অন্য শিক্ষকদের অনুরোধ করেন ক্লাস নিতে। বিনামূল্যে কোচিং। যে-ছাত্ররা টাকা খরচ করে অন্যত্র টিউটরের কাছে কোনও বিষয়ে মজবুত হতে যেত, তারা ফিরে এল স্কুল চত্বরে। নিয়মিত স্কুলের পর একটু বাড়ি, একটু খেলা, টিফিন, তারপর আবার স্কুলে রাত ন’টা পর্যন্ত। এবং ফলাফল ভাল। গেলাম এক বিকেলের পর সেই স্কুলে। ছুটির পর প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা। তারপর দেখি, আবার সব ছেলে হাজির, ক্লাস শুরু। শুধু ওই স্কুল নয়, খবর রটে যেতে চারপাশের স্কুল থেকেও অভাবী-মেধাবীরা হাজির এখানকার বিশেষ ক্লাসে। নাইন-টেনের উপচে পড়া ক্লাস। এমনকী, হেডস্যর শ্যামলবাবুর ছেলে ফাল্গুনী, অন্য স্কুলে পড়ে, সে-ও উপস্থিত এই সান্ধ্য ক্লাসে। শিক্ষকরা অনেক সময় দিয়ে ধরে ধরে সযত্নে যার যেটা দরকার, পড়াচ্ছেন। আমি অনেকক্ষণ ছিলাম, মুগ্ধ হয়েছি। যদিও শ্যামলবাবু কোনও ভেদাভেদ রাখেননি, তবু, বোঝা যায়, অভাবী-মেধাবীরা অতি খুশি, সত্যিই উপকৃত। শ্যামলবাবুকে ভাল লেগে গিয়েছিল।

‘আজকাল’-এ প্রথম পাতার মাথায় ছবি-সহ খবরটি বেরয়। সেসময় নানা অ্যাঙ্গেল থেকে এর ফলো আপ-ও হয়। একাধিক স্কুল ঘুরে সমীক্ষা করেছিলাম। কিছু প্রকাশিত, মূলত ইতিবাচক অংশ।

কিছু অপ্রকাশিত, মূলত নেতিবাচক। যেমন প্রথমত, সাধারণ ছাত্রছাত্রী, বিশেষত আর্থিকভাবে অসচ্ছল- তারা এবং অভিভাবকরা পছন্দ করেছিল এই মডেল। তবে যারা টাকা দিয়ে পছন্দের টিচারের কাছে টিউশনিতে যেতে পারত, তারা সন্ধেয় ফের স্কুলে আসার কথা ভাবেওনি। দ্বিতীয়ত, শ্যামলবাবুর স্কুলেরই কিছু শিক্ষক প্রধান শিক্ষকের উদ্যোগে সাড়া দেননি। যাঁদের সাবজেক্টে টিউশনির বাজার ভাল, তাঁরা অধিকাংশই তাতেই ব্যস্ত থেকেছেন। সমাজসেবা করেছেন মূলত তাঁরা, যাঁরা টিউশনির বাজারে পিছিয়ে। তবে তাতে আন্তরিকতার গুরুত্ব কমে না। তৃতীয়ত, অন্য অধিকাংশ স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা বলেছিলেন, শ্যামলবাবুর মডেল ভাল। কিন্তু তাঁদের স্কুলে তাঁরা এই মডেল চালু করতে পারবেন না। কারণ, শিক্ষকদের সাড়া মিলবে না। যাই হোক, সেই সময় শ্যামল ঘোষের মডেলটি বেশ আলোচিত হয়েছিল।

বহুকাল তারপর যোগাযোগ নেই। এতদিন পর গত বছরের বইমেলায় কবি-সাংবাদিক অগ্নি রায়ের সঙ্গে দেখা একটি স্টলের সামনে। ও এক তরুণ প্রকাশকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, ‘ও তোকে চেনে।’ প্রকাশক হাসি মুখে বলল, ‘আমি ফাল্গুনী, চন্দননগরে থাকি।’ অবাক হয়ে বললাম, ‘চন্দননগর বঙ্গ বিদ্যালয়ের শ্যামলবাবুর ছেলে?’ ফাল্গুনী বলল, ‘হ্যাঁ। আপনার সেসব লেখার কাটিং এখনও সযত্নে বাড়িতে রাখা।’ বললাম, ‘বাবা কেমন আছেন?’ উত্তরে যা বুঝলাম, একইরকম আছেন শ্যামলবাবু। একটু আগেই নাকি স্টলে এসেছিলেন। ছেলে আর সহকর্মীদের টিফিন খাইয়ে দিয়ে গিয়েছেন।

