রাজদীপ সরদেশাই: গত হপ্তায় কৃষক সংগঠনগুলির ডাকা ভারত বন্ধ চলাকালীন নিয়তির পরিহাসের মতো যে-দৃশ্যকল্পটি উঠে এল, তা হল, কৃষকদের দাবির সমর্থনে সমাজকর্মী আন্না হাজারের একদিনব্যাপী অনশনের ছবি। মহারাষ্ট্রের রালেগাঁ সিদ্ধিতে তাঁর গ্রামে, হাতেগোনা কয়েকজন সমর্থকের সঙ্গে একটি ভিডিও-বার্তা রেকর্ড করেছেন তিনি, যা পাঠানো হয়েছে টিভি চ্যানেলগুলিতে। বেশিরভাগ চ্যানেলই তা এড়িয়ে গিয়েছে। সেই যে মাল্টি-ক্যাম কাঁধে একদল সাংবাদিক সত্তরোর্ধ্ব (তখন তাঁর যা বয়স ছিল) এই গান্ধীটুপি-পরিহিত নেতাকে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় অনুসরণ করছে, সংবাদপত্রের উত্তর সম্পাদকীয়তে তাঁকে রীতিমতো ‘আধুনিক যুগের মহাত্মা’ বলে দাবি করা হচ্ছে– সেসব দিন এখন কত দূরে! ভারতীয় রাজনীতির ‘আন্না মুহূর্ত’ বহুকাল আগে এসেছে, এবং চলেও গিয়েছে। প্রশ্ন হল, সেই মুহূর্তের প্রতিলিপি কি তৈরি করবে নতুন এক প্রতিবাদী গোষ্ঠী, যারা এখন প্রতিষ্ঠানবিরোধী রাজনীতির নিশান ওড়াচ্ছে? সোজাকথায়, ২০২০ সালের কৃষক বিক্ষোভ কি মোদি ২.০ সরকারের সঙ্গে তাই ঘটাতে চলেছে, যা ২০১১ সালে আন্নার দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন মনমোহন সিং সরকারের সঙ্গে ঘটিয়েছিল?
এ নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে না যে, আন্না হাজারের আন্দোলন ‘ইউপিএ ২’ সরকারের অবক্ষয় এবং পতনের অনুঘটক ছিল। এই আন্দোলন দুর্নীতির ইস্যুটিকে নিয়ে এসেছিল রাজনৈতিক মঞ্চের কেন্দ্রে। সরকারের বিরুদ্ধে জনমতকে দৃঢ়ভাবে দানা বাঁধতে সাহায্য করেছিল। শাসককে দুর্বল প্রতিপন্ন করেছিল, এবং নরেন্দ্র মোদির মতো নেতার জন্য রাস্তা পরিষ্কার করেছিল, যাতে তিনি নড়বড়ে কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন জোটের বিপ্রতীপে ‘শক্তিশালী’ বিকল্প হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে পারেন। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভারত’– এই স্লোগান তুলে একজোট করার যে প্রক্রিয়া চলেছিল, তা বাম-ডান সবদিকের বিশিষ্টজনদের এক মঞ্চে এনে দাঁড় করিয়েছিল। যেমন ধরুন, বাবা রামদেব ও শ্রীশ্রীরবিশংকরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধে মিলিয়েছিলেন যোগেন্দ্র যাদব বা প্রশান্ত ভূষণ। আবার, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো একজন ‘আরটিআই’ (রাইটস টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট) আন্দোলনকারী খোলাখুলি আরএসএস কর্মীদের সমর্থন পেয়েছিলেন। সবচেয়ে গুরুতর যা, তা হল, এর ফলে ‘সব নেতা চোর’-জাতীয় একটি জনাবেগ উসকে দেওয়া চিৎকারকে প্রশ্রয় দিতে বাধ্য হল শহুরে মধ্যবিত্ত। যা একটি পরিবর্তনের আবহকে গতি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট!
