অরিঞ্জয় বোস: নীল নীল আকাশের কাছে আজ যাওয়া চাই…
গাড়িতে কবীর সুমন চলছিল। প্রতিদিন, প্রতি রাতে বাঙালিয়ানার দাবি মেনে চলে যেমন। অভ্যেসের বশে এসে খেয়ালই ছিল না, গাড়ির পিছনের সিটে বসে যিনি, সুমন দূরে থাক বাংলা ভাষাটার সঙ্গেই তাঁর দূরদূরান্তে কোনও সম্পর্ক নেই। পুল্লেলা গোপীচাঁদ (Pullela Gopichand) ব্যাডমিন্টন খেলাটা দুর্ধর্ষ খেলতেন, বোঝেনও দারুণ, সাইনা-সিন্ধু নামের দুই আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টন তারকা ‘গোপী-ফ্যাক্টরি’ থেকে বেরিয়ে পৃথিবী কাঁপিয়েছেন–সর্বজনবিদিত। কিন্তু তাই বলে কবীর সুমন?
স্বাভাবিকভাবেই গাড়ির ব্লু-টুথ স্পিকারের ‘অফ’ বাটনে আঙুল চলে গিয়েছিল। কে জানত উপস্থিত দু’জনকে বিস্ময়ে বিস্ফারিত করে অনুনয় আসবে, ‘‘থাক না। চলুক গানটা। বাংলা না বুঝতে পারি, সুর তো বুঝি।’’ কী বলবেন, মহানুভবতা? অমায়িক? যে কোনও পরিস্থিতিকে মার্জিত স্বভাবগুণে সহজতর করে নেওয়ার ঐশ্বরিক ক্ষমতা? যা ইচ্ছে বলতে পারেন, চাইলে তিনটেই বলতে পারেন। যা-ই বলুন, যা-ই ভাবুন, যা-ই বিশেষণ প্রয়োগ করুন, পুল্লেলা গোপীচাঁদের অন্তরমহলে প্রবেশ করলে তাঁর একটা অবয়বই সবসময় ফুটে উঠবে। নিপাট ভদ্রলোকের!
গোপীর ঘনিষ্ঠ একজন মারফত শুনছিলাম, ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের ধ্রুবতারা নাকি চিরাচরিত ভাবে এ রকম! তাঁর নিজের বাড়িতে কেউ গেলে-টেলে গোপী আর তাঁর স্ত্রী মিলে চল্লিশ রকম পদ রেঁধে খাওয়াতে নাকি দু’বার ভাবেনন না। খাওয়ানো বাদ দিন, খাবার সার্ভ করেন রীতিমতো! স্বল্প পরিসর ঘরে নিজের বিছানায় ভাগাভাগি করে বসে-শুয়ে অতিথিদের সঙ্গে নির্ভেজাল আড্ডা দেন, হাসি-ঠাট্টা চালান দেদার, তারকাসুলভ নাক কুঁচকানির ছিটেফোঁটা না দেখিয়ে! ভাবুন তো, ভারতীয় ক্রিকেট টিমের কোচ এ জিনিস করছেন–বিশ্বাস হয়?
দেখতে গেলে, কোনও এক রবি শাস্ত্রী কিংবা রাহুল দ্রাবিড়ের চেয়ে ধারে-ভারে গোপীচাঁদ কম তো ননই, বরং কখনও কখনও বেশি। প্লেয়ার হিসেবে অল ইংল্যান্ড জিতেছেন নিজে। আর দ্রোণাচার্য হিসেবে তিনি কতটা ভাল, তা সাইনা-সিন্ধুর রেকর্ড বলে দেবে! খোলাখুলি বললে, তিনিই ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের ‘গোপী’ গায়েন, তিনিই বাঘা বায়েন, সর্বসর্বো সহজে। এবং গোপীর বন্ধুমহল থেকে শোনা গল্পগুচ্ছ শুনলে এতটুকু অতিশয়োক্তি মনে তো হয়ই না, উল্টে কিছু দৃশ্যপটে যেন বিশ্বাসের সিলমোহর পড়ে। যেমন?
যেমন, এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরে ফিরে যেতে যেতে দু’পাশে ‘ট্রেলব্লেজার্স’-এর পেল্লায় হোর্ডিং দেখে বলে ওঠা, ‘‘আচ্ছা, কতটা খরচ পড়ে এত বড় বড় হোর্ডিং দিতে?’’ যেমন, লেকটাউন ‘বিগ বেন’ দেখে অতি বিস্ময়ে বলে ওঠা, ‘‘আরে, এটা আবার এখানে কবে হল!’’ যেমন, নৈশভোজে আধা-পরিচিত কিশোরকে শশব্যস্ত হয়ে আপ্যায়ন করতে দেখে সসঙ্কোচে বলে ফেলা, ‘‘আরে, আপনিও প্লেট নিন। আপনিও খান না!’’
শহরে আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে ‘ট্রেলব্লেজার্স’ কনক্লেভ কভার করতে গিয়ে একটা বিষয় খেয়াল করেছিলাম যে, পারিপার্শ্বিক যতই বৈভব, যতই চাকচিক্যর সোচ্চার দাবি তুলুক গোপীচাঁদ তাঁর আটপৌরে ব্র্যান্ডকে কোনও শর্তে বিসর্জন দেবেন না। কী কী সব নাম ছিল কনক্লেভে, কত তার ঔজ্জ্বল্য-ছটা! অভিনব বিন্দ্রা– দেশের শ্যুটিংয়ের সোনার ছেলে, আড্ডা দিতে বসলেও ‘জেগনা’-র স্যুট ঝকঝক করে। জ্যোৎস্না চিনাপ্পা, মানু ভাকের, অঞ্জু ববি জর্জ, রানি রামপাল– প্রত্যেকে কনক্লেভে এসেছিলেন আবহের সঙ্গে নিখুঁত সামঞ্জস্য রেখে। ব্যতিক্রম শুধু তিনি, একমাত্র তিনি–স্যর গোপী। এবং গোটা অনুষ্ঠানের একমাত্র ‘স্যর’। তবে যতই সাধারণ শার্ট আর সাধারণ ট্রাউজার্সে অনুষ্ঠানে বসে থাকুন, প্রথম দিনের ডিনার পর্ব থেকে তাঁর সঙ্গে যখন যাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে, একটাই সম্বোধন এসেছে উল্টো দিকের ব্যক্তির থেকে–স্যর! এতটাই সম্মাননীয় তিনি, সম্ভ্রমের এতটাই আকর্ষক জ্যোতির্বলয় তাঁকে ঘিরে থাকে সর্বদা।
আর তাই তিনি ভাষা না বুঝলেও কবীর সুমন শোনেন। ভবিষ্যতেও শুনবেন। রাস্তায় হোর্ডিং দেখে খরচ-খরচা অক্লেশে জিজ্ঞাসা করেন। ভবিষ্যতেও করবেন। লেকটাউনের ‘বিগ বেন’ দেখে বিস্ময় তাঁর আজও অকৃত্রিম নয়। ভবিষ্যতেও থাকবে না কখনও। বাহ্যিক-জাগতিক বৈভবে তাঁর কোনও আগ্রহ নেই, থাকবেও না কখনও। কী করা যাবে, বাংলা জানুন না জানুন, বাংলার এক বিখ্যাত আপ্তবাক্য তিনি জানেন নিশ্চিত, নিজের মতো করে। স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.