বাহুবলীর ব্যথা
নয়ের দশকের মাঝামাঝি। আমি তখন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ। একদিন সকালে সোমেন মিত্রর ফোন, ‘তুমি কখন অফিসে থাকবে? একটি ছেলেকে পাঠাব। আমার নাম করে যাবে। একটু কথা বোলো তো। যদি পারো, একটু সাহায্য কোরো।’ দুপুরবেলা সোমেনদার সেই ‘একটি ছেলে’ যখন অফিসে এল, আমার তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়!

দেখি, তিনি হলেন কংগ্রেসি জমানার বাহুবলী- গৌরীবাড়ি এলাকার একদা ত্রাস হেমেন মণ্ডল। তাকে ঘিরে অনেক ভয়ংকর ঘটনা, রটনা- দু’রকমই শুনেছি। সামনাসামনি আলাপ ছিল না। আলাপ হল। গল্প হল। হেমেন মণ্ডলের সেই আগুন তখন নেই। গায়ে গরম পিচ ঢেলে দেওয়ার মতো গল্প, বুঝতে পারলাম, অতীত। ভারি শান্ত, ফুরফুরে মেজাজে গল্প। রাজনীতি, কংগ্রেস নেতাদের কীর্তি, নকশাল আমল, এসব ধারাভাষ্য হেমেনদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শোনার আমেজই আলাদা। আর ওর নিজের কীর্তি? কিছু বলেছে, আর বাকিটা ওর মতে ‘মুখে মুখে রটা’। হেমেনদার তখনকার সমস্যা ছিল গৌরীবাড়ির মানুষ, শান্তি কমিটি ওকে এলাকায় থাকতে দেয় না। কিন্তু ওর অভিযোগ ছিল, ওর ওখানকার একটা প্রপার্টি বিক্রিতেও বাধা আসছে। যদি কাগজে ওর একটা বিবৃতি করে দেওয়া যায়, ও তো ওখানে থাকবে না। প্রপার্টি বেচে দেবে। তাহলে তাতেও বাধা কেন?

কথায় কথায় বলল, ওর ইচ্ছা ওর ছেলেদের একজন আইপিএস হোক। এরপর বললাম, ‘আজকালকার দিনের পাড়ার বাহুবলী বা মাস্তানদের সম্পর্কে তোমার মূল্যায়ন কী?’ হেমেনদা উদাস হয়ে বলল, “ধুর! আজকাল আবার মাস্তান কোথায়? কাউন্সিলর পদটা আসার পর সব ম্লান হয়ে গেছে। যে যে কারণে লোকে গুন্ডা, মাস্তানকে ভয় পেত- সেসব ফ্যাক্টর কাউন্সিলরদের মধ্যে এসে গেছে। কোথাও পাড়ার দাদা নিজেই কাউন্সিলর। ফলে পাড়ায় পাড়ায় ‘সেরা দাদা’ তো কাউন্সিলর নিজেরাই। আলাদা করে কোনও দাদার স্পেস নেই। দু’-একটা ব্যতিক্রম। বাকি সব পলিটিশিয়ানকে তুষ্ট রেখেই চলতে হয়। তাই এই সিস্টেমে আর আগের মতো এলাকার দাদা হওয়ার স্কোপ নেই।”

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, নিশ্চয়ই ভাল কিছু কাউন্সিলর আছেন। এখন তো বিভিন্ন পেশার বহু কৃতীও কাউন্সিলর। কিন্তু নয়ের দশকে বসে বলা সাতের দশকের আতঙ্ক হেমেন মণ্ডলের এই উপলব্ধি কি এককথায় উড়িয়ে দেওয়ার মতো ছিল? হেমেনদার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম, সেই সময়ের ‘দাদারা’ দাপুটে হিসাবে নাম প্রতিষ্ঠায় যতটা মন দিত; পরের দিকের স্কোয়‌্যার ফুট হিসাবে তোলাবাজির মতো অঙ্ক তাদের মাথায় থাকত না। তখন এলাকা দখল, ভোট, পুজোটা কার নামে বিখ্যাত হবে- মূলত তার লড়াই। ‘সম্পত্তি’ বলতে বড়জোর একটা দোকান, রেস্তরাঁ। এখনকার মতো পরের পর কোম্পানি করে ব্যবসায়ীতে রূপান্তরিত হওয়া নয়। হেমেনদার এসব কথা নিয়ে একটা জমজমাট সাক্ষাৎকার লিখেছিলাম। ও কিন্তু রাজনীতির স্রোতের কাছাকাছি সেভাবে থাকল না। এখন অনেক দিন কোনও যোগাযোগ নেই। শুনেছি মাঝেমধ্যে সন্ধ্যায় কাঁকুড়গাছির একটা চায়ের দোকানে আড্ডা মারতে আসে।

