কাশী বিশ্বনাথ দর্শনের সুবিধার জন্য এক বিরাট রোপওয়ে তৈরি হবে। এই রোপওয়েটি যাবে সেখানকার রামকৃষ্ণ মিশনের উপর দিয়ে। এপ্রিল থেকে প্রকল্প চালু করতে শুরু হবে জমি অধিগ্রহণ। সক্রিয় হবে বুলডোজার। তাহলে কি ভাঙা পড়বে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান? বাতাসে আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
বারাণসীর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের যাত্রা শুরু ১৯০০ সালে। তিন যুবক- চারুচন্দ্র দাস, যামিনীরঞ্জন মজুমদার আর কেদারনাথ মৌলিক গরিব মানুষের ত্রাণের জন্য একটি ছোট্ট সংস্থা তৈরি করলেন। ওঁদের পুঁজি ছিল মাত্র চার আনা পয়সা। স্বামী বিবেকানন্দ দেহ রাখেন ১৯০২ সালের ৪ জুলাই। আর, তার ঠিক আগে, ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি আসেন বারাণসীতে। ততদিনে, ১৯০১ সালে, প্রথমে জঙ্গমবাড়ি, তারপর রামাপুরায় দুঃস্থ, গরিব মানুষের জন্য একটি ডিসপেনসারি চালু করেন ওই যুবক-ত্রয়ী। স্বামীজি খুব খুশি হন এবং প্রতিষ্ঠানের নাম দেন ‘শ্রীরামকৃষ্ণ হোম অফ সার্ভিস (সেবাশ্রম)’।
কাজেই বারাণসী আশ্রমের জন্ম স্বামীজির জীবদ্দশাতেই। এরপর, ১৯০৬ সালে স্বামী ব্রহ্মানন্দ, মঠ ও মিশনের প্রথম অধ্যক্ষ, আশ্রমের শিলান্যাস করেন। জমি কেনা হয়। মন্দির গড়ে ওঠে। ১৯১২ সালের ৮ নভেম্বর সারদা মা আসেন এই আশ্রমে। সঙ্গে আসেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী তুরীয়ানন্দ এবং স্বামী শিবানন্দ মহারাজ। আশ্রমের কাছেই, বাগবাজারের দত্তদের লক্ষ্মী নিবাসে মা থাকতেন আর রোজ আসতেন আশ্রমে ঠাকুরের পুজোয়। স্বামীজি চারুবাবু ও কেদারবাবাকে সন্ন্যাস দেন, তাঁরা হন স্বামী শুভানন্দ ও স্বামী অচলানন্দ।
এই আশ্রমের ভিতর গঙ্গামাটি দিয়ে নির্মিত একটি একতলা বাড়িতে থাকতেন স্বামী তুরীয়ানন্দ। এখানেই একটি ঘরে তাঁর দেহাবসান হয়। পাশে আর-একটি ঘরে থাকতেন রাখাল মহারাজ (ব্রহ্মানন্দ)। এই সেবাশ্রমকে মা নিজে একটি দশ টাকার নোট দান করেন। মাস্টারমশাই সেদিন এখানে ছিলেন। তিনি এখানে ভিজিটর’স বুকে লিখে গিয়েছেন, এই টাকা দেওয়ার কথা। তিনি জানান, ‘এখানে ঠাকুর বাস করছেন। আমারও ইচ্ছে করছে এখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যাই।’ ঠাকুর-মা-স্বামীজির বিপুল ভক্তসমাজের কাছে তাই কাশীর এই আশ্রমের তাৎপর্যই আলাদা।
এবার কাশীতে এসে দেখছি- এই আশ্রম কেন্দ্র করে স্থানীয় সাধারণ মানুষ এবং ভক্তসমাজে এক বিশেষ উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। কী সেই উদ্বেগ? মনে হচ্ছে, বিষয়টি আপনাদের বিশদে জানা প্রয়োজন। স্থানীয় হিন্দি সংবাদপত্র, যেমন ‘দৈনিক জাগরণ’-এ খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, কাশী বিশ্বনাথ দর্শনের সুবিধার জন্য এক বিরাট রোপওয়ে তৈরি হবে। এ এক ‘মেগা প্রোজেক্ট’। বেনারস খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লোকসভা কেন্দ্র। বাবা বিশ্বনাথের মন্দির অবধি খোলনলচে বদলে গিয়েছে। এবার তৈরি হতে চলেছে রোপওয়ে।
এই রোপওয়েতে ভক্ত ও দেশ-বিদেশের পর্যটকরা যাবেন মন্দিরে, বাবার দর্শনে। কাশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রথযাত্রা স্টপ, তারপর রোপওয়ে স্টেশন হবে বেনারস রেল স্টেশন, গোদোলিয়া-গির্জাঘর। তা বেশ! এ এক অভিনব উদে্যাগ। কিন্তু এই রোপওয়েটি যাবে রামকৃষ্ণ মিশনের উপর দিয়ে। আর সেজন্য লাক্সা রোড, অর্থাৎ আশ্রম-সংলগ্ন জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। আশ্রমের পাঁচিল ভেঙে ভিতরের বেশ কিছু এলাকা অধিগ্রহণ করা হবে এবং তা করতে গেলে সেই গঙ্গামাটি-নির্মিত ঐতিহাসিক বাড়িটি ভাঙা পড়তে পারে!
