রায়বরেলি লোকসভায় কংগ্রেসের একাধিপত্য থাকলেও কেন্দ্রের অন্তর্গত ৫টি বিধানসভা কেন্দ্রে কোথাও নেই তারা। ২০২২ এর উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটে তিনটি সমাজবাদী পার্টির, ২টি আসন বিজেপির দখলে যায়। প্রার্থীদের একজনকে আবার কংগ্রেস থেকে ঘর ভাঙিয়ে এনে টিকিট দিয়েছিল বিজেপি। অর্থাৎ কংগ্রেসে ভাঙন দূর্গেই। বিশ্লেষণে অরূপ কর
রায়বরেলি। দেশের অন্যতম হাইপ্রোফাইল লোকসভা কেন্দ্রগুলোর অন্যতম। যে কোনও লোকসভা ভোটের আগে আলোচনা, চর্চায় রায়বরেলির প্রসঙ্গ উঠলে একটিই নাম ভেসে ওঠে। কংগ্রেস। রায়বরেলি আর কংগ্রেস যেন সমার্থক। একটা ছাড়া আরেকটা ভাবা যায় না, হয় না। রায়বরেলিতে ভোটের ফল কী হবে, প্রশ্ন করা হলে চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়, আর কে, কংগ্রেস?
কেন? এমন গ্যারান্টির কারণ একটাই। তিনবার ব্যাতিক্রম হলেও ১৯৫২ থেকে শুরু করে যত বার লোকসভা ভোট হয়েছে, সেখানে জিতেছে হাত প্রতীকই। ২০-র মধ্যে ১৭ বারই। ইতিহাস বলছে, কংগ্রেস ছাড়া বিকল্প কাউকে ভাবেন না রায়বরেলির ভোটাররা। ফিরোজ গান্ধী দিয়ে শুরু, সর্বশেষ ২০১৯ এর ভোটে সোনিয়া গান্ধী। ৫ বছর আগের শেষ সাধারণ নির্বাচনে গেরুয়া ঝড়ে উত্তরপ্রদেশ-সহ হিন্দি বলয়ে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায় কংগ্রেস। এমনকী উত্তরপ্রদেশে তাদের আরেক গড় আমেঠিতে স্মৃতি ইরানির কাছে হেরে যান খোদ রাহুল গান্ধী। বাকি বিরোধীদের হালও তথৈবচ। কিন্তু রায়বরেলিতে যথারীতি সেই কংগ্রেস।
আর রায়বরেলি মানেই নেহরু-গান্ধী পরিবার। ১৯৫২, ১৯৫৭-য় ফিরোজ গান্ধী। অবিসংবাদী নেত্রী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী। ইন্দিরা স্বয়ং জেতেন তিনবার। বাকি নির্বাচনগুলোতেও জয়জয়কার হয় যাঁদের, তাঁদের কোনও না কোনও যোগসূত্র আছে ওই পরিবারের। ১৯৮০-র উপনির্বাচন, ১৯৮৪-তে সেখানে জয়ী হন জওহরলাল নেহরুর নাতি অরুণ নেহরু। ১৯৮৯, ১৯৯১ এ জেতেন শীলা কউল। শীলা ওই পরিবারের আত্মীয়। আরও কয়েকজন কংগ্রেস প্রার্থী হয়েছেন যাঁদের সঙ্গে গান্ধী পরিবারের যোগসূত্র আছে বা তাদের ঘনিষ্ঠ। প্রয়াত রাজীব গান্ধী, সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে ১৯৯৯ এ জয়ী ক্যাপ্টেন সতীশ শর্মার ঘনিষ্ঠতা সুবিদিত ছিল। মাত্র দুবার, ১৯৬২ আর ১৯৯৯এ নেহরু-গান্ধী পরিবারের কেউ প্রার্থী হননি।
নিরঙ্কুশ একাধিপত্যের মধ্যে রায়বরেলিতে কংগ্রেস বিরাট ধাক্কা খায় ১৯৭৭ এর লোকসভা নির্বাচনে। সদ্য জরুরি অবস্থার শ্বাসরোধকারী অধ্যায় শেষ হয়েছে। দেশব্যাপী কংগ্রেস, বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধী আমজনতার চোখে ভিলেন। জবাব দিতে তৈরি ছিলেন তাঁরা। ব্যালটে সংসদীয় বিপ্লব ঘটে যায়। হেরে যায় কংগ্রেস। রায়বরেলিতে ইন্দিরাকে হারিয়ে ইন্দ্রপতন ঘটান রাজনারায়ণ। ৫৫ হাজারের বেশি ভোটে হারেন ইন্দিরা। তৎকালীন বিরোধীরা এক ছাতার নীচে জড়ো হয়ে জনতা পার্টি গঠন করেন। তাদের প্রার্থী ছিলেন রাজনারায়ণ।
এহেন রায়বরেলি সোনিয়া গান্ধীকে জিতিয়েছে টানা ৫ বার। ২০০৪, ২০০৬ (উপনির্বাচন), ২০০৯, ২০১৪, ২০১৯। ২০০৪ এ তিনি পান ৫৮.৮ শতাংশ, ২০০৬ এ তা লাফিয়ে বেড়ে হয় ৮০.৫ শতাংশ। ২০০৯ এ তা কমে হয় ৭২.২ শতাংশ। ২০১৪য় আবার বেড়ে হয় ৮৩.৮ শতাংশ। ২০১৯ এ অনেকটা কমে হয় ৫৫.৮ শতাংশ। ২০১৯ এ সোনিয়া বিজেপির দীনেশ প্রতাপ সিংকে ১, ৬৭,১৭৮ ভোটে হারিয়ে জয়ী হন। দীনেশ পান ৩৮.৩৫ শতাংশ ভোট। হেলাফেলা করার মতো নয় মোটেই।