এবার আন্না-র এই আন্দোলনের বিপ্রতীপে কৃষকদের দাঁড় করান, যাঁরা রাজপথে নেমে এসেছেন। ২০১১-র আন্দোলনের সঙ্গে এর ফারাক হল, আন্না হাজারের মতো কোনও ব্যক্তিত্ব এক্ষেত্রে নেই, যাঁকে কৃষকদের মুখ হিসাবে তুলে ধরা যাবে। পরিবর্তে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি, তা হল, বিচিত্র কণ্ঠের সমাহার। মূলত যা উঠে আসছে কৃষক সংহতি থেকেই, কিন্তু একই সঙ্গে মিশে যাচ্ছে নানা বিরোধী গোষ্ঠীর স্বরের সঙ্গে, যাদের মোদি সরকারের বিরুদ্ধে অন্যতর নানা ক্ষোভ রয়েছে। তাঁদের সিংহভাগই পাঞ্জাবের, কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন উত্তর ভারতের অন্যান্য রাজ্যের প্রতিবাদীরাও। ২০১১-তে যদি লড়াইটা হয়ে থাকে আন্না গোষ্ঠী এবং মনমোহন সিং সরকারের মধ্যে, তাহলে এই লড়াইটা ‘বিরোধী শক্তি বনাম নরেন্দ্র মোদি’-র। আর এই লড়াইয়ে সর্বব্যাপী কৃষকরা। তাঁরা এই সংঘাতকে এক নৈতিক সমৃদ্ধি দিচ্ছেন।
কিন্তু একটি মূলগত ফারাক রয়ে যাচ্ছে। কৃষকদের দাবিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমর্থন করছে– এমন কোনও সাক্ষ্য এখনও পর্যন্ত নেই। আন্নার আন্দোলন চলাকালীন মধ্যবিত্ত শ্রেণি দুর্নীতিবিরোধী কথাবার্তার সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছিল। পরের পর আর্থিক কেলেঙ্কারি, টুজি থেকে শুরু করে কোল থেকে কমনওয়েলথ– এই সবকিছুই তীব্র গণবিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছিল। শাসক শ্রেণির প্রতি ক্রমবর্ধমান নাগরিক রোষ এবং বিচ্ছিন্নতাবোধের সঙ্গে প্রতিবাদের সেতুবন্ধন ঘটেছিল এর ফলে। এই সূত্রটি এখন অনুপস্থিত। ভারতের শহুরে মধ্যবিত্ত বোধহয় সবচেয়ে বেশি গলাবাজি করেছে খোলাবাজার অর্থনীতির সংস্কারের পক্ষে। একজন বেতনভুক কর্মচারীর যেমন নির্দিষ্ট ভাতা প্রয়োজন, তেমনই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে গেলে একজন কৃষকেরও একটি নিরাপত্তা-বলয় প্রয়োজন– এই সার কথাটুকু সুপারমার্কেট এবং আন্তর্জালে কেনাবেচার পণ্য-সাংস্কৃতিক ঘেরাটোপে থাকা মানুষের মাথায় ঢুকছে বলে মনে হয় না। আমাদের ‘অন্নদাতা’ বা কৃষকদের নিয়ে সেলুলয়েডের পর্দায় নানা রোমান্টিক আখ্যান রচিত হয় বটে, কিন্তু উচ্চমধ্যবিত্ত নাগরিক কল্পনায় একজন ‘কিষান’ কোনও বিশেষ উপযোগিতা বা নিরাপত্তা পাওয়ার যোগ্যই নন। ভেবে দেখুন না, খড়ের গাদা জ্বালালে দূষণ বাড়ে, এই মর্মে কৃষকদের দোষারোপ করা ও দণ্ড দেওয়া যত সহজ, পরিবেশে যানবাহনের ধোঁয়ার কী প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে আলোচনা করা ততটা নয়।
একটি গণ অভ্যুত্থানের জন্য এমন একজন শত্রুকে প্রয়োজন, যাকে চিহ্নিত করা সহজ। আন্না হাজারের আন্দোলনের ক্ষেত্রে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত– এই ভাবকল্পেই শত্রু চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। কৃষক আন্দোলন আরও ব্যাপ্ত। একটি নির্দিষ্ট আইন রদ করার দাবি কোনও তাৎক্ষণিক শত্রুপক্ষ নির্মাণ করে না। কৃষক নেতারা প্রয়াস নিয়েছেন ‘আদানি-আম্বানি’-র মতো কর্পোরেট পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে রাগ শানিয়ে তোলার। কিন্তু স্বজনপোষণের অভিযোগের অনুরণন কতটা প্রশস্ত হবে, তা অনিশ্চিত। যেমন ধরা যাক, এখন যারা বিরোধী দল, তাদের মধ্যে অনেকেই যখন সরকারে ছিল, তখন এসব ব্যবসায়ী-গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। ফলে, তাদের কর্পোরেট-বিরোধিতার আখ্যান খানিক ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া কিছুই নয়।
