প্রথম ছাত্র কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ। আত্মপ্রকাশের বছরে তিনি ছাড়াও আরও ২০ জনকে শিক্ষার্থী হিসাবে পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের বহু যত্নে গড়ে তোলা ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’। কারা কারা ছিলেন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের জন্মবছরের শিক্ষার্থী। লিখছেন দেবাঙ্গন বসু।
গত শতাব্দীর একেবারে গোড়ায়, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করলেন। এখন, এই বীজ ক্রমে অঙ্কুরিত ও বিকশিত হয়ে শতবর্ষেরও বেশি সময় কাটিয়ে সমগ্র বিশ্বের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে। মনে প্রশ্ন জাগে, একেবারে প্রথম দিনে কারা এই বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে ছিলেন এবং প্রথম বছরে সব মিলিয়ে কাদের ছাত্র হিসাবে পেয়েছিল সেদিনের ব্রহ্মচর্যাশ্রম?
সেদিনকার অনুষ্ঠানের বিবরণ দিয়ে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’-য় যা লিখিত হয়েছিল সেখানে ছাত্রদের নাম বা সংখ্যা নির্দিষ্ট করা নেই। বলা আছে, ‘কতকগুলি বালক ক্ষৌম বস্ত্র পরিধান করিয়া বিনীতভাবে উপবিষ্ট হইয়াছে।’ কারা এই বালক, খেঁাজ নেওয়া যাক। এদের মধে্য দু’জন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) দুই পুত্র– রথীন্দ্রনাথ ও শমীন্দ্রনাথ। তাদের বয়স তখন যথাক্রমে ১৩ ও ৫ বছর। এছাড়া, সেদিন আরও পঁাচটি ছাত্র উপস্থিত ছিল।
এরা কলকাতায় ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের কাছে পড়াশোনা করত– সিমলা বাজার স্ট্রিটে একটি ছোট ঘরোয়া বিদ্যালয় গড়েছিলেন ব্রহ্মবান্ধব, সঙ্গে ছিলেন তঁার সিন্ধুদেশীয় শিষ্য রেবাচঁাদ, যিনি পরে ‘ব্রহ্মচারী অনিমানন্দ’ নামে পরিচিত হন। এঁদের সহায়ক ছিলেন কলকাতা নিবাসী কার্তিকচন্দ্র নাগ, যিনি একসময়ে ব্রহ্মবান্ধবের ছাত্রও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই বিদ্যালয়টি দেখতে আসেন, সম্ভবত ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে। তখনই ব্রহ্মবান্ধবের সঙ্গে পরামর্শ হয়, শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন বিষয়ে। উপাধ্যায়মশাই কলকাতার বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে বোলপুর যেতে সম্মত হন।
এই ঘটনার মাস তিনেকের মধে্যই শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের সূচনা হল– ২৩ ডিসেম্বর ১৯০১ সালে। রথীন্দ্র ও শমীন্দ্র ছাড়া আরও পঁাচজন ছিলেন– শ্রীরামকৃষ্ণর ঘনিষ্ঠ-সান্নিধ্যধন্য মণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্তর পুত্র গৌর গোবিন্দ গুপ্ত, ওই পরিবারেরই আর-এক শিক্ষার্থী অশোককুমার গুপ্ত, পূর্বোক্ত কার্তিকচন্দ্র নাগের পুত্র সুধীরচন্দ্র নাগ, দর্শনের অধ্যাপক অম্বিকাচরণ মিত্রর ভাইপো যোগানন্দ মিত্র এবং ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক যোগেন্দ্রনাথ বসুর গুরুপুত্র গিরিন ভট্টাচার্য। এর কয়েক দিনের মধে্যই আরও দু’জন ছাত্র আসে– সুধীর নাগের পিসতুতো ভাই রাজেন্দ্রনাথ দে এবং অশোককুমার গুপ্তর দাদা প্রেমকুমার গুপ্ত। রবীন্দ্রনাথের বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের পুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদার আরও কিছু দিন পর এই ছাত্রদলভুক্ত হন।
রবীন্দ্রনাথের খুবই ইচ্ছা ছিল, ত্রিপুরার রাজপুত্র ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মাকে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্র হিসাবে নিয়ে আসার, কিন্তু শেষাবধি সে পরিকল্পনা সফল হয়নি। ইতিমধে্য মাসখানেকের ভিতরেই ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্রসংখ্যা ৭ থেকে বেড়ে ১২ জন হয়। দু’টি স্মৃতিকথার সাহাযে্য এসব ছাত্রদের পরিচয় অনুমান করা যায়। একটি স্মৃতিকথার লেখক– যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়। ইনি চন্দননগরের লোক এবং ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আদি অভিভাবক, যিনি সে-সময়কার স্মৃতি লিপিবদ্ধ করেছিলেন বৃদ্ধ বয়সে। তঁার পুত্র ধীরেন্দ্র ব্রহ্মবিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং ছেলেকে ভর্তি করার আগে একবার শান্তিনিকেতনে এসে স্বচক্ষে সেখানকার ব্যবস্থাপত্র দেখে যান যোগেন্দ্রকুমার।
