অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার ভিত্তিতে সংরক্ষণ চালুর দাবি রাজনৈতিক স্তরে গত ৭৫ বছর ধরে অন্তঃসলিলা নদীর মতোই বহমান। ’৯১ থেকে দেশে পরপর সব নির্বাচনে জাতের সমীকরণ একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছিল। ‘ইডব্লিউএস’ নয়া সন্ধিক্ষণে ফের দেশকে দাঁড় করাতে পারে। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
১৯৫১ সালেই চম্পকম দোরাইরাজন মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল সংরক্ষণের ভিত্তি হবে জাতপাত-ই। ঐতিহাসিক বৈষম্য থেকে উদ্ভূত সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা কাটিয়ে ওঠা-ই শিক্ষা ও চাকরিতে তফসিলি জাতি ও জনজাতি সম্প্রদায়ের সংরক্ষণের কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। তখনও দাবি ছিল, পশ্চাদপদ শ্রেণিকে চিহ্নিত করা হোক পরিবারের আয় ও সম্পত্তি দিয়ে। সুপ্রিম কোর্টে তা ধোপে টেকেনি। ১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভি. পি. সিং মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করে অন্যান্য পশ্চাদপদ শ্রেণি তথা ওবিসিদের জন্য সংরক্ষণ চালু করার পর আরও পিছু হটে যায় অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার বিষয়টি।
বৈষম্য দূর করতে ‘অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন’-এর হাতিয়ার হিসাবে জাতপাতের ভিত্তিতে সংরক্ষণ যতই সাংবিধানিক ও বিচারবিভাগের স্বীকৃতি লাভ করুক না কেন, ভারতের রাজনৈতিক স্তরে গত ৭৫ বছর ধরেই অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার ভিত্তিতে সংরক্ষণ চালুর দাবিও অন্তঃসলিলা নদীর মতোই বহমান। ওই রাজনৈতিক দাবির চাপেই ২০০৬ সালে ইউপিএ সরকার ‘সিনহো কমিশন’ গঠন করেছিল। এই ‘সিনহো কমিশন’-এর রিপোর্টই ভিত্তি রচনা করে উচ্চবর্ণের গরিবদের ১০ শতাংশ সংরক্ষণের। ২০১৯ সালে সংসদে ১০৩তম সংবিধান সংশোধনী আইন পাসের পর আর্থিকভাবে দুর্বল শ্রেণি তথা ‘ইডব্লিউএস’ শব্দটি একটি নতুন শ্রেণি হিসাবে সমাজে এসে গিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট গত ৭ নভেম্বরের রায়ে এই ‘ইডব্লিউএস’-কেই সিলমোহর দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় সর্বসম্মত ছিল না। বিভাজিত তথা ‘স্প্লিট’ রায়ে সংখ্যালঘু বিচারপতিদের দলে ছিলেন খোদ তৎকালীন প্রধান বিচারপতিই। ২০১৯ সালের সংসদে দেশের সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে সংবিধানের যে ১০৩তম সংশোধনীটি পাস করেছিল, তা সংবিধানের মূল কাঠামো তথা ‘বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিন’-কে বিঘ্নিত করছে কি না, সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ সেই প্রশ্নেই দ্বিধাবিভক্ত হয়। ‘সিনহো কমিশন’ অবশ্য তাদের রিপোর্টে অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার বিরুদ্ধে ‘অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন’ হিসাবে সংরক্ষণের কথা বলেনি। অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা দূর করার ক্ষেত্রে অন্যান্য কিছু পদক্ষেপের সুপারিশ ‘সিনহো কমিশন’-এর রিপোর্টে ছিল।
ভোটে নানাবিধ খয়রাতির মধ্যেই সংরক্ষণের বিষয়টিও এসে গিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলি অবলীলায় সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতিও দিয়ে থাকে। জাতিভেদ প্রথার ঐতিহাসিক ভুলের জন্য স্বাধীনতার পর ‘অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন’ হিসাবে তফসিলি জাতি ও জনজাতির জন্য কিছু সময়ের সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছিল। বাবাসাহেব আম্বেদকরও চিরন্তন সংরক্ষণের কথা বলেননি। সংবিধান প্রণেতারা যে সাময়িক সংরক্ষণের কথা বলেছিলেন, তা এখন ভোটের খয়রাতির কারণেই এক চিরন্তন ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়েছে। সংরক্ষণ তুলে দেওয়া হবে- এই কথা ভোটের