পঞ্চপাণ্ডব
এক অন্য ‘পঞ্চপাণ্ডব’ খুঁজে পেয়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। জীবনপথের বাঁকে কত যে মণিমাণিক্য পড়ে থাকে! শিলিগুড়ি থেকে কোচবিহার যাচ্ছিলাম সেদিন। জামালদহে এসে মনে হল, একটু চা-বিশেষ প্রয়োজন। চালক গাড়ি দাঁড় করালেন। সামনে একটি বেশ জমজমাট দোকান।
-দাদা, চা হবে তো?
-হবে, আসুন।
অতঃপর প্রবেশ। দোকানের নাম ‘রামকৃষ্ণ সুইটস’। বোঝা গেল চা, নানারকম মিষ্টি, ভুজিয়ার বেশ চালু দোকান। থরে থরে সাজানো খাবার। ভিড়ও যথেষ্ট। ‘আমদই’-ও পাওয়া যাচ্ছে। আমরা ক’জন। শ্যামলদা, সঞ্জয়, দেবাশিস ভিতরে চা নিয়ে বসলাম। সঙ্গে টাটকা গাঠিয়াভাজা, বাদাম-সহ। হঠাৎ সঞ্জয়রা দেখাল, ‘দেখো, কী লেখা!’ ঘুরে দেখি একাধিক বিজ্ঞপ্তি। দেওয়ালে টাঙানো। এই দোকানে ক্যানসার-আক্রান্তরা বিনামূল্যে খেতে পারেন। এখানে অন্ধদেরও বিনামূল্যে আপ্যায়ন। গরিবদের দুপুরের আহারের একটি বিজ্ঞপ্তিও উজ্জ্বল। প্রতিটিতেই একটি সংগঠনের নাম: পঞ্চপাণ্ডব। ফলে কৌতূহল। জানা গেল, দোকান সামলানো মালিক লোকটি পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম পাণ্ডব!
কথা বলতেই হয়। দেখা গেল, তিনি যথেষ্ট সচেতন। আলাপের আগেই বলছেন, ‘কুণালবাবু তো! কোচবিহার যাচ্ছেন সেতু উদ্বোধনে। জানি। হাত একটু ফাঁকা করেই আসছি।’
এলেন তিনি। মৃন্ময় ঘোষ।

