রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: আজ বাইশে মে। রাজা রামমোহন রায়ের (Raja Ram Mohan Roy) আড়াইশোতম জন্মদিন। আজ তাঁর মূর্তিতে, ছবিতে মালা দেবার ধুম পড়ে যাবে। সভা ডেকে ধূপধুনো দিয়ে স্মরণ করব তাঁকে। অর্থাৎ তাঁর মূর্তিপুজো, ছবি পুজো করব। এই মূর্তিপুজো, ছবি পুজোতেই তিনি কিন্তু বিশ্বাস করতেন না। তিনি হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর একটিকেও তাঁর বিশ্বাসে স্থান দেননি। নারায়ণশিলা থেকে সরিয়ে নিলেন তাঁর প্রতীতি ও প্রণাম! তাঁর সেই দীক্ষা, দর্শন, প্রত্যয়, মূল্যবোধ, সমাজচেতনা আজও আমরা হজম করতে পারিনি। আজও নাগাল পাইনি তাঁর ইথারস্পর্শী উচ্চতার। তাঁর ইন্টেলেকচুয়াল ব্যাপ্তি আজও থেকে গিয়েছে আমাদের বোধের অতীতে। এবং তিনি আড়াইশো বছরের পুরনো, তবু তাঁর আধুনিকতা হয়তো আমাদের এ-যুগের নানা সংস্কার, প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস-কে আড়াইশো বছর পিছনে ফেলেই এগিয়ে আছে! চারধারে তাকিয়ে দেখুন তাঁর মতো একজনও বাঙালি চোখে পড়ছে কিনা, যে বাঙালি বারো বছর বয়সের মধ্যে মুসলমান সংস্কৃতির কেন্দ্র পাটনায় গিয়ে মৌলবিদের কাছে আরবি আর ফারসি শিখে, আরবি ভাষায় ইউক্লিডের জ্যামিতি ও সংখ্যা-দর্শন পড়ছে, পড়ছে অ্যারিস্টটলের এথিকস। তার আগে অবশ্য সেই বালক যথেষ্ট সংস্কৃত চর্চা করেছে বাংলার মহাপণ্ডিতদের কাছে।
এরপর কিশোর রামমোহন যাচ্ছেন কাশীতে হিন্দুধর্মের সন্ধানে। এবং খুঁজে পাচ্ছেন মাত্র ষোলো বছর বয়সে হিন্দুধর্মের সারসত্য! এবং বাবা রামকান্তকে, মা তারিণীকে জানাচ্ছেন হিন্দুধর্মের অন্তরসত্যটির কথা : আরবি ভাষায় পাশ্চাত্য দর্শন এবং সংস্কৃত ভাষায় উপনিষদ চর্চা করে এবং হিন্দু দর্শনের গভীর পাঠ নিয়ে আমি আর হিন্দুদের তেত্রিশকোটি দেবদেবীর একটিকেও মানতে পারছি না। আমি সমস্ত দেবদেবী পরিত্যাগ করে সেই বিশুদ্ধ ব্রহ্মজ্ঞান-পিপাসু হিন্দু হয়েছি যে বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর একটিই। অর্থাৎ আমি আপোসহীন, নিরন্তর, নিখাদ একেশ্বরবাদী হিন্দু ব্রাহ্মণ (রামমোহন রায়ের পদবি ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়)। এবং আমার ঈশ্বর নিরাকার। তাঁর কোনও মূর্তিতে আমি বিশ্বাস করি না। আমি সমস্ত রকম মূর্তিপূজার বিরোধী। আমার ঈশ্বর শব্দহীন, স্পর্শহীন, রূপহীন, এক অব্যয় নিত্য সত্তা। তিনি নিরন্তর দ্রষ্টা। নিরবচ্ছিন্ন স্রষ্টা। কিন্তু নন শ্রবণের বিষয়ীভূত। তিনি নিরাধার। নির্বিকার। নির্বিশেষ। তিনি সর্বদর্শী। সর্বব্যাপী। সকলের মধ্যে তিনিই বিনাশহীন আত্মারূপে বিরাজিত। তিনিই পরম ব্রহ্ম। এবং তিনি প্রমাণের অবিষয়। ওঁ তৎ সৎ। লিখলেন ষোলো বছরের রামমোহন। এইরকম কোনও ষোলো বছরের কিশোর এ-যুগের আধুনিক বাঙালিদের মধ্যে চোখে পড়ছে কি?
