পাক্কা ৩০ বছর পর আরও একটা লোকসভা ভোটের আগে রাজীব-পুত্র রাহুল একই কায়দায় রাফালে যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি নিয়ে চেপে ধরতে চাইছেন মোদির সরকারকে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠছে, রাহুল কি বোফর্সের বদলা নিচ্ছেন? না কি রাহুল ভাবছেন, যদি বোফর্স দিয়ে মোদির পূর্বসূরিরা তাঁর বাবাকে নাস্তানাবুদ করতে পারেন, তাহলে তিনি কেন রাফালে দিয়ে নামাতে পারবেন না মোদির সরকারকে! লিখেছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
কারগিল যুদ্ধের পর বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছে। কাশ্মীর উপত্যকা তখন ফের উত্তাল। সালটা ২০০২। বিধানসভা ভোট ঘোষণা হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই বন্ধ লেগে রয়েছে উপত্যকার শহরগুলিতে। ভোট কভার করতে গিয়ে কাশ্মীরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছি। এক অজানা আতঙ্ক সবসময় ঘিরে রাখলেও শ্রীনগরের বাইরে বেরলেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মন ভরে যেত। তাই কোনও দিনই বেরিয়ে পড়ার হাতছানি উপেক্ষা করা যেত না। সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য ভূস্বর্গ অন্য রূপ নিয়ে নিত। সর্বত্র কারফিউ। রাস্তাঘাট নিঝুম অন্ধকারে ডুব দিত। থেকে থেকে বাতাস চিরে আসত গুলির আওয়াজ। এইরকম উত্তেজনার মধ্যেই একদিন ঠিক করলাম উরিতে ‘এলওসি’ দেখতে যাব। একটি মারুতি ওমনি ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়িটি কাশ্মীরের স্থানীয় কয়েকটি কাগজের হয়েও কাজ করত। ফলে গাড়ির চালক আধা সাংবাদিক এবং আধা গাইড।
ঝিলমের ধার দিয়ে দিয়ে পাহাড় বেয়ে যত উরির দিকে এগচ্ছি তত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। পথের পাশে বর্ডার রোড অর্গানাইজেশনের মাইলফলকগুলিতে লেখা, স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে, তাহলে তা এখানেই। এই রাস্তাতেই ভীষণভাবে উপলব্ধি হচ্ছিল কেন কাশ্মীর ভূস্বর্গ। পথে কয়েকবার সেনার ‘নাকা’-র মুখে পড়তে হল। ‘সাংবাদিক’ পরিচয়পত্র দেখালে তবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতি মিলছিল। যত এলওসি-র দিকে এগিয়ে চলেছি, তত চারিদিকে শুধু জলপাই উর্দি ছাড়া কাউকে নজরে পড়ছিল না। এলওসি-র কাছাকাছি আসার পর হঠাৎ রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করালেন লালচে রঙের ‘খান’ ড্রেস পরা এক মধ্যবয়সি। একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কারণ জলপাই উর্দির এই দেশে এই লোকটি কে? গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কানের কাছে ওই ভদ্রলোক ফিসফিস করে বললেন, ‘মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স’। এই বলেই তিনি আমার গাড়িতে উঠে পড়লেন। দেখলাম, লোকটি অবগত যে, আমি সাংবাদিক এবং এলওসি-তে চলেছি। তাতে আরও গা ছমছম করাটা বেড়ে গেল। এই সময় বুক কাঁপানো বিকট শব্দের পরপর শেলের আওয়াজ শুনতে শুরু করলাম। মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স পরিচয় দেওয়া ভদ্রলোক বললেন, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এগুলো সব বোফর্স কামানের আওয়াজ। কয়েক দিন ধরে এলওসি-তে পাকিস্তান শেল ফাটানো বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে আমরাও পালটা দিচ্ছি।’ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে দেখতে পেলাম সারি সারি বোফর্স কামান দাঁড়িয়ে। এর কোনওটা কোনওটা মাঝে মাঝে গর্জে উঠছে। খান ড্রেসের লোকটি আঙুল দিয়ে দেখাতে থাকলেন বোফর্স কামানগুলি। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আগে দেখেছেন বোফর্স? দেখুন এগুলো কত কার্যকর। বোফর্স নিয়ে তো শুধু খারাপ খবরই এতদিন আপনারা লিখলেন।’ তার আগে অবশ্য কারগিল যুদ্ধের সময় বোফর্সের গুণগান হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। সত্যিই সেদিন চাক্ষুষ করলাম বোফর্সের কার্যকারিতা। এলওসি পৌঁছনোর আগে গাড়ি থেকে নেমে গেলেন ওই ভদ্রলোক। বলে গেলেন, ‘চিন্তার কিছু নেই। এখানে নিশ্চিন্তে ঘুরুন। বোফর্সের ঘেরাটোপে আছেন।’ যতক্ষণ এলওসি-তে ছিলাম, ততক্ষণই গুমগুম করে আওয়াজ শুনেছি বোফর্সের গোলার।
