‘প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট’-এর আহ্বানে, ঋতুপর্ণ ঘোষ স্মারক বক্তৃতা দিতে কলকাতায় এসেছিলেন ‘ম্যাগসাইসাই’-জয়ী সাংবাদিক রবীশ কুমার। অনুষ্ঠানের আগে মধ্য কলকাতার হোটেলে তাঁকে পাওয়া গেল। এ শহরেই তাঁর শ্বশুরবাড়ি। সেলফির অনুরোধ এল যত, কাউকেই ফেরালেন না। ডেকার্স লেনে চা খেতে খেতে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন: প্রতিনিয়ত কথা বলে যেতে হবে। সবাই মিলে প্রশ্ন করুন, আরও প্রশ্ন করুন। তাঁর কথা শুনলেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায় ও তিতাস রায়বর্মন।
– বলা হচ্ছে, বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতার মান ‘পড়ে’ গিয়েছে। সাধারণ মানুষের বিশ্বাসই নাকি উঠে গিয়েছে মিডিয়ার উপর থেকে। সাংবাদিকদের কি তাহলে ‘মধ্যস্থতাকারী’ বলবেন?
রবীশ কুমার: তা নয়তো কী! এখন মিথ্যের জয়জয়কার। সচ কি তারহা ঝুট কো ফ্যায়লা দিয়া হ্যায়। মিথ্যেকেই আমরা সর্বতোভাবে স্বীকার করে নিয়েছি। ফলে, সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত অনেকই হয়তো আর ততটা ‘সাংবাদিক’ নন। অনেকেই প্রতিষ্ঠানের বেতনভোগী চাকুরে। আমি মনে করি, মিডিয়াও আর জনমুখী নেই। রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব এক জিনিস, কিন্তু দলীয় কর্মীর মতো যদি সাংবাদিকরা কাজ করতে শুরু করেন, তাহলে অন্য জিনিস হয়ে দাঁড়ায়।
– আপনার কি মনে হয়, ডিজিটাল মিডিয়া আসার পর আমরা বাস্তব থেকে দূরে চলে গিয়েছি?
রবীশ কুমার: এখন আমাদের হাতের কাছে নানা ধরনের প্ল্যাটফর্ম। ‘ডিজিটাল মিডিয়া’ বলে আলাদা করে কিছু দেখছি না। মূলধারার মিডিয়াই এখন কম্প্রোমাইজড। আমি তো বলি, খবরের কাগজ পড়াই উচিত নয় আর, কারণ যেখানে গ্রাউন্ড রিপোর্টিং-ই হয় না, সেখানে খবরকে ‘বিশ্বাস’ করবই বা কেন? তাছাড়া, সংবাদের মাধ্যম বাড়লেও তথ্য পরিবেশিত হয় না, বরং বিভিন্ন ধরনের ‘ন্যারেটিভ’ সামনে আনা হয়। যেটি ‘ন্যাশনাল সিলেবাস’, ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি’-র উদ্যোগে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এমনকী, আমাদের যাবতীয় তর্ক-বিতর্কও এই তৈরি করা ‘ন্যারেটিভ’ ঘিরেই জন্মাচ্ছে।
-তাহলে সত্যিটা জানব কী করে? প্রকৃত ন্যারেটিভে কেউ আর বিশ্বাসও করে না। লিঞ্চিংয়ের ভিডিওতে ‘ভিউ’ বেশি, ‘শেয়ারিং’-ও বেশি।
রবীশ কুমার: আসলে আমরা সবাই কম-বেশি সাম্প্রদায়িক। ‘সেকুলার’ হওয়া মানে সভ্য হওয়া। কিন্তু সভ্য হওয়ার প্রক্রিয়াটা আমাদের জানা নেই। সেকুলারিজম মানে শুধুই সব ধর্মের আদর করা নয়, আরও অনেক বেশি কিছু, যেটা আমরা কেউ-ই আত্মস্থ করি না। সেই শিক্ষা আমাদের নেই। লোকে পাস করছে গাইড বুক পড়ে, হোয়াটসঅ্যাপের প্যাটার্নও তাই, টেলিভিশনের বিষয়বস্তু-ও তাই, কালার কম্বিনেশনও তাই-ই। যা দেখতে-শুনতে চাই, তাই-ই আমাদের গিলিয়ে দেওয়া হয়। খুব কম সময়ের মধ্যে এই গিলিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াকরণটা সম্ভব হয়েছে। আমাদের মধ্যে যে নানা ধরনের অসাম্য কাজ করে – লিঙ্গবৈষম্য, বর্ণবৈষম্য, সেটাকেই ব্যবহার করা হয়। ঋতুপর্ণ ঘোষ নিজের কাজের মধ্য দিয়ে ‘জেন্ডার ইস্যু’-কে বারবার তুলে ধরেছেন। সেই সূত্র ধরেই তো আমার কলকাতায় এই স্মারক বক্তৃতা দিতে আসা।
– আজ প্রায় তিন মাস হয়ে গেল কাশ্মীর সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য আমাদের সামনে আসছে না। কী বলবেন?