তিনি দোকান চালান। চার বন্ধু শিক্ষক। পঞ্চপাণ্ডব নানা কাজ করেন। নমুনা: এখানে দৃষ্টিহীন ও ক্যানসার-আক্রান্তদের বিনামূল্যে খাওয়ানো। এলাকার গরিবদের মধ্যাহ্নভোজ। এঁরা ২১ জন ডাক্তারি ছাত্র, ২৩ জন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রকে পড়াতেন তখনই। এখন সংখ্যাটা দ্বিগুণ, তিনগুণ। কলকাতা বা রাজ্যের প্রায় সব মেডিক‌্যাল কলেজেই এঁদের স্পনসরশিপে পড়ুয়া। আর্থিক সংকটে এই মেধাবীদের থেমে থাকতে হয়নি, হয় না। এলাকায় কোনও গরিব অসুস্থ হলে বা দুর্ঘটনায় পড়ে বিপন্ন হলে ছুটে গিয়ে চিকিৎসার বন্দোবস্ত। এই নজিরও আছে, পায়ে সংক্রমণ। পোকা ভর্তি। মৃন্ময় নিজে হাতে পরিষ্কার করে তারপর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন। আপাতত সেই রোগী আবার সুস্থ হয়ে ছোটখাটো ব্যবসাতে। আর তাতেও পঞ্চপাণ্ডবের মদত। দারিদ্রে যে টু-হুইলার বিক্রি করে দিতে হয়েছিল, তা আবার তাঁকেই কিনে দিয়েছেন তাঁরা। মৃন্ময় সবিনয়ে বলেছেন, ‘এই তো জীবন। এই কাজটুকুই থাক। আমরা বড় কোনও সংগঠন নই। পাঁচ বন্ধু মিলে যতটা পারি, চেষ্টা করি।’
কে বলল বড় সংগঠন নয়? মৃন্ময়রা যা করছেন, তা সত্যি বড়। অনেক বড়। আজকের এই প্রচারের যুগে উত্তরবঙ্গের জামালদহের গঞ্জে বসে যে কাজ করে চলেছেন, তা বেনজির। সেই কর্মযজ্ঞ বাড়ছে, নতুন পরিকল্পনাও আসছে। যখনই ওদিকে যাই, মৃন্ময়দার ওখানে দাঁড়াই। প্রথমবার দোকান থেকেই ‘ফেসবুক লাইভ’ করেছিলাম। কী বিপুল দর্শক! বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেই পঞ্চপাণ্ডবের কাজের প্রতিফলন। শেষবার ওখান দিয়ে যাব। একটু আগে ফোন করলাম, ‘দোকানে আছেন না কি?’ মৃন্ময়দার আন্তরিক জবাব, ‘আছি এবং আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। একটু আগে আপনার একটা ফেসবুক লাইভ দেখলাম। বুঝলাম, কাছেই আছেন। তাহলে ঠিক আসবেন। চলে আসুন। আছি।’

বাকি শুধু হিংলাজ
ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল অমিতাভ মজুমদারের বিধাননগরের দপ্তরে। সময়টা ২০১৮-’১৯। দু’-চারটি কথার পরেই আমি অবাক। মা সতীর ৫১ পীঠের মধ্যে ৫০টি পীঠ তাঁর যাওয়া হয়ে গিয়েছে। বাকি শুধু ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’। সেটিও বাকি রাখতে চান না তিনি। পাকিস্তান সফরের অনুমতি চেয়ে আবেদন করে সবরকম চেষ্টা চালাচ্ছেন তখন।

তিনি- অর্থাৎ প্রভঞ্জন দত্ত। বিধাননগরের বর্ষীয়ান বাসিন্দা। বয়স ৮৫। একসময়ে জেশপে কাজ করতেন। এখন অবসর জীবনেও নেশা শুধু তীর্থস্থান স্পর্শ। সতীর ৫১ পীঠ সফর শুরু সেই ১৯৬০ সাল থেকে। একসময় স্ত্রী সঙ্গে ঘুরতেন। পরে প্রয়াত। প্রভঞ্জনবাবু এখন একাই ঘুরছেন।বাংলাদেশের পীঠগুলিও ঘোরা হয়ে গিয়েছে। প্রভঞ্জনবাবুর শরীর ভাল নয়। আর দেরি করতে চান না। হিংলাজ গিয়ে ৫১ পীঠ দর্শন সম্পূর্ণ করতে চান তিনি। এই সংক্রান্ত অনুমতি চেয়ে নথি পেশ করেছেন। কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রীকে চিঠিও পাঠিয়েছেন। বলেছিলেন, ‘মাত্র চারটি দিনের জন্য পাকিস্তান সফরের অনুমতি চাই।’
এইভাবে পীঠগুলিতে যাওয়ার ইচ্ছা হল কেন?
প্রভঞ্জনবাবুর জবাব, ‘এটা আমার ঠাকুরমার প্রভাব। ১৯৪৬ সালে উনি হিংলাজ গিয়েছিলেন। ওঁর কাছ থেকে সতী মায়ের সব শুনেই আমার ৫১ পীঠ যাওয়ার স্বপ্ন। ৫০টি যাওয়া হয়েছে। ৫১তম যেতেই হবে আমাকে। হিংলাজ যাবই। অনুমতি পেতে কেউ আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন?’

