ক্ষমতাশীল শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা কোনওকালেই যে সহজ নয়, তার অনন্য দৃষ্টান্ত, জালিওয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ। এ ছিল তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগ। পাশে পাননি গান্ধীজি, এমনকী দেশবন্ধুকেও। তাঁর প্রতিবাদের পর ক্রমশ তৎকালীন নেতাদের সাহস বাড়ে, অবস্থান বদলায়! লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার প্রতিবাদে ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অদ্ভুত ব্যাপার– সেই প্রতিবাদের সময় বড্ড নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। পাশে পাননি মহাত্মা গান্ধীকেও। শুধু গান্ধীজি কেন, এমন স্পর্শকাতর ইস্যুতে ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের মতো নেতাও তাঁর পাশে ছিলেন না। যা দেখে স্বভাবতই হতাশ হন ‘কবিগুরু’।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (অমৃতসর হত্যাকাণ্ড) ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যা। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল বৈশাখি উৎসবের দিন অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে ইংরেজ সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও’ডায়ারের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ডায়ারের নির্দেশে অতর্কিতে শুরু হয়েছিল গুলিবর্ষণ। শোনা যায়, সেদিন খরচ হয়েছিল ১,৬৫০ রাউন্ড গুলি। বাঁচতে বাগের মাঝখানে থাকা কুয়োতে ঝাঁপ দিলে পাথর ফেলে কিছু মানুষকে জীবন্ত প্রোথিত করা হয়। ব্রিটিশ সরকারি হিসাব বলে– সেদিন ৩৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ১,১০০ জন আহত হয়। যদিও বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। এই ভয়ানক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত নগ্ন রূপটি ফুটে ওঠে।
এ-খবর জানার পর রবীন্দ্রনাথ রীতিমতো ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি মনে করেন, ইংরেজের এমন বর্বরোচিত আচরণের কথা বিশ্ববাসীর জানা উচিত। অথচ, এমন নৃশংস ঘটনার পরও গান্ধীজি কিংবা কংগ্রেসের নেতাদের দিক থেকে তেমন কোনও প্রতিবাদ গর্জে উঠতে দেখা গেল না! তখন রবীন্দ্রনাথ একটি প্রস্তাব দিয়ে অ্যান্ড্রুজকে পাঠালেন গান্ধীজির কাছে। প্রস্তাবে বলা হয়, তিনি গান্ধীজিকে সঙ্গে নিয়ে পাঞ্জাব যাবেন। কারণ, তখন সেখানে পাঞ্জাবের বাইরের মানুষের প্রবেশ ‘নিষিদ্ধ’ করেছে ব্রিটিশ সরকার। তাঁরা দু’জনে ঢুকতে গেলে নিশ্চিত গ্রেপ্তার হবেন। আর, তাঁর ও গান্ধীর গ্রেপ্তারের খবর চাপা থাকবে না– ফলে সারা বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়বে।
কয়েক দিন বাদে অ্যান্ড্রুজ ফিরলেন ঠিক-ই, তবে জানালেন, কবির প্রস্তাবে বাপু রাজি নন। ওই সময় সরকারের সঙ্গে কোনওরকম প্রত্যক্ষ সংঘাতে যেতে রাজি নন মহাত্মা। কোনও বিরূপ মন্তব্য করলেন না ঠিক-ই, তবে কবি চরম আঘাত পেলেন। তখন তাঁর মনের ভিতর চরম অস্থিরতা। ঠিক করলেন, চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে দেখা করবেন। কবি নিজেই গেলেন তাঁর কাছে। কবির প্রশ্ন ‘দেশবন্ধু’-র কাছে, পাঞ্জাবের ঘটনায় বাঙালিরা কেন প্রতিবাদ করছে না? রবীন্দ্রনাথ তাঁকে প্রতিবাদ সভা ডাকতে বলেন এবং সে-সভায় কবি স্বয়ং সভাপতি হতে রাজি বলেও জানালেন। সেদিন রবি ঠাকুর চেয়েছিলেন ওই সভাটি যেন কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়। কিন্তু বাংলায় আরও অনেক কংগ্রেস নেতা রয়েছেন– এই অজুহাত দেখিয়ে– তাঁর একার পক্ষে এই ব্যাপারে কথা দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান চিত্তরঞ্জন। তিনি কবিকে পাল্টা প্রস্তাব দেন– সভাটি রবীন্দ্রনাথ নিজেই যেন ডাকেন। বিস্মিত রবীন্দ্রনাথ– বুঝে উঠতে পারলেন না– এ বঙ্গের নেতাদের ব্রিটিশদের এত ভয়ের কারণটা কী? চিত্তরঞ্জনের মনোভাব বুঝে আর সেখানে বসে সময় নষ্ট না-করে ফিরে এলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।