আন্না হাজারের আন্দোলনের সঙ্গে এই কৃষক বিদ্রোহের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। ২০১১ সালে মিডিয়া-ব্যবস্থা ছিল প্রতিবাদের সক্রিয় অংশীদার। সরকারবিরোধী আখ্যান নির্মাণেও যেমন তারা উঠেপড়ে লেগেছিল, তেমনই সক্রিয় ছিল তারা আন্না গোষ্ঠীর নেতাদের ‘জাতীয় নায়ক’-এ পরিণত করতে। এখন ভীরু এবং আপসকামী মূলধারার গণমাধ্যম সরকারি বয়ানের প্রতিস্পর্ধী হতে নারাজ। বরং নিয়ম করে বিরোধীদের কোণঠাসা করতে তারা বেশি তৎপর। বিভিন্ন মিডিয়ায় একদল মন্ত্রী যেভাবে কথা বলেই চলেছেন, তাতে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, পূর্বসূরিদের মতো করে মোদি সরকার প্রাইমটাইমের পরিসর বিরোধীদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সমর্পণ করে দেবে না।
নরেন্দ্র মোদি এবং মনমোহন সিংয়ের ব্যক্তিত্বের মধ্যেই হয়তো আদত তফাতটা লুকিয়ে। জোট রাজনীতির নানা জটিলতা, তাঁর বিনয়ী আধা-আমলা আধা-রাজনীতিক ইমেজের জন্য মনমোহন সিং দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। অন্যদিকে, একটি সংখ্যাগুরু সরকারের চালক হিসাবে কঠোরভাষী, কর্তৃত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি বিরোধিতা বিশেষ সহ্য করতে পারেন না। মনমোহন সিং যেখানে কদাচিৎ অহং আঁকড়ে বসে থেকেছেন, সেখানে নরেন্দ্র মোদির আচরণ সর্বাধিনায়কের দণ্ডাজ্ঞায় চালিত, যা আসে তাঁর নিজস্ব অভ্রান্ততা এবং অপরাজেয়র অহংবোধ থেকে।
মনমোহন সিং সরকার দুর্নীতিবিরোধী লোকপাল বিল নিয়ে বিবেচনার জন্য একটি সরকারি কমিটি গঠন করে প্রকৃতপক্ষে আন্না হাজারের আন্দোলনকে মান্যতা দিয়েছিল। মোদি সরকার সেসবের ধার ধারেনি। বরং সুপরিকল্পিতভাবে কৃষক বিক্ষোভকে বিভাজিত করার, এমনকী, কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা ক্রমাগত দাবি করে গিয়েছেন, তথাকথিত ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ এবং ‘আরবান নকশাল’-দের এই আন্দোলনে সিঁধ কাটার কোনও অশুভ নকশা আছে। অবিরত অপবাদ দেওয়া মোদি সরকারের প্রোপাগান্ডা-যন্ত্রের খুব পরিচিত একটি কৌশল, যা অতীতেও ব্যবহৃত হয়েছে। সরকারের সমালোচনা যারা করে, তাদের নিশানা করা হয় ‘দেশদ্রোহী’ ষড়যন্ত্রের ভূত খাড়া করে। ইংরেজিতে ‘কে’ দিয়ে শুরু হয় এমন একটি শব্দের অবতারণা করা হল– ‘কিষান’ নয়, ‘খলিস্তান’। আদত ধান্দা হল, এক বড় অংশের নাগরিকবৃন্দকে একথা হজম করানো যে, এই আন্দোলন আসলে কৃষি আইন সংস্কারের জন্য নয়, বরং ভারত রাষ্ট্রের ভিত নড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, এমনকী, এই আজগুবি অভিযোগও এনেছেন যে, প্রতিবাদীরা পাকিস্তান এবং চিনের নির্দেশে চালিত।
কৃষকরা হয়তো প্রথম দফায় সাফল্য অর্জন করেছেন। মোদি সরকারকে তাঁরা আলোচনার টেবিলে আসতে বাধ্য করেছেন। কিন্তু এই একগুঁয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এত সহজে মাথা ঝোঁকাবে– এমনটা আশা করাই ভুল হবে। এ সেই সরকার নয়, যারা কৃষকদের সঙ্গে দেখা করার জন্য ধরনা মঞ্চে মন্ত্রীদের পাঠিয়ে দেবে। যেমনটা মনমোহন সিংয়ের সরকার করেছিল, এমনকী, তাঁরা মন্ত্রিসভার আয়োজনে বিমানবন্দরে একটি ‘রেড কার্পেট’ অভ্যর্থনার বন্দোবস্ত করেছিলেন বাবা রামদেবের জন্য। সুতরাং, সামনে অসন্তোষ এবং ক্ষোভে ভরা একটি দীর্ঘ শীতকাল পড়ে আছে।
পুনশ্চ ভারতীয় শহুরে মধ্যবিত্তর জন্য ২০২০ ছিল জেগে ওঠার আহ্বান। এ বছরের গোড়ায় জাতীয় স্তরে লকডাউন সামনে এনেছিল শহরের সব-হারানো গরিব অভিবাসী শ্রমিকদের কঠিন এবং অস্বস্তিকর বাস্তবতা। তাঁরা বাধ্য হয়েছিলেন তাঁদের গ্রামে ফেরার দীর্ঘ পথে রওনা দিতে। এই কৃষিবিক্ষোভ অন্তত এটুকু সুনিশ্চিত করল যে, কৃষক এবং গ্রামীণ অর্থনীতির চুঁইয়ে-পড়া অস্তিত্বটুকু জাতীয় চেতনায় এখনও বিদ্যমান।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.