তারপরেও একবার কথা হয়েছিল। শরীর আরও ভেঙেছে। তবু, যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল, ‘ওটা আর বাকি রাখতে চাই না। মরুতীর্থ হিংলাজ ডাকছে।’ এরপর অমিতাভদা মারা গেলেন। যোগাযোগের জায়গাটা থাকল না। তবে ফোন ভরসা। মাঝে একবার কথা হয়েছিল। এই লেখা লিখতে লিখতেই
ফোন করলাম আবার। বৃদ্ধ বেজায় খুশি। বললেন, ‘এই তো, গত মাসে মহীশূরে একটি তীর্থ ঘুরে এলাম কয়েকশো সিঁড়ি ভেঙে। এখন বয়স ৯১ চলছে। তাতে কী! আমি ফিট। ওই হিংলাজটা বাকি রাখতে চাই না। এখনও চেষ্টা করছি। দিল্লির কোথাও একটু বলে দিলে অনুমতিটা পেয়ে যাই। দেখুন না একটু।’

বেণুর সেই রাত
সুপ্রিয়া দেবীকে আমার বরাবরই ভাল লাগত। কিছু ক্ষেত্রে সৌন্দর্য ও অভিনয় ক্ষমতায় সুচিত্রা সেনের থেকেও এগিয়ে। দেখেছি মাত্র তিন-চারবার। আলাপ নামমাত্র। কিন্তু তিনিই আমার মনে রাখার মতো চরিত্রের একজন হয়ে আছেন, স্রেফ একটি দিনের জন্য।

[আরও পড়ুন: কর্ণাটকে কেন ডাহা ফেল করল নরেন্দ্র মোদির বিজেপি?]

উত্তমকুমারের জন্মদিন মানেই তো কাগজ আর চ্যানেলে স্মৃতির ঢল। ঘুরে-ফিরে অবশ্য সেই এক পাঁচ-ছ’জন মুখ। অবশ্য তার বেশি আর আসবেই বা কোথা থেকে? তখন চ্যানেল টেন, সময়টা ২০১১। মহানায়কের জন্মদিনে দর্শককে নতুন কিছু দিতে হবে। আমার মাথায় একটা ভাবনা এল। সটান সুপ্রিয়া দেবীর কাছে গেলাম, বাড়িতে। বুঝিয়ে বললাম, ‘উত্তমবাবু কী খেতে ভালবাসতেন, আপনি কী রাঁধতেন, এসব আর শুনব না। শুধু একটা রাতের বিস্তারিত গল্প শুনব। যে-রাতে উত্তমবাবু পুরোপুরি আপনার কাছে থাকতে চলে এলেন, সেই রাতের সবিস্তার ঘটনা। আর অন্য কিছু নয়।’ সুপ্রিয়া একটু তাকিয়ে ছিলেন, বলেছিলেন, ‘ওসব মনে পড়লে বড্ড মনখারাপ হয়।’ কিন্তু রাজি হয়েছিলেন। আমার পরিকল্পনা ছিল বিকেলে রেকর্ড করে নেব। রাতে স্টুডিওয় আমি সঞ্চালক। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গে লাইভে। আর সুপ্রিয়া দেবীর রেকর্ডিংটা কেটে কেটে নেব। বিকেলে রেকর্ডিংয়ের সময়ই আমি মুগ্ধ। সবটাই বলেছিলেন সুপ্রিয়া। ঘটনার আগের দিন দুপুরে সুপ্রিয়ার এখানেই লাঞ্চ সারেন মহানায়ক। বিকেলে বাড়ি ফেরেন, কোনও একটি অনুষ্ঠানও ছিল। সেদিন রাতে উত্তমবাবুর সঙ্গে গৌরীদেবীর তুমুল ঝামেলা হয়। একেবারে মধ্যরাতে সুপ্রিয়ার বাড়ি বেল বাজান মহানায়ক। দরজা খোলার পর প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘বেণু, তুমি আমাকে তোমার কাছে একটু থাকতে দেবে?’ সেই থেকেই ময়রা স্ট্রিটের ফ্ল্যাটেই উত্তমের ঠিকানা। বাড়ি যেতেন বটে, কিন্তু ফিরতেন সুপ্রিয়ার কাছেই। সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়েন উত্তম। পরদিন সকালে সুপ্রিয়া একা বেরিয়েছিলেন পুরুষের কিছু পোশাক, শেভিং কিট কিনতে। এক বিতর্কিত অথচ আন্তরিক সংসার শুরু দু’জনের। পূর্ণ আবেগ নিয়ে বিস্তারিতভাবে সবটা বলেছিলেন সুপ্রিয়া দেবী। অনুষ্ঠান ভরপুর জমেছিল। টেলিকাস্টের পর দারুণ সাড়া। তবে রেকর্ডিংয়ের দিন একেবারে শেষে দেখেছিলাম ভিতর থেকে চুরমার এক সুপ্রিয়াকে। করুণ স্বরে বলেছিলেন, ‘জানো, মানুষটা থাকল আমার কাছে। অথচ ওর ওই আচমকা অসুস্থতা, এমনকী, মৃত্যুর পর একবার আমাকে দেখতে দিল না ওরা। এই যে বাড়িটা, উনি তো মন থেকে এখানেই থাকতেন। একবার কি মরদেহটা এখানে আনা যেত না? আমাকে যেতেও দিল না। আমি শেষ দেখা আর দেখতে পেলাম না।’

