রাজদ্বীপ সরদেশাই: ‘মিনিস্টার লোগ মেরে পিছে অউর পুলিশ লোগ মেরে জেব ম্যায় রেহতে হ্যায়।’ (মন্ত্রীরা সব আমার পিছনে, আর পুলিশরা আমার পকেটে।)
হিন্দি সিনেমা মাঝেসাঝে এক অনন্য উপায়ে বাস্তব জীবনের থেকে এগিয়ে কথা বলে বইকি!
উপরের এই উক্তিটি ২০১১ সালের ব্লকবাস্টার হিট ‘সিংঘম’ সিনেমার সংলাপ। যে সিনেমায় এক খলনায়কের বিরুদ্ধে এক সৎ পুলিশ ইন্সপেক্টর বাজিরাও মাস্তানি। যে শেষমেশ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘আতা মাঝি সটকলি!’ (মারাঠি থেকে আলগাভাবে অনুবাদ করলে মানে দাঁড়ায় ‘আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে কিন্তু!’)
গত কয়েক দিন ধরে মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করলে যে কোনও সুচিন্তক নাগরিক তীব্র হতাশায় সিংঘমের স্মরণীয় এই ওয়ান-লাইনারের প্রতিধ্বনি করে উঠবেন, নিশ্চিত। সর্বোপরি, রাজনৈতিক এবং পুলিশ নেতৃত্ব- উভয়ই যখন মিথ্যা, ছলনা এবং সম্ভাব্য অপরাধের জালে জড়িয়ে পড়ে, তখন অবাক লাগে ভাবতে যে, আইন-নির্ধারক গোষ্ঠী এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনসেবার ধারণা সম্পূর্ণ ত্যাগ করে কী টাকাপয়সা লেনদেন এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ বিষয়ে একে-অপরের অংশীদার হয়ে উঠল!
মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল দেশমুখ এবং মুম্বইয়ের প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার পরমবীর সিংয়ের মধ্যে যে অভূতপূর্ব শব্দযুদ্ধ চলছে, তার আর কী ব্যাখ্যা হতে পারে? কমিশনার বদলি হয়ে যাওয়ার পরপরই হঠাৎ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আম্বানি বোমা বিস্ফোরণ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া একজন সহকারী পুলিশ ইন্সপেক্টর শচীন ওয়াজে-র কাছে প্রতি মাসে ১০০ কোটি টাকা ‘ঘুষ’ তোলার জোর চাপিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পরিবর্তে দাবি করেছেন যে, পুলিশ কমিশনার ওই একই মামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন, যেখানে মনসুখ হিরণ নামে একজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের মাঝে অসুবিধাজনক সত্যিটা হল: অতীতের ভূত তাড়া করছে। মহারাষ্ট্রের, সাহস করে বললে ভারতের রাজনীতিবিদ ও পুলিশের জোট সকলের সামনে আজ প্রকাশ্য।
