উর্মি খাসনবিশ:
– “আহ দাদা এটা সিনিয়র সিটিজেন সিট। মাসিমাকে বসতে দিন।”
– “আমার বয়স কম? ভোটার কার্ড দেখাতে হবে নাকি? আমার বয়স ৫৬। আমি সিনিয়র নই?”
– “উনি ঠিক করে দাঁড়াতে পারছেন না। বুঝতে পারছেন না?”
– “চুলগুলো অমন মিশমিশে কালো করার সময় মনে থাকে না? চুলে ডাই করে সব সময় ‘অভি তো ম্যায় জওয়ান হুঁ’, আর বাসে ভিড় দেখলেই সিনিয়র সিটিজেন। ইয়ার্কি হচ্ছে?’
এমন তর্ক রোজ চলে। ডেলি প্যাসেঞ্জারির কল্যাণে এমন বহু তর্কের সাক্ষী হন অনেকেই। আসলে স্টিরিওটাইপ লেডিজ সিট, সিনিয়র সিটিজেন সিট ইত্যাদির লোভ যে মানুষ আজও একেবারে বর্জন করতে পারেননি তা বহু বুদ্ধিমান-বুদ্ধিমতিদের স্বীকার করায় সামান্য কুণ্ঠাবোধ রয়েছে। কেউ কেউ আবার হিপোক্রিটের তকমা মুছতে বলেন, “নিজের অধিকার পেয়েছি। বসেছি। বেশ করেছি। আবার বসব।” নিতান্তই নিজেকে জাস্টিফাই করা। জীবনে বহু ক্ষেত্রে নিজেকে জাস্টিফাই করার প্রয়োজন পরে থাকে। ভবিষ্যতেও যে প্রয়োজন ফুরোবে না, তাও আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বহুবার লক্ষ্য করেছি লেডিস সিটে বসে রয়েছেন কোনও বয়স্ক ব্যক্তি৷ তাঁকে অবলীলায় সিট থেকে সরিয়ে দিলেন কোনও অষ্টাদশী৷ কোনও অলিক অভিধানে যেন লেখা রয়েছে ‘নিজেদের হক কেঁড়ে নিতে হবে যেমন করেই হোক৷’ কিন্তু অধিকারের লড়াই কোনটা আর বেঁচে থাকার জন্য একে অপরের সঙ্গে সহজ বোঝাপড়া বজার রাখা কোনটা সেই ফারাক যেন বুঝে উঠতে পারছেন না কেউই৷ নারীবাদ আওড়াতে গিয়ে কখন হারিয়ে যাচ্ছে মানবিক বোধ তার খোঁজ রাখছেন না কেউ৷ আর কোনও মহিলা যদি এই ধরনের ‘বাদ’ কবলিত আচার-ব্যবহারের বিরোধিতা করেন তবে এমন কথা শুনতে হতে পারে যে, ‘মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু৷’
কিন্তু কেবল প্রখর অর্ধেক জ্ঞান সম্পন্ন নারীবাদীদের দোষ দিয়ে লাভ কী? লেডিস সিট ভর্তি থাকে এবং কোনও অন্তঃসত্ত্বা বা বয়স্ক মহিলা বাসের রড ধরে ঝুলছেন, তখন বহু পুরুষকেই দেখি নির্বিকার মুখে নিজেদের জায়গায় বসে রয়েছেন। যেন কিচ্ছুটি হয়নি। অপারগ অবস্থায় মহিলাদের দাঁড়িয়ে থাকাটাই তাঁদের ভবিতব্য। বরাদ্দের বাইরে তাঁদের কিচ্ছুটি মেলা উচিত নয়।
এই আশ্চর্য মানসিকতার আবির্ভাব কেমন করে হয়েছে তা জানতে ইচ্ছে করে মাঝেমধ্যে। মহিলাদের যদিও ছোট থেকেই শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে, কোনটা তাঁদের গণ্ডি, তাঁরা পুরুষের থেকে কতটা আলাদা, কোথায় কম, কোথায় দুর্বল ইত্যাদি। কিন্তু পুরুষরা? তাঁদের তো ছোটবেলা থেকেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তাঁরাই রক্ষাকর্তা-বিধাতা। তাঁরা সব বোঝেন, সব ভাল করতে পারেন। তবে তাঁরা সামান্য বসার জায়গার জন্য এমন হাহুতাশ করেন কেন বলতে পারেন?
দেশের পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে না হয় সব মহিলাকে অভিভাবক-সুলভ ধমক দেওয়ার অবস্থা নেই এখন। কিন্তু যেই মেয়েরা বাড়ির গণ্ডি ছাড়িয়ে স্কুল-কলেজ-অফিসে যাচ্ছেন? যাঁরা নিজেদের মতো করে ভাবতে শিখছেন? তাঁরা? তাঁরা তো নারীবাদের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানবতাকে প্রাধান্য দিতে পারেন! নিজেকে মানুষ হিসাবে ভেবে এবং পুরুষ জাতিকে শত্রুপক্ষ না ভেবে তাঁদের সমস্যায় সহমর্মীও তো হতে পারেন।
একথা সত্যি ভারতের মতো দেশে মহিলাদের উন্নতির জন্য নারীবাদীদের উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন। মহিলাদের উন্নতিতে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু মহিলাদের উন্নতির পথে পুরুষদের ঘৃণা করা কি বাধ্যতামূলক? নাকি নারী-পুরুষ সমানভাবে এগোতে পারেনা?
সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নারী ও পুরুষকে সন্মোধন করার এক অভিনব নিয়মের প্রচলন ঘটিয়েছেন৷ পুরুষকে ‘হি’ বা মহিলাদের ‘শি’ বলে সম্বোধন করার পরিবর্তে তাঁরা বেছে নিয়েছেন ‘জি’ শব্দটি৷ এমনই একটি ইউনিসেক্স শব্দের প্রচলন ঘটিয়ে তাঁরা মুছে ফেলতে চাইছে পুরুষ এবং স্ত্রী’র মধ্যেকার এই প্রচলিত পার্থক্যগুলিকে৷ ছকে বাধা পরিচয়ের বাইরে গিয়ে ‘মানুষ’ পরিচয়ের উপরই জোর দিচ্ছেন এই নতুন প্রজন্ম৷
ভাবি, এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও আমরা নিজেদের নারী-পুরুষ, বয়স্ক, সুন্দর, কুৎসিত,যুবক-যুবতী প্রভৃতি নানা প্যারামিটারে বিচার করে গেলাম। নিজেদের আর মানুষ হিসাবে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা রইল না। আর তারজন্যই মনে হয় মহিলা, বৃদ্ধ, তফসিলি প্রভৃতি নানা কিছুর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে রিজার্ভ সিট।
যে দেশে মানবিকতাও নিয়ম করে চাপিয়ে দিতে হয় রিজার্ভ সিটের মতো ছকে, সে দেশ আদৌ এগোচ্ছে তো?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.