Advertisement
Advertisement
Economy

ঋণনীতি যেন শাঁখের করাত, কোন পথে দেশের অর্থনীতি?

বাজারে মূল্যবৃদ্ধি সামান্য হলেও নিয়ন্ত্রণে।

RBI in dilemma as economy faces hurdles | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:December 8, 2022 2:45 pm
  • Updated:December 8, 2022 2:45 pm  

রিজার্ভ ব্যাংক সুদ বাড়ালে বাজারে টাকার জোগান কমে, মূল‌্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আসে। আর, সুদ বাড়লে লগ্নি কমে, আর্থিক বৃদ্ধির হার শ্লথ হয়, বেকারত্ব বাড়ে। সুখবর, বাজারে মূল‌্যবৃদ্ধি সামান‌্য হলেও নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু বেকারত্ব বেড়েছে। রিজার্ভ ব্যাংকের আর্থিক নীতি কমিটির পরবর্তী ঋণনীতিমূলক সিদ্ধান্ত তাই হতে চলেছে প্রভাববিস্তারী। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী

রিজার্ভ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক নীতি কমিটির ডিসেম্বরের বৈঠক শুরু হয়েছে। বুধবার এই বৈঠকের ফল ঘোষণা হয়। বাড়ানো হয় রেপো রেট। আর্থিক নীতি কমিটির গত কয়েকটি বৈঠকে চড়া হারে ব্যাংকর সুদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রণীত হয়েছে। এবার রিজার্ভ ব‌্যাঙ্ক সুদ বৃদ্ধির হার কমাবে বলে অনুমান করা হলেও তা হয়নি। এই অনুমানের পিছনে একাধিক কারণ ছিল। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে-কারণটির কথা বলা হচ্ছে, তা হল, বাজারে মূল‌্যবৃদ্ধি সামান‌্য হলেও নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অন‌‌্যদিকে, বেকারত্ব আগের তুলনায় বেড়েছে। রিজার্ভ ব্যাংক যখন সুদ বাড়ায়, তখন বাজারে তার দু’টি অভিঘাত তৈরি হয়। একদিকে, সুদ বাড়লে বাজারে টাকার জোগান কমে এবং মূল‌্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আসে। অন‌্যদিকে, সুদ বাড়লে লগ্নি কমে, ফলে আর্থিক বৃদ্ধির হার শ্লথ হয়। আর্থিক বৃদ্ধির হার শ্লথ হলে বেকারত্ব বাড়ে।

Advertisement

একইসঙ্গে মূল‌্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব বৃদ্ধি- এই দুই সংকটকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে রিজার্ভ ব্যাংকে। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মত হল, যেহেতু মূল‌্যবৃদ্ধি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে, তাই এই মুহূর্তে রিজার্ভ ব্যাংকের অনেক বেশি নজর দেওয়া উচিত বেকারত্ব কমানোর দিকে। বেকারত্ব কমাতে গেলে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়াতে হবে। যার জন‌্য বেসরকারি লগ্নিকে উৎসাহ দিতে হবে। সেটা করতে গেলে সুদের হার আর বেশি বাড়ানো যাবে না। কয়েকদিন আগেই বেকারত্ব নিয়ে ‘সিএমআইই’-এর তথ‌্য প্রকাশ পেয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে, দেশে বেকারত্বের হার নভেম্বরে বেড়ে হয়েছে ৮ শতাংশ। অক্টেবরে যা ছিল ৭.৭৭ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে যা ছিল
৬.৪৩ শতাংশ। দেশে কয়েক বছর ধরেই বেকারত্ব এক ভয়াবহ জায়গায় রয়েছে। তার উপরে যদি এখন প্রতি মাসে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাহলে এর চেয়ে উদ্বেগের আর কিছু হতে পারে না। বেকারত্ব বেশি থাকলে কখনওই বাজারে ভোগ‌্যপণ্যের চাহিদা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যেতে পারবে না। ফলে অর্থনীতির হালও ফিরবে না।

[আরও পড়ুন: ব্যানার-লিখনে অশনি সংকেত, কক্ষচ্যুতির পথে জিনপিং]