এলওসি-তে দাঁড়িয়ে সেদিন বুঝেছিলাম, বোফর্স কামান এখন অনেকটা তীর্থদর্শনের মতো হয়ে গিয়েছে। এলওসি-তে দাঁড়িয়ে যে কামান পাক সেনাবাহিনীকে সবসময়ে ত্রস্ত করে রেখেছে, এক সময়ে সেই বোফর্সকেই দেখেছিলাম কীভাবে রাজীব গান্ধীর সরকারকে টেনে নামিয়েছিল। ওই বোফর্সের ভূত এখনও ভারতীয় রাজনীতিতে ঘুরে বেড়ায়। শুধু পাক সেনার নয়, বোফর্স সর্বদা ঘুম কাড়ে ভারতীয় রাজনীতিকদেরও। সাম্প্রতিক রাফাল বিতর্কেও সামনে চলে এসেছে বোফর্স। সুইডিশ কোম্পানির থেকে কামানগুলি কেনার সময় আদৌ ঘুষ খাওয়া হয়েছিল কি না, সেই ঘুষের টাকা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে পৌঁছেছিল কি না, কী পরিমাণ ঘুষ খাওয়া হয়েছিল, সেসব বিষয় আজও অস্পষ্ট। কিন্তু বোফর্স ভারতীয় রাজনীতিতে একটা ধারণা হয়ে রয়ে গিয়েছে। বোফর্স মানেই আমাদের সেই কিকব্যাকের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। বোফর্স নামেই এখনও সেই সরকার পড়ে যাওয়ার দৃশ্য সামনে চলে আসে। দেওয়ালে আঁকা সেসব কার্টুনের ছবি মনে পড়ে যায়। একটা অ্যাটাচি করে বোফর্সের টাকা নিয়ে রাজীব গান্ধী প্লেনে উঠে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন।
পাক্কা ৩০ বছর পর আরও একটা লোকসভা ভোটের আগে রাজীব-পুত্র রাহুল একই কায়দায় রাফালে যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি নিয়ে চেপে ধরতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদির সরকারকে। স্বাভাবিকভাবে উঠে আসছে এই প্রশ্ন, রাহুল কি বোফর্সের বদলা নিচ্ছেন? না কি রাহুল ভাবছেন, যদি বোফর্স দিয়ে মোদির পূর্বসূরিরা তাঁর বাবাকে নাস্তানাবুদ করতে পারেন, তাহলে তিনি কেন রাফাল দিয়ে নামাতে পারবেন না মোদির সরকারকে। কারণ এক্ষেত্রেও দুর্নীতি প্রমাণের চেয়েও সরকারকে বিব্রত করছে ধারণার প্রশ্নটি। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছিল রাফালের ক্ষেত্রে বোফর্সের তীব্রতা আসবে না। বোফর্সে খুব সহজে মানুষকে বোঝানো গিয়েছিল, একটা কামানের বরাত পেতে বিদেশি কোম্পানি কিছু ভারতীয় নেতাকে ঘুষ দিয়েছিল। সেই ঘুষের টাকা জমা হয়েছে সুইস ব্যাঙ্কে। তুলনায় রাফালে অনেক জটিল বিষয়। রাফালে নিয়ে ওঠা অভিযোগগুলির মাত্রাও বহুবিধ। এখানে একটি দিক যেমন কেন ইউপিএ আমলের তুলনায় এনডিএ আমলে এক-একটি রাফালে বিমানের মূল্য হাজার কোটি টাকার উপর বেড়ে গেল, সেই প্রশ্নটি রয়েছে। অন্যদিকে, এই বিমান বানানোর জন্য ভারতীয় সহযোগী হিসাবে ফরাসি কোম্পানিটি কেন রাষ্ট্রায়ত্ত ‘হিন্দুস্তান এরোনটিক্স লিমিটেড’-এর বদলে অনিল আম্বানির নবগঠিত প্রতিরক্ষা সংস্থাকে বেছে নিয়েছিল, সেই প্রশ্ন। বিতর্কে আরও ইন্ধন জুগিয়ে দিয়েছেন, প্রাক্তন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাদঁ। একবার তিনি বলেছেন, ভারত সরকারই বলে দিয়েছিল ভারতীয় সহযোগী হিসাবে অনিল আম্বানির সংস্থাকে নিতে হবে। আবার পরক্ষণেই নিজের বক্তব্য থেকে সরে এসে জানিয়েছেন, ফরাসি সংস্থা ‘দাসাল্ট’-ই বেছে নিয়েছিল আম্বানির সংস্থাকে। কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে, এখনও সবকিছু ধোঁয়াশার আড়ালে। তবু, মানুষের মনে একটা ধারণা জন্ম নিতে সময় লাগে না। মোদি সরকারের মন্ত্রীদের একযোগে রাফালে জবাব দেওয়ার তৎপরতা দেখে বোঝা যাচ্ছে, বোফর্সের ভূত ধীরে ধীরে গ্রাস করছে হয়তো তাঁদেরও।
সমস্যাটা বোফর্সের ক্ষেত্রে রাজীব গান্ধীর যেরকম হয়েছিল, এক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই হতে পারে। লোকসভা ভোট মাত্র সাতমাস দূরে। তার আগে যদি রাফালে ইসু্যটি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়ে একটা দুর্নীতির বড় ধারণা নির্মাণ করে ফেলে, তাহলে কী হবে? কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা কংগ্রেসের ছোট-বড়-মেজ-সেজ সব নেতাই সাংবাদিক বৈঠক করে রাফাল নিয়ে এখন কেন্দ্রের কাছে জবাব চাইছে। ধীরে ধীরে তাতে গলা মেলাতে শুরু করেছে অন্যান্য বিজেপি-বিরোধী দলগুলিও। সম্মিলিত এই স্বর যখন গোটা ভারতজুড়ে আরও তীব্রতা ও জোরের সঙ্গে অনুরণিত হতে থাকবে, তখন নিঃসন্দেহে পারসেপশনের এই সমস্যা কেন্দ্রের বর্তমান সরকারকে আরও সংকটে ফেলবে। জানি না, রাফালে আগামিদিনে বোফর্স হতে পারবে কি না? তবে ভবিষ্যতে কোনও একদিন যে এই যুদ্ধবিমানও সাধারণ ভারতবাসীর কাছে তীর্থদর্শনের মতো হয়ে উঠবে তাতে কোনও সংশয় নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.