এতো কিছুই নয়; এরপরে যা ঘটল তার তুলনায়। রামমোহন শুধু একেশ্বরবাদী হিন্দু হয়েই ফিরে এলেন না কাশী থেকে, তিনি পড়লেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের (Nalanda University) ইতিহাস। তিনিও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসামান্য ছাত্র অতীশ দীপংকরের মতো হতে চান প্রজ্ঞার সন্ধানী। পড়তে চান প্রাচীন পুঁথি। হতে চান হারিয়ে-যাওয়া দর্শন ও এষণার অধিকারী! তিনি হাঁটতে শুরু করলেন তিব্বতের পথে। এবং অবশেষে পৌঁছলেন সেই রহস্যময় দেশে। তিনি যে প্রাচীন পুঁথির পাঠ উদ্ধার করে গোপন প্রজ্ঞার অন্বেষণে এসেছেন, এ-কথা জানলেন লামারা। তাঁকে হত্যা করার চেষ্টাও হয়েছিল। প্রাচীন পুঁথির আড়াল করা জ্ঞানভাণ্ডার স্মৃতিতে ধারণ করে দেশে ফিরলেন রামমোহন। এবং দেশে ফিরে লিখলেন ফারসি ভাষায় তাঁর একেশ্বরবাদী, সম্পূর্ণ দেবদেবীহীন দার্শনিক গ্রন্থ : ‘তুইফাৎ-উল্-মুয়াহ্হিদীন’। ১৮০৩ সালে লিখেছিলেন এই বৈপ্লবিক বই। তখন রামমোহনের বয়স সবে তিরিশ পেরিয়েছে। এরপর রামমোহনকে দেখছি আমরা ইংরেজ সিভিলিয়ান ডিগবির… দেওয়ান রূপে। তিনি প্রভূত অর্থ উপার্জন করলেন। কলকাতায় চারটি প্রাসাদের মতো বাড়ি করলেন। এবং তৈরি করলেন বিদগ্ধ বাঙালিদের এক সমাজ। নাম দিলেন ‘আত্মীয়সভা’। এই আত্মীয়সমাজকেই তিনি ক্রমশ পরিণত করলেন ব্রাহ্মসমাজে। এরপর এমন একটি কাজ করলেন যা আর কোনও বাঙালি কোনওকালে করেছে বলে আমার জানা নেই। তিনি হিব্রু শিখে বাইবেলের পুরনো অংশ মূল ভাষায় পড়লেন। এবং দুঃসাহসে বললেন, পুরনো বাইবেলের অবতারবাদ বর্জনীয়। ক্রাইস্টের উপদেশই ক্রিশ্চানধর্মের সারাৎসার। একদিকে অধিকাংশ হিন্দুরা তাঁর শত্রু। অন্যদিকে গোঁড়া ক্রিশ্চানরাও তাঁর বিরোধিতা শুরু করল।
এই সময় এক ভয়ংকর ঘটনা ঘটল রামমোহনের জীবনে। তাঁর দাদা জগমোহন মারা গেলেন কমবয়সেই। পণ্ডিতেরা জোর করে জগমোহনের চিতায় তুলল রামমোহনের খুব ভালবাসার বউদি অলকামঞ্জরীকে, নতুন বউয়ের সাজে। অলকামঞ্জরীর কথা আমরা ভুলে গেছি। কিন্তু তিনিই ছিলেন রামমোহনের সতীদাহ-বিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রেরণা। রামমোহন জীবন্ত অলকামঞ্জরীকে তাঁর চোখের সামনে চিতায় পুড়তে দেখে বলেছিলেন, বৌদি, তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না, কিন্তু হিন্দুদের এই বর্বরতা আমি নাশ করবই। এবং মহাপণ্ডিত, উদারপন্থী রামমোহন শেষ পর্যন্ত হিন্দুশাস্ত্রের প্রমাণ দাখিল করে সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে আইন আনতে সফল হলেন। সতী হতে গেলে কোনও নারীকে চন্দ্র সূর্য সাক্ষী করে সংকল্প নিয়ে মন্ত্রপাঠ করতে হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই মন্ত্র জোর করে পাঠ করানো হত। তারপর বলা হত, এই সতী-মন্ত্র থেকে ফেরবার উপায় নেই। ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর লর্ড বেন্টিঙ্ক রামমোহনের সঙ্গে একমত হয়ে সতীদাহ আইন করে বন্ধ করলেন। সে-যুগে এই কাজটি করা কতদূর কঠিন ছিল আজকের বাঙালি তা বুঝতে পারবে না। যেমন বুঝতে পারবে না আজকের বাঙালি রামমোহনের সময় দিল্লির বাদশার দূত হয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বসবার জন্য ১৮৩১ সালে ইংল্যান্ড যাওয়া কী বিস্ময়কর ঘটনা।
রামমোহনকে ‘রাজা’ উপাধি দিয়েছিলেন দিল্লির বাদশা। ‘রাজা’ উপাধি তাঁর ধনদৌলতের জন্য নয়। তিনি ‘রাজা’ তাঁর মন ও মননের আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তির জন্য। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রাজা রামমোহনই ভারতের প্রথম রাজদূত। তাঁর মতো প্রজ্ঞাবান, বোধদীপ্ত, উদারপন্থী এবং বিপ্লবী সমাজসংস্কারক আর কোনও ভারতীয় রাজদূত কি ইংল্যান্ডের রাজসভায় আমরা আজও পাঠাতে পেরেছি?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.