এখনও যে পুরনো ছবি দেখি, উত্তম-সুপ্রিয়া জুটিকে দেখি, বিশ্বাস করুন, বারবার মনে পড়ে যায় ময়রা স্ট্রিটে সেই বৃদ্ধার সাক্ষাৎকার, ‘উত্তমবাবু বললেন, আমাকে একটু থাকতে দেবে?’

অসীম আচার্য
তখন আমার বন্দিজীবন। প্রেসিডেন্সি জেলের পয়লা বাইশ সেল ওয়ার্ডের ২১ নম্বর সেলে। অন্যায় বন্দিদশার বিরুদ্ধে আমি আপ্রাণ লড়ে যাচ্ছি। কোর্টে, কোর্টের বাইরেও। ২০১৪ সালের নভেম্বর। সিবিআই কোর্টে আমি ক্ষুব্ধ স্বরে কিছু দাবি সামনে রেখে বললাম, যদি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তা পূরণ না হয়, তাহলে আমি আত্মহত্যা করব। মুহূর্তে খবর রটে গেল। কোর্ট থেকে জেলে ফিরতেই ডেকে পাঠালেন সুপার নবীন সাহা, ‘আপনি সিরিয়াস? এসব করবেন না।’ আমি বললাম, ‘আমি সিরিয়াস। তবে আপনার বা আপনাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। সমস্যা অন্য জায়গায়।’

এরপর আমার উপর নজরদারি বাড়ানো হল। দু’জন স্পেশ্যাল সেপাই সর্বক্ষণ। অন্যান্য রুটিন পাহারাদার তো আছেনই। জেল কর্তারা দফায় দফায় কাউন্সেলিংয়ে আসেন, জেলার, সুপার, ডিআইজি, এআইজি। সহ-বন্দিরাও বোঝান, ওটা মাথা থেকে সরান। আমি শুনি। ৪৮ ঘণ্টা পার, শেষ ২৪ ঘণ্টা। জেল নজরদারি বাড়াল। আমি বললাম, ‘বাড়ি থেকে কোনও আত্মীয়-বন্ধু এলে দেখা করব না।’ ভিতরে যাতে নরম না হয়ে যাই। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ ঠিক সেটা করাল। বিকেলে সেল বন্ধের আগে সুপারের নেতৃত্বে বিরাট বাহিনী আমার সেল তল্লাশি করল। আমার পরনের পোশাকও। কোনও ঘুমের ওষুধ, দড়ি থাকবে না সেলে, যাতে আত্মহত্যার চেষ্টা করা না যায়। ডাক্তারবাবু পরীক্ষা করলেন। তারপর আমাকে বন্ধ করা হল সেলে। দরজায় দু’জন সেপাই বসে আমার দিকে তাকিয়ে। কৃষ্ণ আর কেদার। ঘনঘন আসছেন বড়কর্তারা, ওয়ার্ডের অন্য রক্ষীরা। একটু বসে তাদের সঙ্গে গল্প করলাম। তারপর একটু লেখালিখি। তারপর খাওয়া। তারপর কিছু ‘একলেয়ার্স’ লজেন্স খেতে থাকলাম। ওদেরও ক’টা দিলাম। তারপর একটি সুইসাইড নোট লিখলাম। তারপর সেপাইদের বললাম, ‘আমি এবার ঘুমব। কেউ এলে ডাকবে না।’ আমি শুয়ে পড়লাম। এখানে এর বেশি কিছু লিখছি না। এর অনেক পরে আমার জ্ঞান আবছা আসতে ক্রমশ বুঝলাম আমি এসএসকেএম-এ চিকিৎসাধীন। চারপাশে পুলিশ আর ডাক্তার। সে আর-এক পর্ব। তার দু’দিন পর আবার জেলে ফেরা। কড়া নিরাপত্তায় ন’নম্বর সেল। ডবল খাঁচার দরজা দুটোই বন্ধ। উপরে সিসি ক্যামেরা। সেসব আরও অনেক ঘটনা। ততক্ষণে সুপার-সহ অনেকে সাসপেন্ড।