মুখে বলার স্পর্ধা কোনও রাজনৈতিক দলেরই নেই। সংঘ প্রধান মোহন ভাগবতের সংরক্ষণ তুলে দেওয়া সংক্রান্ত একটি মন্তব্য একবার বিহারের ভোটে বিজেপির বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর ধরে তফসিলি জাতি, জনজাতি ও ওবিসিদের সংরক্ষণ চলছে ভোটের আগে খয়রাতি বিলনোর মতোই। খয়রাতির অঙ্গ হিসাবেই যুক্ত হয়েছিল ‘ইডব্লিউএস’-এর সংরক্ষণ। ২০১৯ সালে সংসদে সংবিধান সংশোধনী বিল পাসের সময় কোনও দলই প্রশ্ন তোলেনি যে, জাতিভেদ প্রথার ঐতিহাসিক ভুল সংশোধনের জন্য সংবিধান যে সংরক্ষণ দিয়েছে, তা কেন প্রসারিত হবে দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচির ক্ষেত্রে। জাতিভেদ প্রথার ঐতিহাসিক বৈষম্যের সঙ্গে তফাত রয়েছে দারিদ্রের বঞ্চনার।
সুপ্রিম কোর্টের স্বীকৃতির পর ‘ইডব্লিউএস’ এখন সমাজের এক নতুন গোষ্ঠী হিসাবে বিবেচিত হবে। একসময় তফসিলি জাতি ও জনজাতির বাইরে সবাইকে বলা হত ‘জেনারেল ক্যাটাগরি’। ভি. পি. সিংয়ের সময় এল ওবিসি। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর এখন তফসিলি জাতি, জনজাতি, ওবিসির বাইরে এল নতুন ক্যাটাগরি ‘ইডব্লিউএস’। ‘ইডব্লিউএস’-এর বাইরে রাখা হয়েছে তফসিলি জাতি, জনজাতি ও ওবিসি সম্প্রদায়ের গরিব মানুষকে। ‘ইডব্লিউএস’-এর বাইরে কীভাবে তফসিলি জাতি, জনজাতি ও ওবিসিরা স্থান পায়, তা কোনওভাবেই বোধগম্য নয়। দেশের শীর্ষ আদালতে এটাও অন্যতম বিচার্য ছিল। ‘ইডব্লিউএস’-এর বাইরে কেন তফসিলি জাতি, জনজাতি ও ওবিসি গরিবরা- তা নিয়ে মামলা করার হুমকি দিয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেসের বক্তব্য, সিনহো কমিশনের রিপোর্টেই বলেছিল, দেশের দারিদ্রসীমার নিচে যে মানুষ বসবাস করে, তার ৮২ শতাংশই তফসিলি জাতি, জনজাতি ও ওবিসি সম্প্রদায়। ফলে ৮২ শতাংশকে বাদ দিয়ে কীভাবে দেশে গরিব মানুষের জন্য পৃথক সংরক্ষণ হয়? কংগ্রেস বিষয়টি নিয়ে আদালতে গেলে ‘ইডব্লিউএস’-এর গণ্ডি নিয়ে আরও একদফা বিতর্ক হবে দেশজুড়ে।
১৯৯১ সালে ‘মণ্ডল কমিশন’-এর রিপোর্ট রূপায়িত হওয়ার পর ভারতের রাজনীতিতে এক বড়সড় পরিবর্তন এসেছিল। ওই সময় থেকে রাজনীতির গতিপথ বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে জাতপাত। উদ্ভব হয় পরিচিতি সত্তার রাজনীতির। তার আগে মানুষ ভোট দিয়েছে মূলত জাতপাতের বিষয়টিকে বিবেচনায় না রেখে। জরুরি অবস্থার সময় মানুষ ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল জাতের কথা চিন্তা না করে। আবার ১৯৮০ সালে যখন ইন্দিরাকে মানুষ ফিরিয়ে আনল, তখনও জাতের কথা চিন্তা করেনি। ইন্দিরার মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধীকেও ১৯৮৪ সালে মানুষ ভোট দিয়েছিল জাতের সমীকরণ না করেই। ১৯৮৯ সালে বোফোর্স ইস্যুতে রাজীব গান্ধীর ভরাডুবি ঘটল। উত্থান হল ভি. পি. সিংয়ের। ভি. পি. সিং মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট রূপায়ণের পর ১৯৯১ থেকে দেশে পরপর সব নির্বাচনে জাতের সমীকরণ একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠল। জাত ও ধর্মের সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া ক্ষমতায় আসা একরকম অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল।
‘ইডব্লিউএস’ এক নয়া সন্ধিক্ষণে ফের দেশকে দাঁড় করাতে পারে। উচ্চবর্ণের গরিবদের শিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণ দেওয়ার মতো সরকারের ‘অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন’ রাজনীতির চেহারায় বদল আনতে পারে। ব্যক্তিনির্ভর দাবিদাওয়াগুলি আরও বেশি করে সামনে আসতে পারে। গোষ্ঠীনির্ভর পরিচিতি সত্তার রাজনীতি গুরুত্ব হারাতে পারে। বহু ইস্যুর ভিড়ে সুপ্রিম কোর্টের ‘ইডব্লিউএস’-কে স্বীকৃতি দিয়ে রায় মিডিয়ায় তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। কিন্তু এই রায় ও সরকারের পদক্ষেপ আরও গভীর বিচার বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.