অর্থনীতির উপর থেকে কোভিডের ছায়া ক্রমশ দূর হচ্ছে বলে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সবসময় দাবি জানানো হয়। কিন্তু গত ৩০ নভেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা ‘ন‌্যাশনাল স্ট‌্যাটিস্টিক‌্যাল অফিস’ তথা ‘এনএসও’ ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের যে-তথ‌্য প্রকাশ করেছে, সেখানে ধরা পড়েছে এখনও অর্থনীতির উপর লকডাউনের ছায়া কতটা দীর্ঘ। এই ত্রৈমাসিকে দেখা গিয়েছে উৎপাদন শিল্পে সংকোচন ঘটেছে গত অর্থবর্ষে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের তুলনায় ৪.৩ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০২১ সালে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে উৎপাদন ক্ষেত্রে যে আয় হয়েছে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে তার চেয়ে আয় ৪.৩ শতাংশ কম। অর্থাৎ, একবছরের ব‌্যবধানে শিল্পপণে‌্যর উৎপাদন বাড়েনি, বরং কমেছে। এটা অবশ‌্যই ইঙ্গিত দেয় দেশে আরও কিছু কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার।

গাড়ি বিক্রি নভেম্বরে ৩১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে দু’-হাত তুলে নাচছে। কিন্তু গাড়ি বিক্রি বাড়া-ই অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সূচক নয়। নিয়েলসনের সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে গ্রামীণ ক্ষেত্রে উপভোক্তাদের ব‌্যয় ৩.৬ শতাংশ কমেছে গত বছরের এই সময়ের তুলনায়। প্রথম ত্রৈমাসিকে অর্থাৎ, এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে এই হ্রাসের হার ছিল ২.৪ শতাংশ। গ্রামের মানুষ যদি শিল্পপণে‌্যর চাহিদা কমাতে থাকে, তাহলে কোনওভাবেই উৎপাদনক্ষেত্রের বিকাশ সম্ভব নয়। আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামে থাকে। ফলে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে গ্রামীণ মানুষের পণ্যের চাহিদা বাড়াতে হবে। গাড়ি বিক্রির বৃদ্ধি সূচিত করে শহরের বিত্তবান মানুষের আয় বৃদ্ধিকে। শহরের বিত্তবানরা যেসব পণ্যের চাহিদা তৈরি করে, সেগুলি মূলত মূলধন নিবিড় ও আমদানি নিবিড় শিল্পজাত। যেমন গাড়ি উৎপাদনই যদি আমরা ধরি, তাহলে দেখা যাবে এই শিল্প মূলত মূলধন নিবিড়। বর্তমানে গাড়ি কারখানায় উন্নত মানের রোবটিক প্রযুক্তির ব‌্যবহার হয়। এই ধরনের কারখানায় শ্রমিকের চাহিদা অত‌্যন্ত কম। দামি যন্ত্রপাতি মানুষের কাজ করে দেয়। আধুনিক গাড়ি কারখানার অধিকাংশ যন্ত্রাংশও বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। ফলে গাড়ির মতো পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি হলে দেশে বিশাল কর্মসংস্থান তৈরি হয় না। বরং গ্রামীণ মানুষ জামাকাপড় থেকে শুরু করে ঘর-গেরস্থালির যেসব শিল্পপণ্যের চাহিদা তৈরি করে, তা উৎপাদিত হয় শ্রমনিবিড় ক্ষেত্রে। দেশে একটা কাপড়ের কল বা সাইকেল কারখানা তৈরি হলে তাতে অনেক বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। সেই কারণে গ্রামের মানুষ ও শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমে যাওয়া আমাদের অর্থনীতির পক্ষে সবসময় উদ্বেগজনক। কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা ‘এনএসও’-র সাম্প্রতিক তথ্যেও সেই উদ্বেগের চেহারাই স্পষ্ট হয়েছে।