আমার মাথায় তখন ঘুরছে, আমাকে বাঁচাল কে? মাঝরাতে আমাকে এসএসকেএম পাঠানো হল কীভাবে? কারণ আমি যখন ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলাম, তারপর একেবারে সকাল ছ’টার পর প্রহরীর ডাকার কথা। এই বড় সময়টা মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু মাঝখানে সব উল্টে গেল কী করে? ক্রমশ জেলকর্মী এবং সহ-বন্দিদের কাছ থেকে শুনলাম ঘটনাটা।

সেই রাতে জেল গেটে সিডিও, মানে প্রধান অফিসার ছিলেন অসীম আচার্য। তাঁর ডিউটি মূল গেটের পরেই, অফিসের পাশে। পরের গেট পেরিয়ে মূল জেলের মধ্যে নয়। যেহেতু আমার ৭২ ঘণ্টা নোটিসের সেটাই ছিল তৃতীয় রাত, তিনি দায়িত্ববোধ ও কৌতূহল থেকে রাত দেড়টা নাগাদ ভিতরে ঢুকে আমাকে দেখতে আসেন। সেলের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি দেখেন, আমি চিৎ হয়ে ঘুমচ্ছি। সেপাইরা বলেন, সব ঠিক আছে। অসীমবাবু যাননি। সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এই সময় তাঁর মনে হয়, আমার বাঁ-হাতের কিছু নড়াচড়া অস্বাভাবিক। কিছুদিন আগে এক হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে নাকি তিনি এমন দেখেছিলেন। বিষয়টা চলতে থাকলে তিনি আর ঝুঁকি নেননি। সেপাইদের বলেন সেলের তালা খুলতে। লক-আপের পর সেলের তালা খোলা ভয়ানক অনুমতিসাপেক্ষ বিষয়। অসীমবাবু জোর দেন তালা খুলতে। রক্ষীরা তালা খুলতেই তিনি ভিতরে ঢুকে দেখেন আমার মাথার কাছে সুইসাইড নোট। ঘুমের ওষুধ কোথায় ছিল সেটাও বোঝা যায়। সঙ্গে সঙ্গে খবর যায় সর্বত্র। ছুটে আসেন কর্তারা। চলে আসে পুলিশ। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। স্টমাক ওয়াশ করে ঘুমের ওষুধ বের করা হয়। আমি প্রাণে বেঁচে যাই।

আগে অসীম আচার্য, সবাই বলে ‘আচার্যি’- তাঁর সঙ্গে আমার তেমন আলাপ ছিল না। কারণ উনি জেলের ভিতর খুব একটা আসেন না। এরপর একদিন আলাপ হল। নিজেই এলেন। হাসলেন। বললাম, “আসুন, ক’দিন খুব আপনার নাম শুনছি।” বললেন, ‘কী শুনছেন?’ বললাম, ‘আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন।’ কপালে হাত ছুঁইয়ে বললেন, ‘ভগবান রক্ষা করেছেন।’ আমি বললাম, ‘কী হয়েছিল বলুন তো?’ অসীমবাবু বলেছিলেন ঘটনাবলি, মূলত যা ইতিমধ্যেই শুনেছিলাম চারপাশ থেকে। তাঁর প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা। পরে সেভাবে আর বিশেষ কোনও যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু সে-রাতে আমার প্রাণ যেত, অথবা বড়সড় কোনও শারীরিক ক্ষতি হত; এবং তারপর আমি আরও অনেক কিছু দেখতে পেতাম না। এই সবকিছু থেকে ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন এই কারা-অফিসার অসীম আচার্য।

[আরও পড়ুন: মুঘল থেকে মোদি সাম্রাজ্য, দিল্লির ভুল ধরিয়ে দিয়েছে দাক্ষিণাত্যে]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement