ভারতের জাতীয় ঐক্য নিয়ে স্যাম পিত্রোদার ‘বর্ণবিদ্বেষী’ মন্তবে্য শোরগোল। দেশের মাটির সঙ্গে যোগাযোগহীনতাই কি এই বক্তবে্যর মূলে?
বিতর্ক আর স্যাম পিত্রোদা যেন সমার্থক। রাজীব গান্ধীর উপদেষ্টা হিসাবে ভারতের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, সাক্ষরতা, টিকাকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বহু উল্লেখযোগ্য
কাজ করেছেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের মার্কিন প্রবাসী শিল্পপতি-প্রযুক্তিবিদ হিসাবে মাটির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঠিক কতটা, ভারতীয় ঐতিহ্য-পরম্পরা তিনি কতটা বজায় রেখেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে বাধ্য। যঁার সর্বশেষ পরিচয় তঁার বিতর্কিত ‘বর্ণবিদ্বেষী’ মন্তব্যেই।
ভারত বৈচিত্রময় দেশ। তা সত্ত্বেও জাতীয় ঐক্য বিদ্যমান। কীভাবে, তারই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ‘জ্ঞানের ভাণ্ডার’ উজাড় করেছেন পিত্রোদা (Sam Pitroda)। যার সারার্থ– এখানে পূর্বাঞ্চলের লোকদের চিনাদের মতো দেখতে, পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ আরবের মতো, উত্তর ভারতের মানুষ শ্বেতাঙ্গ আর দক্ষিণ ভারতের মানুষের আফ্রিকানদের মতো চেহারা! তা সত্ত্বেও ভারতীয়রা মিলেমিশে একসঙ্গে বাস করে। হঠাৎ করে স্যাম কেন চেহারা ও গাত্রবর্ণের ভিন্নতার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন, ‘বৈচিত্র’ বলতে শুধু এটাই বোঝায় কি না, বোধগম্য নয়। এবং যে কোনও শিক্ষিত মানুষের কাছেই এই যুক্তি ‘হাস্যকর’ মনে হতে বাধ্য। তিনি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও আচরণগত বৈচিত্রের কথাও বলতে পারতেন। কিন্তু বলেননি। হতে পারে, সে বিষয়ে তঁার সম্যক ধারণা নেই।
স্যাম পিত্রোদার এই মন্তব্য ফের প্রমাণ করে দিল, আমাদের দেশের নীতি নির্ধারকরা অনেকেই ‘গজদন্তমিনারে’ বাস করেন। সমাজের সর্বনিম্ন স্তরে কী ঘটছে, সেখানকার বিন্যাস কী, সে-বিষয়ে তঁাদের কোনও ‘বাস্তব’ জ্ঞান নেই। সেক্ষেত্রে তঁাদের তৈরি বিভিন্ন নীতি যে আখেরে জনগণের করের টাকার আদ্যশ্রাদ্ধ করে অশ্বডিম্ব প্রসব করবে, সে-কথা বলাই বাহুল্য।
বিতর্কিত মন্তব্যের পর স্যাম পিত্রোদা কংগ্রেসের বৈদেশিক শাখার চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দঁাড়িয়েছেন। কিন্তু প্রশ্নটা নৈতিকতার শুধু নয়, মানসিকতার। তিনি কি ক্ষমা চেয়েছেন? চাননি। তঁার দল ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে দায় সেরেছে। কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দল এখন পিত্রোদার ‘বর্ণবিদ্বেষী’ মন্তব্য নিয়ে সরব। তারা ‘ভারতীয়ত্ব’, ‘দেশের সব মানুষ এক’ বলে চিৎকার জুড়েছে। কিন্তু তারাও তো নির্বাচনের আবহে প্রবল মেরুকরণ করে চলেছে। ধর্মীয় তাস ব্যবহার করছে। কারণে-অকারণে সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করছে।
তখন তাদের ‘জাতীয়তাবোধ’ কোথায় যায়? এটাই বোধহয় নিদারুণ বাস্তব যে, দেশ দু’ভাগে বিভক্ত– শাসক ও শোষিত। সমাজের প্রান্তিক স্তর থেকে নির্বাচিত অধিকাংশ জনপ্রতিনিধিও দ্রুত ‘শ্রেণিচ্যুত’ হয়ে যান। বদলে যায় তঁাদের জীবনযাত্রা। আচরণে, ভাষণে ফুটে ওঠে দম্ভ। ভাবটা এমন, ‘আমার হাতে ক্ষমতা, চাইলেই পিষে ফেলতে পারি।’ এই ‘উত্তরণ’ বাকি সমাজের সঙ্গে তঁাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তঁারা হয়ে ওঠেন ‘দূরের মানুষ’। সে কারণেই অবাঞ্ছিত মন্তব্য করতে দু’বার ভাবেন না ‘বিশিষ্ট’-রা, বিশেষত রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.