এই রোপওয়ে নির্মাণ করছে যে প্রাইভেট সংস্থা, তার টেকনিক্যাল টিমের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুসারে ওই বাড়িটি, যেটিতে স্বামী তুরীয়ানন্দ দেহ রেখেছেন- তা-ও ভাঙতে হবে। নিঃসন্দেহে, তা হবে এক মর্মান্তিক ঘটনা। মঠ কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষস্তরে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নিজে রামকৃষ্ণ মিশনের তাৎপর্য কতটা বোঝেন, জানি না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজে রামকৃষ্ণ মিশনের কাজকর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। বহু বছর আগে, যখন তিনি একজন আরএসএস প্রচারক মাত্র, তখন বেশ কয়েক বছর রাজকোট আশ্রমে থেকেছেন। তখনকার অধ্যক্ষ স্বামী আত্মস্থানন্দ রাজকোট আশ্রমের সচিব ছিলেন। নরেন্দ্র মোদি তখন সন্ন্যাস পর্যন্ত নিতে চান। কিন্তু তৎকালীন বেলুড় মঠের অধ্যক্ষ রাজি হননি। তিনি তাঁকে বলেছিলেন- মোদি রাজযোগী, দেশের জন্য তাঁকে অনেক কাজ করতে হবে।
বিজেপি ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে আমি রামকৃষ্ণ মিশনকে কোনওভাবেই যুক্ত করতে রাজি নই। কিন্তু আকস্মিক এই রোপওয়ে নামক মেগা প্রোজেক্টটি যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা জানি না। মঠ-কে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, চেষ্টা করা হবে, যাতে ওই বাড়িটি না ভেঙে রোপওয়ের টাওয়ার নির্মাণ সম্ভব হয়।
আসলে লাক্সা রোডটিও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের কাছেই আছে এক বিশাল গুরুদ্বার। তারপর আছে অ্যানি বেসান্তের তৈরি ‘থিওজফিক্যাল সোসাইটি’-র বাড়ি ও তাদের পরিচালিত মেয়েদের কলেজ। এই রোপওয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর উপরও আঘাত হানতে পারে। আমাকে স্থানীয় এক প্রবীণ সাংবাদিক জানালেন যে, মার্চ মাসে নরেন্দ্র মোদি বারাণসীতে আসছেন। এপ্রিল থেকে এই প্রকল্প চালু করার জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়ে যাবে। সক্রিয় হবে বুলডোজার। তবে প্রধানমন্ত্রী নাকি রামকৃষ্ণ মিশনের বিষয়টি সম্পর্কে সংবেদনশীল। তিনি পুরো প্রকল্পটি খতিয়ে দেখবেন।
সংবাদপত্রে খবরটি প্রকাশিত, তাই রাস্তার দু’-ধারের দোকান-বাড়ির মানুষজন আতঙ্কিত। অনেকে এখানকার পুরনো বাড়ি-হাভেলি বিক্রি করতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। অনেকে বলছেন, রামকৃষ্ণ মিশনের উপর দিয়ে রোপওয়ে গেলে নিচে আশ্রমের নির্জনতা, আধ্যাত্মিক পরিবেশ নষ্ট হবে না তো? শব্দদূষণ হবে কি? আশা করা যায়, উপর থেকে নিচে ময়লা ফেলার সবরকম সম্ভাবনা বন্ধ রাখা হবে। আশা করা যায়, জমি অধিগ্রহণ হলে সরকার বাহাদুর আশ্রমকে তার জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার যথোচিত ব্যবস্থা করবে। কিন্তু তা কি যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ?