তঁার লেখা থেকেই জানা যায়, সে-সময় রেবাচঁাদের একটি ছোট ভাইও ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্র ছিল– এর কথা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না, নামও জানা যায়নি। ব্রহ্মবান্ধবের ভাইপো অরুণপ্রকাশ বন্দে্যাপাধ্যায় প্রথম বছরেই আশ্রমে ছাত্র হিসাবে আসেন। যোগেন্দ্রকুমারের মাধ্যমেই হুগলির ললিতমোহন বন্দে্যাপাধ্যায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আলাপ হয়, এবং ললিতমোহন তঁার পুত্র অবনীমোহনকে আশ্রমে পড়তে পাঠান।
এই অবনীমোহনের স্মৃতিকথাও ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম বছরের ছাত্রদের চিনতে সহায়তা করেছে। অবনীমোহন নিজে এবং কয়েক মাস পরে তিনি অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলে তঁার কাকা শৈলেন্দ্রমোহন এবং পিসতুতো দাদা বিজনকুমার মুখোপাধ্যায় আশ্রমে ছাত্ররূপে যোগ দেন। সাহিতি্যক অক্ষয়চন্দ্র সরকারের ছোট ছেলে অচু্যত সরকারও এই সময় পড়তে আসেন আর একটি ছাত্রের নাম পাওয়া যায়, তাকে অক্ষয়চন্দ্রই চুঁচুড়া থেকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন– তারক, কিন্তু তার পদবি বা অন্য পরিচয় মেলেনি। অনেক বছর পরে অবনীমোহনের ভাই প্রভাতমোহন শান্তিনিকেতনে পড়তে আসেন এবং পরবর্তী জীবনে খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী ও সাহিতি্যক হিসাবে পরিচিত হন।
প্রথম বছরের অন্যতম আর-এক ছাত্র ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের পুত্র অরুণচন্দ্র সেন। ইনি কবি সমর সেনের বাবা। এই অরুণচন্দ্রকে ব্রহ্মবিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর বিষয়ে দীনেশ সেন যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন, অথচ একটু চিন্তাও হচ্ছিল তঁার। রবীন্দ্রনাথ তখন আশ্বাস দিয়ে লেখেন, ‘পনেরো দিনের মধে্যই সে এখানে এমনি জমিয়া যাইবে যে বাড়ি যাইবার নাম করিবে না। এখান হইতে যে সকল ছাত্র ঘরে ফেরে তাহারা অশ্রুজল না ফেলিয়া যায় না।’ অতঃপর অরুণচন্দ্র শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন।
যদিও রথীন্দ্রনাথ এবং সন্তোষচন্দ্রর বয়স সে-সময় দশ বছরের বেশি ছিল, কিন্তু সাধারণভাবে দশ বছরের অধিক বয়সি ছাত্রদের রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ভর্তি নিতে চাইতেন না। তঁার আশঙ্কা ছিল, বয়স্ক ছাত্রদের সঙ্গে মিশলে ছোটদের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে– যা তৎকালীন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের উদ্দেশে্যর পরিপন্থী।
কিন্তু একজন ছাত্রের ক্ষেত্রে ওই নিয়ম বিপুলভাবে শিথিল করা হয়– তিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম বিদেশি ছাত্র, ২৫ বছর বয়স্ক জাপানি বৌদ্ধ পুরোহিত হোরি মান। ইনি ওকাকুরার সঙ্গী হিসাবে ভারতে আসেন এবং ঘটনাক্রমে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে স্থান লাভ করেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাস থেকে শুরু করে ছ’-সাত মাস তিনি এখানে সংস্কৃত শিক্ষা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কন্যা মীরা রোজ কিছু ফুল উপহার দিতেন এই ছাত্রটিকে, আর শিখে নিতেন দু’-একটি করে জাপানি শব্দ। পরবর্তীকালে ভগিনী নিবেদিতার লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায়– পাঞ্জাবের কোনও স্থানে ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত হোরি মান অচিরে ধনুষ্টংকারগ্রস্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করেছিলেন।
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচারণাসূত্রে জানা যায়, সম্পর্কে তঁার ভাগনে, জেঠামশাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌহিত্র, নয়নমোহন চট্টোপাধ্যায় প্রথম বছরেই পড়তে এসেছিলেন আশ্রমে এবং ‘বিসর্জন’ নাটকে গোবিন্দ-মাণিকে্যর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
সব মিলিয়ে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রথম এক বছরের মধে্য, এই ২১ জন ছাত্র শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে অধ্যয়ন করেছিলেন এ-কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এঁদের মধে্য অনেকেই হয়তো স্বল্প কয়েক মাসের জন্য ছাত্র ছিলেন, তারপর ছেড়ে চলে যান। আবার এমন ছাত্রও ছিলেন, যিনি পরিণত বয়সে, ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার প্রায় ৫২ বছর পরে স্বেচ্ছানির্বাসনে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে চলে যান। হঁ্যা, তিনিই ছিলেন শান্তিনিকেতনের (Santiniketan) প্রথম ছাত্র– রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.