কয়েক বছর আগে, মহারাষ্ট্রের এক প্রবীণ পুলিশ আধিকারিক সঞ্জয় পাণ্ডে অভিনেতা আমির খানের জনপ্রিয় ‘সত্যমেব জয়তে’ টিভি শোয়ে এসে একটি ‘সংগঠিত, প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্ত’-র ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, মুম্বইয়ের ডান্স বার ও রেস্তরাঁগুলোকে প্রতি মাসে স্থানীয় পুলিশ এবং তাদের ঊর্ধ্বতনদের নির্ধারিত টাকা বা ‘হপ্তা’ দিতে হত। অবিকল এই কথাটাই মুম্বইয়ের প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার পরমবীর সিং তাঁর চিঠিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল দেশমুখের বিরুদ্ধে মাসিক ১০০ কোটি টাকার ‘টার্গেট’ নির্ধারণ করার অভিযোগ তুলেছেন। পরমবীর সিং ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার পদে আসীন হন। মাত্র ১৩ মাসের মাথায় তঁাকে হোম গার্ড বিভাগে স্থানান্তরিত করলে তিনি বিবেকবান হয়ে এই সিদ্ধান্ত নেন যে, এই চক্রান্ত তিনি ফাঁস করবেন জনসাধারণের কাছে! গত বছরের বেশ কয়েকটি বড় তদন্তের সময় তাঁকে অযাচিতভাবে সমর্থন করার পর মন্ত্রীমশাইও এখন মনে করলেন মুম্বইয়ের প্রাক্তন শীর্ষ পুলিশের সততা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করার উপযুক্ত সময় এটাই।
ঠিক এই কারণেই দেশমুখ বা সিংয়ের কোনও কথারই মূল্য নেই। অনিল দেশমুখ পাঁচবারের বিধায়ক এবং পরমবীর সিং মহারাষ্ট্রের সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের একজন। উভয়ই তাঁদের কুকর্মের প্রভাব সম্পর্কে ‘অসচেতন’ বলে দাবি করতে পারেন না। আর এ-কারণেই মহারাষ্ট্রের অভিজাত শাসক গোষ্ঠীর আত্ম-ন্যায়নিষ্ঠতা ও ক্রোধের হেঁয়ালি-পর্বটি শেষ করার সময় এসেছে। যদি পুলিশ কমিশনার বদলি না হতেন, তবে সম্ভবত তিনি একটি শব্দও খরচ করতেন না। মনসুখ হিরেনের মৃতদেহ যদি থানে খাঁড়িতে না পাওয়া যেত, তবে সম্ভবত আম্বানি বোমা মামলাটির প্রাকৃতিক মৃত্যু ঘটত এবং শচীন ওয়াজে-র হাতেই সব ক্ষমতা থাকত। যদি মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফড়নবিসের হাতে গোপনীয় নথিগুলি না আসত, তবে শিবসেনার নেতৃত্বাধীন সরকার নির্লজ্জের মতো এই মিথ্যাচার চালিয়ে যেত।
এই পর্বের ভয়াবহতা থেকে উদ্ধব ঠাকরে বা শরদ পাওয়ার কেউই নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারবেন না। সর্বোপরি, শচীন ওয়াজে একসময় ‘এনকাউন্টার’ বিশেষজ্ঞ হিসাবে বিদিত ছিলেন, ভুয়া এনকাউন্টার মামলায় সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পরে শিবসেনায় যোগদান করেছিলেন। ২০২০ সালে যখন ‘মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাদি’ (এমভিএ) ক্ষমতায় এল, তখন তাঁকে পুনরায় দায়িত্বে আনার বাধ্যবাধকতা কী ছিল? যেখানে তাকে ‘ইউনিফর্ম পরিহিত শিবসৈনিক’ হিসাবে ব্যাপকভাবে দেখা হয়? এবং শরদ পাওয়ারের মতো একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ, যিনি প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে মহারাষ্ট্রের রাজনীতির চূড়ায় বসে অাছেন, তিনি কি দাবি করতে পারেন যে, তাঁর এনসিপি-র স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন না?