রামকৃষ্ণ মিশনের এক সাধুর ভাষায়, ‘ঠাকুরের আশীর্বাদ নিয়ে এই প্রতিষ্ঠান কত ঝড়-ঝঞ্ঝা অতিক্রম করে, ১২৫ বছর পার করে দিল। এই যে নতুন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ঠাকুরই তাঁর সন্তানদের রক্ষা করার ব্যবস্থা করবেন।’
কাশীর এই আশ্রম অভিনব। একদিকে অদ্বৈত আশ্রমের মন্দিরে অদ্বৈত-সাধনা। অন্যদিকে জনপ্রিয় হাসপাতাল ‘হোম অফ সার্ভিস’। আশ্রমের মধ্যে আছে প্রতিষ্ঠাতা চারুবাবুর এক আবক্ষ মূর্তি। সেদিনের সেই চার আনার পুঁজি নিয়ে যে আর্তের সেবা শুরু, এখন তাই ২৩০টি বিছানার এক ইন্ডোর হাসপাতাল। ১৩ একর জমির উপর গড়ে উঠেছে নানা ধরনের সেবামূলক কাজের পরিকাঠামো। কাছেই আছে সারদা মঠ।
কাশী ভারতের অন্যতম প্রাচীন প্রসিদ্ধ আধ্যাত্মিক শহর। কিন্তু এটাও আমার বলতে দ্বিধা নেই, এই শহরে কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাতিভেদের রাজনীতিতে দীর্ণ উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ-আধিপত্যের সামন্তবাদ বড় উচ্চকিত। এক্ষেত্রে রামকৃষ্ণ মিশন-ই এক শক্তিশালী সংগঠন- যেখানে ঠাকুরের জন্মতিথিতেও দেখলাম, দলমত-নির্বিশেষে সব জাত, সব ধর্মের মানুষ এসে আশ্রমে ঠাকুরের ভোগপ্রসাদ গ্রহণ করলেন।
ঠাকুর-মা-স্বামীজির ভাবাদর্শ এক মহান সমন্বয়ের ধর্ম। শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত- নানা মার্গের মিলন-ভূমি। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, উত্তরপ্রদেশে কোনও রাজনৈতিক দল আয়োজিত ধর্মীয় সম্মেলনেও রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুদের মঞ্চে উপবিষ্ট হতে দেখা যায় না। তাঁরা রাজনীতি-নিরপেক্ষভাবে এখানে গরিব মানুষের সেবা করে চলেছেন, বেনারস, এলাহাবাদ, লখনউ-সহ এ-রাজ্যে, ও হিন্দি বলয়ের নানা প্রান্তে।
রামকৃষ্ণ মিশনের এহেন ভাবাদর্শের শক্তিতে পৃথিবীজুড়ে ২৫০টি শাখা সক্রিয়। কত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, কত স্বাস্থ্য-পরিষেবা, কত গ্রামীণ উন্নয়ন! আর এসবের মধ্যে হঠাৎই কাশীর এই আশ্রমে অশনি সংকেত। আসলে আমাদের দেশে উন্নয়ন, নগরায়ন, আধুনিকতার সঙ্গে অনেক সময়ই সংঘাত বেঁধে যায় চলতি সাবেক ব্যবস্থার। কাশীকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করতে এখন নানা প্রকল্প গৃহীত। তাতে দোষ নেই। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে আরও অনেক ঘোষণা, আরও অনেক বাস্তবায়ন ঘটতে পারে। তবু এখানে এসে মনে হচ্ছে, বহু প্রকল্প ‘বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া’-র শিকার না হয়ে যায়! বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে যাওয়ার জন্য এই রোপওয়ে ঠিক কতজন ব্যবহার করবেন- তা নিয়েও নানা মুনির নানা মত। এই সাফল্য-ব্যর্থতার শেষ কথা ভবিষ্যতের গর্ভেই নিহিত। রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমটা বাঁচুক- আপাতত এটুকুই প্রার্থনা।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.