রবীশ কুমার: কাশ্মীরের প্রসঙ্গে অনেক সাংবাদিকই চুপ থাকবেন, কারণ তাঁরা মন্ত্রালয়ের সচিব! আর সাধারণ মানুষ, যাঁরা এই প্রসঙ্গে চুপ, তাঁদেরও একইভাবে ডিটেন করা হবে, তবে অন্য পদ্ধতিতে। যেমন বিএসএনএলের পৌনে দু’লাখ কর্মী, যাঁদের চাকরি চলে গেল। এরপরেও যদি এঁদের জিজ্ঞেস করা হয় কাশ্মীর প্রসঙ্গে, এঁরা কিন্তু কাশ্মীরিদের পক্ষ নেবেন না। কাশ্মীর ইস্যুটা আসলে ইউপি-বিহারের ভোট পেতে তৈরি করা হয়েছে। কাশ্মীরে মাত্র ছ’টা লোকসভা আসন। এবং হিন্দি বলয়ে ১২০। তাই সেখানকার মানুষের ভিতরের সাম্প্রদায়িকতা উসকে ১২০টা আসন পেতে, ‘হিন্দি হার্টল্যান্ড’-এর রাজনীতিকে কাজে লাগাতেই এই ইস্যু।
– এই মুহূর্তের সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় ‘এনআরসি’। আপনার কী মনে হয়, আগামী দিনে এর প্রভাব কীভাবে পড়বে?
রবীশ কুমার: উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন। ওখানকার হিন্দু-মুসলিম বা আদিবাসীদের কী সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, আমরা জানি না। কিন্তু যেদিন বাংলা-বিহার-ইউপি’তে এই প্রক্রিয়া শুরু হবে, সেদিন মানুষ প্যানিক করতে শুরু করবে। ইতিমধ্যেই প্যানিক করা শুরুও হয়ে গিয়েছে। গরিব মানুষরা আধার কার্ড বানাতে মরিয়া। আমাদের দেশে অধিকাংশই গরিব এবং তাঁদের বাসস্থানের স্থায়ী ঠিকানা নেই। যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই পায়, সেখানে থাকেন, আজকে তুলে দিল তো অন্য জায়গায় বাড়ি বানালেন। বন্যা হল তো অন্যত্র বাসা বাঁধলেন। এইভাবেই দেশের লাখ লাখ মানুষের বসবাস। দিল্লির কলোনিতেও ৭০ শতাংশ মানুষ অবৈধভাবে রয়েছেন। কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই তো নাগরিক! এনআরসি-তে সংখ্যাগুরুর অনেক বেশি ক্ষতি। এবং এনআরসি দিয়েই সাম্প্রদায়িকতার বীজটা চিরস্থায়ী হয়ে যাবে। প্রত্যেকবার এমন কিছু ইস্যু তৈরি করা হবে, যাতে মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। নিরাপত্তাহীনতায় মানুষ যুক্তি ভুলে যায়, কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সমাজ যত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে, মহিলারা তত পিছনে চলে যাবেন এবং রাজনৈতিক দলগুলো তাতে লাভবান হবে। কারণ, মেয়েরা রাজনৈতিক পরিসরে একটু একটু করে এগোচ্ছিলেন। তাঁদের স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন মতবাদ, স্পিরিটকে মেরে ফেলা হল। এই সময়ে দাঁড়িয়ে বদল আনতে গেলে যে বিপ্লব দরকার, সেটা সম্ভব নয়, কারণ আমাদের সমাজ খুব অনৈতিক। শুধু তাই নয়, মানুষের ভাবনার মধ্যেও একটা পরিবর্তন হয়েছে। আমরা মনে করি, আমরা গণতন্ত্রের পরিসরে আছি, আসলে তা নয়। রাজনৈতিক পরিসরে যে শুধু গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে, এমনটা নয়, মানুষের মধ্যেই গণতন্ত্রের পতন হয়েছে। আমি প্রায়ই বলে থাকি – ইয়ে জো নয়ি জনতা হ্যায়, জনতা হি নহি হ্যায়।
– আপনার মতে এর সুরাহা কী?
রবীশ কুমার: আমাদের কাছে সঠিক তথ্য এসে না পৌঁছলে কাজটা করা সত্যিই খুব মুশকিল। সমাজে যা চলছে, সাধারণ মানুষকে তা বুঝিয়ে বলার লোক প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে সঠিক তথ্য যাঁদের কাছে রয়েছে, শিক্ষা যাঁদের কাছে পৌঁছেছে, তাঁদের উদ্যোগী হতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে দিতে হবে। আমি রেজাল্টের পিছনে দৌড়চ্ছি না। আমাদের শুধু ক্রমাগত কাজ করে যেতে হবে। প্রতিনিয়ত কথা বলে যেতে হবে। কারণ যে অপরিসীম ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, সেটা ঠিক করতে ৩০-৪০ বছর লেগে যাবে। তাই সবাই মিলে শুধু প্রশ্ন করুন, করতেই থাকুন।
(চলবে)
(প্রকাশিত মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.