বিরোধী দলের নেতা হিসাবে ফড়নবিস যখন যুক্তিসংগতভাবেই মহারাষ্ট্র সরকারকে ব্যাকফুটে রাখার দাবি তুলছেন, তখন কিন্তু ভুলে যাবেন না যে, তিনিও শিবসেনার সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাঁচ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এই একই ‘ব্যবস্থা’ পরিচালনা করেছিলেন। কেউ কি সতি্যই বিশ্বাস করবে যে, রাজনীতিবিদ-পুলিশের এই জোট ২০১৯-এর নভেম্বরে এমভিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই প্রকাশিত হয়েছে? প্রকৃতপক্ষে, কোনও রাজ্য সরকার এই দাবি কি করতে পারে যে তারা ২০০৬ সালে প্রকাশ সিং মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশকৃত পুলিশ বাহিনী সংস্কার বাস্তবায়নের সত্যিকারের প্রচেষ্টা করেছিল? এই সংস্কারের মূলে রয়েছে পুলিশকে রাজনৈতিক চাপ থেকে পৃথক করে রাখা, তা সে ট্রান্সফার বিষয়েই হোক কি তদন্ত বিষয়ে। তা মনমোহন সিংয়ের ইউপিএ-র বছরগুলিতেই হোক বা আজকের মোদি সরকারের বছরে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক পুলিশ সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিতে পছন্দ করেনি।
কিন্তু কথা হল: যে হাত খাবার জোগায়, সে হাতকে কেনই বা কোনও সরকার পঙ্গু করতে যাবে? আসল ঘটনাটি হল, তা সে চঁাদাবাজির জালিয়াতি হোক বা লাভজনক ‘ট্রান্সফার পোস্টিং’-এর কারবার, ক্রমবর্ধমান দূষিত রাজনীতিবিদ-পুলিশ সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে নষ্ট করে দিয়েছে এবং সেইসঙ্গে ঠিক-ভুলের মধ্যের লাইন দীর্ঘকাল আগেই আবছা হয়ে গিয়েছে। এটি কেবল রাস্তার কনস্টেবল নয়, যারা রেহাই দেবে বলে ঘুষ চাইছে: এই শৃঙ্খলটি পুলিশ স্টেশনের হাউস অফিসার থেকে শুরু করে দুঃখজনকভাবে আইপিএস অফিসার এবং তাদের রাজনৈতিক আধিকারিক পর্যন্ত বিস্তৃত। এমনকী, প্রবীণ আইপিএস আধিকারিকদের বিরুদ্ধেও লাভজনক পোস্টের জন্য ‘লবি’ করার অভিযোগ রয়েছে। যা কিনা প্রমাণ করে, কতটা গভীরে ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার জন্য পুলিশ মহল আপস করেছে।
এই কারণেই মহারাষ্ট্রে এই কার্যকারণের নেপথ্যে যারা যারা আছে, তাদের কড়া শাস্তি হওয়া দরকার। দোষীদের খোঁজ হোক। রাজনৈতিক সংখ্যাতত্ত্বের বাইরে গিয়ে, দোষীদের শনাক্ত করতে যেভাবে প্রয়োজন সেভাবে তদন্ত হোক। দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। বিশ্বাসযোগ্য পুলিশ অফিসারদের রক্ষা করতে হলে এবং হ্যাঁ, খাঁটি রাজনীতিবিদদেরও চিনে নিতে হলে প্রতারণার শৃঙ্খলাটাকে ভেঙে ফেলতেই হবে। নয়তো প্রতিটি নাগরিক রাগে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করতে বাধ্য হবে: আতা মাঝি সটক্লি!
পুনশ্চ: মহারাষ্ট্রে যা সব কাণ্ডকারখানা চলছে, তা আরেকটু হলেই হাস্যকর হয়ে যেত, যদি না তার পরিণতি এত করুণ হত! (মনে রাখবেন, এই রাজ্যে এখন পর্যন্ত সর্বাধিক সংখ্যক সক্রিয় ‘কোভিড ১৯’ কেস রয়েছে, এবং বেশ কয়েকজন পুলিশ অতিমারীতে প্রাণ হারিয়েছেন)। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শরদ পওয়ারের পরামর্শটি। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, ৯২ বছর বয়সি প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার জুলিও রিবেইরোকে এই অভিযোগের তদন্ত করতে বলা। রিবেইরো সঠিকভাবে বিবেচনা করে জানিয়েছেন যে একটা তদন্তের মূল তদন্তকারী হিসাবে কাজ করার বয়স তিনি পেরিয়ে গিয়েছেন। তবে নব্বইয়ের কোঠার এক ব্যক্তিকে এই কাজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হিসাবে বিবেচনা করার মধ্য দিয়ে খোলসা হয়ে যায় ‘খাকি’ এবং ‘খাদি’ অর্থাৎ পুলিশ ও রাজনীতিকদের মধ্যেকার সংঘাত এই প্রজন্মে কী গভীরতর বিশ্বাসহীনতাই না তৈরি করেছে!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.