সেদিন কবির জন্য বাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন প্রশান্ত মহলানবীশ। লেখালিখির ব্যাপারে কিছু কাজ ছিল। সেদিন আর কোনও কাজ হবে না, তাই কবি তাঁকে চলে যেতে বলেন। রবি ঠাকুরের থমথমে মুখ দেখে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর একান্ত কাছের প্রশান্ত। তাই রাতে বাড়ি ফিরলেও পরের দিন ভোর হওয়ার আগেই আবার জোড়াসাঁকো যান তিনি। কবির ঘরে গিয়ে দেখলেন তিনি সারা রাত না শুয়ে কিছু লেখালিখিতে ব্যস্ত। ইংরেজিতে লেখা সেই কাগজগুলি প্রশান্তকে পড়তে বলেন কবি।
লেখাটা হাতে নিয়ে প্রশান্ত দেখলেন– অনেক কাটাকুটিতে ভরা বড়লাট চেমসফোর্ডকে লেখা চিঠি যাতে বলা হয়েছে, কবিগুরু ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করছেন। পাশাপশি, ডেকে পাঠালেন অ্যান্ড্রুজকে চিঠিটা পড়ে দেখতে। ঠিকঠাক আছে, তবে ভাষাটা একটু মোলায়েম করার কথা বলেছিলেন অ্যান্ড্রুজ। কিন্তু কবি তাতে রাজি নন। প্রতিবাদ-ই যখন, তখন ভাষা নরমের কী দরকার? কবির মতে, ইংরেজ সরকার একদিন বেশ খাতির করে তাঁকে ‘নাইটহুড’ দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু যে-সরকার দেশের লোকের উপর এমন অত্যাচার করতে পারে, সেই সরকারের দেওয়া খেতাব রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। তাই জালিয়ানওলায়াবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি ‘নাইট’ উপাধি ফেরত দিচ্ছেন।
রাজনৈতিক নেতাদের পাশে না-পাওয়ায় আর কোনও সভা করার তাগিদ অনুভব করেননি। তিনি তখন চেয়েছিলেন একেবারে নিজের মতো করেই লিখে প্রতিবাদ জানাতে। আর, সেটাই করেন। ‘নাইটহুড’ ফেরত দিতে চেয়ে বড়লাট চেমসফোর্ডকে লেখা সেই চিঠিটিকে তার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অ্যান্ড্রুজকে। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ সেই চিঠির কয়েকটি কপি করে পাঠিয়ে দেন বিভিন্ন সংবাদপত্র-পত্রিকার দপ্তরে।
কোনও কালেই ক্ষমতাশীল শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সহজ নয়। আর সেদিন নেতারা প্রতিবাদ করলেও সেই প্রতিবাদের নেপথ্যে তাঁরাও যে কখনও কখনও সুবিধা-অসুবিধার অঙ্ক কষতেন না, এটা অস্বীকার করা যায় না। ফলে সেদিনের ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে এ-যুগের নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক হিসাব কষার ভূমিকা দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদী রূপ আর এই যুগের লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা দেখে– দুয়ের মধ্যেকার বিচ্যুতিটা যেন প্রকট হয়ে ধরা পড়ে।
প্রসঙ্গত, রবি ঠাকুরের ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগের কিছু দিন পর অবশ্য গান্ধীজি তাঁর অবস্থান বদলে পাঞ্জাব গিয়েছিলেন৷ রাজনীতির মোড় ঘোরার সঙ্গে-সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাও তখন এই ইস্যুতে তাঁদের অবস্থান বদলান।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.