তবে সোনিয়া বয়সজনিত কারণে বেশি ধকল নিতে পারবেন না বলে ভোটে না লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনি রাজস্থান থেকে রাজ্যসভায় চলে গিয়েছেন। রায়বরেলির ভোটারদের মধ্যে কৌতূহল তুঙ্গে, কে তবে প্রার্থী শতাব্দীপ্রাচীন দলটির। সোনিয়া ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। কেন্দ্রের জনগণের উদ্দেশে বার্তায় তাঁদের সঙ্গে নেহরু-গান্ধী পরিবারের দীর্ঘ সম্পর্কের উল্লেখ করে আবেদন করেছেন, এই যোগসূত্র আগামী দিনেও থাকবে জানি। এই বার্তায় মেয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে এবার সেখানে প্রার্থী করার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কংগ্রেস কর্মীদেরও দাবি, প্রিয়াঙ্কা ওখানে লড়ুন। ইতিমধ্যে সেখানে পোস্টারও পড়েছে–রায়বরেলি পুকারতি, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী জি আয়ে।
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ সিং যাদবের সঙ্গে আসন সমঝোতা ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করে সফল হয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। অর্থাৎ কংগ্রেসে ক্রাইসিস ম্যানেজারের ভূমিকায় তিনি। রায়বরেলির ভোটে জয় তাঁকে সেদিকে আরও এগিয়ে দেবে।
কিন্তু ঘটনা হল, রায়বরেলি লোকসভায় কংগ্রেসের একাধিপত্য থাকলেও কেন্দ্রের অন্তর্গত ৫টি বিধানসভা আসনে কোথাও নেই তারা। ২০২২ এর উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটে তিনটি সমাজবাদী পার্টির, ২টি আসন বিজেপির দখলে যায়। প্রার্থীদের একজনকে আবার কংগ্রেস থেকে ঘর ভাঙিয়ে এনে টিকিট দিয়েছিল বিজেপি। অর্থাৎ কংগ্রেসের ঘরেই ভাঙন। শুধু তাই নয়, ৪টি কেন্দ্রে কংগ্রেস নেমে যায় তিন নম্বরে, ১টিতে চারে। ৫ বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস পেয়েছিল সাকুল্যে ১৩.২ শতাংশ ভোট। সমাজবাদী পার্টি ৩৭.৬, বিজেপি ২৯.৮ শতাংশ। এ থেকেই পরিষ্কার, নিজেদের গড়ে শক্তি খোয়াচ্ছে কংগ্রেস। গোটা রাজ্যে বিপর্যয়ের আঁচ থেকে রক্ষা পায়নি শক্ত ঘাঁটিও। উত্তরপ্রদেশে ২০২২ এ কংগ্রেস মাত্র ২টি আসন পায়, ভোট শতাংশ ২.৩!
২০০০ থেকেই কংগ্রেসের রায়বরেলিতে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল মুলায়ম সিং যাদবের দল আর মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি। কিন্তু সেই পরিসরেও ক্রমশঃ ঢুকে পড়ে বিজেপি। বিধানসভা স্তরে তাদের শক্তি বাড়তে থাকে একটু একটু করে। ২০১৪য় তারা পেয়েছিল ২১.১ শতাংশ ভোট, যা ২০১৯ এ বেড়ে হয় ৩৮.৭ শতাংশ। অর্থাত পদ্মের দাপট ক্রমবর্ধমান।
বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের শক্তিক্ষয়ের প্রতিফলন কি ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে দেখা যাবে? অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির প্রতিশ্রুতি পূরণ করে হিন্দি বলয়ে ঝড় তুলেছে গেরুয়া শিবির। নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মা আগের চেয়ে আরও জোরাল হয়েছে। রাজনৈতিক মহল ধরেই নিয়েছে, ২০১৯ এর ফলেরই পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। গেরুয়া ঝড়ের আঁচ থেকে কি এবার রায়বরেলির গড় বাঁচিয়ে ধরে রাখতে পারবে কংগ্রেস? কৃষক সমস্যা, বেরোজগারি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানীয় জলের মতো দৈনন্দিন ইস্যুকে ছাপিয়ে মন্দির আবেগ কি সেখানেও কাজ করবে? নাকি এসব ফ্যাক্টর ধুয়েমুছে দিয়ে মায়ের মতোই রায়বরেলিতে জয় পাবেন প্রিয়াঙ্কা? রায়বরেলি কংগ্রেস, গান্ধী পরিবারের ছিল, থাকবে? আরেক দূর্গ আমেঠিতে রাহুল গান্ধীর ২০১৯ এ হারের নজির কিন্তু রয়েছে।
জেলার জনবিন্যাস ঘেঁটে যে পরিসংখ্যান উঠে আসছে, সেই অনুযায়ী ৯০ শতাংশ বাসিন্দা হিন্দু, ৫ শতাংশ মুসলিম, বাকিরা অন্য ধর্মের। ৮৯ শতাংশ ভোটার মূলত গ্রামের লোক। শহুরে ভোটার ১১ শতাংশ। তফসিলি জাতিভুক্ত ৩০.৪ শতাংশ, উপজাতি ০.১ শতাংশ। এই মানুষগুলো এবার ব্যালটে কী রায় দেন, সেজন্য তাকিয়ে থাকতে হবে ফল প্রকাশ পর্যন্ত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.