বর্তমান অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের ফলে দেখা যাচ্ছে, পরিষেবা ক্ষেত্রেও গত একবছরে উল্লেখযোগ‌্য অগ্রগতি ঘটেনি। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে পরিষেবা ক্ষেত্রের মধে‌্য ব‌্যবসা-বাণিজ‌্য, হোটেল, পরিবহণ এবং যোগাযোগ ক্ষেত্রে আয় বৃদ্ধি ঘটেছে ১৪.৭ শতাংশ। এই ক্ষেত্রটি সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছিল লকডাউনের সময়। দেশের মোট উৎপাদনে এই ক্ষেত্রের অবদান এখন ২০ শতাংশ। ছোট ব‌্যবসা-বাণিজ‌্য, হোটেল, পরিবহণ ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানও এখন দেশে সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক ত্রৈমাসিকে দেখা যাচ্ছে, এই ক্ষেত্রে আয় হয়েছে ৬.৪৯ লক্ষ কোটি টাকা। কোভিড অতিমারী শুরুর আগের অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে এই আয় ছিল ৬.৪ লক্ষ কোটি টাকা। লকডাউনে যা নেমে যায় ৫ লক্ষ কোটি টাকায়। অর্থাৎ, টাকার অঙ্কে কোভিড অতিমারীর আগের পরিস্থিতিতে পৌঁছলেও গত তিন বছরে এই ক্ষেত্রে মোট ব‌্যবসা বাড়ানো সম্ভব হয়নি। কারণ, তিন বছরে যে-মূল‌্যবৃদ্ধি ঘটেছে, তা বাদ দিতে হবে।

কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে দাবি করা হচ্ছে, বিমানযাত্রীর সংখ‌্যা বর্তমানে কোভিড পরিস্থিতির আগের জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। তা যদিও সামগ্রিকভাবে বাণিজ‌্য, হোটেল, পরিবহণ ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে লক্ষ করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি, তা হল- লকডাউনের সময় এই পরিবহণ, হোটেল ও ছোট ব‌্যবসা-বাণিজ‌্যর ক্ষেত্রে বহু সংস্থা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যেসব সংস্থা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তাদের কর্মীরা এখনও কাজে ফেরেনি। বর্তমান বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের হিসাব বলছে, এখনও কোভিডের আগের পরিস্থিতিতে যেতে এই ক্ষেত্রকে বহু পথ হাঁটতে হবে। একমাত্র কৃষির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কিছুটা উজ্জ্বল। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকেও উৎপাদন বেড়েছে ৪.৬ শতাংশ। এবার পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশে বর্ষা কিছুটা দেরিতে এসেছে। ফলে মনে করা হয়েছিল, খারিফ মরশুমে উৎপাদন কমবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তা ঘটেনি। পশুপালন, মৎস‌্যচাষ ইত‌্যাদি খাদ‌্যশস‌্য উৎপাদনের ঘাটতি অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। কৃষিতে সামগ্রিক উৎপাদন বাড়লেও তার প্রতিফলন গ্রামীণ ক্ষেত্রের ভোগব‌‌্যয়ে পড়ছে না। এর কারণ, লকডাউনে বহু ছোটখাটো ব‌্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং গ্রামে বেকারত্ব বৃদ্ধি। গোটা দেশে উপভোক্তাদের ‌ব‌্যয় দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ২২.৩ লক্ষ কোটি টাকা। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় ৯.৬ শতাংশ বেড়েছে। মূল‌্যবৃদ্ধিকে হিসাবে রাখলে এটা একই জায়গায় রয়েছে। কিন্তু সরকারি ব‌্যয় গত বছরের তুলনায় দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ৪.৫ শতাংশ কমেছে। এই ত্রৈমাসিকে সরকারি ব‌্যয় ৩.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা। রাজ‌্য সরকারগুলির আর্থিক অবস্থা খারাপ বলেই ব‌্যয় কমেছে। নভেম্বরে জিএসটি আদায় ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের খরচ আগামী দু’টি ত্রৈমাসিকে বাড়বে বলে আশা। আমদানির খরচ দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ১২ লক্ষ কোটি। রফতানি তার ধারেকাছে নয়। দেশে বিদেশি ব্র‌্যান্ডের ছড়াছড়ি। বিদেশের বাজারে ভারতীয় ব্র‌্যান্ডের দাপটের কোনও লক্ষণ নেই। সুপার ফ্লপ মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলাটা একটি ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছু নয়। ‘এনএসও’-র তথ‌্য সেই কথাই স্পষ্ট করে বলছে।

সরকারি ব‌্যয় এবং বেসরকারি লগ্নি বাড়িয়ে আর্থিক বৃদ্ধির দিকে এবং কর্মসংস্থানের দিকে নজর না-দিলে পরিস্থিতি বদলের কোনও সম্ভাবনা নেই। রিজার্ভ ব‌্যাঙ্কের আগামী ঋণনীতি কোন দিকে নজর দেয়, এখন সেটাই দেখার।

[আরও পড়ুন: বৃহত্তম গণতন্ত্র পরিচালনার চাবিকাঠি এই সংবিধান কি আইনি নথি মাত্র?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement