সুতীর্থ চক্রবর্তী: ব্যাংক সংযুক্তিকরণের দুর্ভোগ এখন শুরু হয়েছে। সাধারণ গ্রাহক উপলব্ধি করছেন সংযুক্তিকরণের ফলে তাঁদের সমস্যা কীভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৩টা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক মিলে গিয়ে পাঁচটায় এসে দাঁড়িয়েছে। যেসব ব্যাংক সংযুক্তিকরণের পর নাম বদলে ফেলেছে, তাদের গ্রাহকের পাসবুক আপডেট আপাতত বন্ধ। মিলছে না নবগঠিত ব্যাংকের চেকও। যদি ধরেও নেওয়া হয় গ্রাহকদের দুর্ভোগ সাময়িক, সংযুক্তিকরণের ধাক্কা টের পাবেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোগপতিরা। বাজারে যখন ঋণের জোগান কমবে, তখন আসল সংকট তৈরি হবে। সেক্ষেত্রে স্পষ্ট হবে ব্যাংক সংযুক্তিকরণের প্রভাব।
কিন্তু তার চেয়ে আরও বড় বিপদ হয়ে আসতে পারে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্তটি। এবারের বাজেটে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ ঘোষণা করেছিলেন, দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বেসরকারিকরণ হবে। সদ্য চারটি মাঝারি মাপের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের নাম শোনা গেল, যাদের মধ্যে থেকে দু’টির বেসরকারিকরণ হওয়ার কথা। ব্যাংক কর্মচারীরা ইতিমধ্যে ধর্মঘটের ডাক দিয়ে দিয়েছে। তাতে কি ব্যাংকের বেসরকারিকরণ ঠেকানো সম্ভব? মনে হয় না। নির্মলা সীতারমণের বাজেটের পর যেভাবে কর্পোরেট লবি ব্যাংক বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্তকে দু’হাত তুলে স্বাগত জানিয়েছে, তাতে সরকারের পিছু হটার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নির্মলার বাজেটকে অর্থনীতিবিদদের একাংশ অতিমারীর মধ্যে ‘সাহসী বাজেট’ আখ্যা দিয়েছেন। সাহসী এই অর্থে যে, এই প্রথম বাজেটে দেশের কোনও অর্থমন্ত্রী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বেসরকারিকরণের কথা ঘোষণা করতে পারলেন।
ব্যাংক সংযুক্তিকরণের পর বেসরকারিকরণের পদক্ষেপ এমন সময় ঘোষণা করা হচ্ছে, যার অল্পদিন আগেই আমরা ব্যাংক জাতীয়করণের ৫০ বছর পালন করেছি। ব্যাংক জাতীয়করণের প্রভাব ভারতের সমাজ-জীবনে কতটা প্রসারিত ছিল, তার পরিমাপ মনে হয় অসম্ভব। জাতীয়করণের আগে পর্যন্ত ব্যাংক ‘ফেল’ করা ছিল এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। একেকটা ব্যাংক ফেল মানে, কোটি কোটি মানুষের জীবনের সমস্ত সঞ্চয় খোয়া যাওয়া। ১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৪টি ব্যাংকের জাতীয়করণ ঘোষণা করেছিলেন। এই জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত একধাক্কায় দেশের অর্থনীতির মুখচ্ছবিটাই যে বদলে দিয়েছিল, তা অস্বীকারের কোনও সুযোগ নেই। জাতীয়করণের পরেই দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল ব্যাংকিং ব্যবস্থা কী জিনিস। জাতীয়করণের পরই গ্রামে গ্রামে পৌঁছেছিল ব্যাংকের শাখা। জাতীয়করণের পরেই কৃষক থেকে শুরু করে ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের ঋণ পেতে শুরু করেছিল। যার প্রভাব অর্থনীতিতে অপরিসীম। গ্রাম ও দেশের প্রান্তিক মানুষকে মাথা তুলে দাঁড় করিয়েছিল ব্যাংক জাতীয়করণ।
ব্যাংক জাতীয়করণের সুফল অর্থনৈতিকভাবে দেশ আজও পেয়ে চলেছে। এর সামাজিক প্রভাব আজও সকলে উপলব্ধি করে। ১৯৯৯ সালে কর্ণাটকের বেলারিতে সোনিয়া গান্ধীর নির্বাচন ‘কভার’ করতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম ব্যাংক জাতীয়করণের প্রভাব শুধু দক্ষিণ ভারতের ওই গ্রামীণ এলাকায় কতটা গভীরে প্রোথিত। ভোটের প্রচার শেষ হওয়ার মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগে সোনিয়া-কন্যা প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে বেলারিতে পৌঁছন। ওই নির্বাচনে সোনিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী হাই-প্রোফাইল বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজ একমাস ধরে বেলারিতে পড়েছিলেন। সোনিয়া যখন ভোটের প্রচার শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগে বেলারি কেন্দ্রে এলেন, তখন প্রচারে কয়েকশো মাইল এগিয়ে সুষমা। কিন্তু শুধুমাত্র একটি প্রচারেই সুষমা মাত হয়ে গেলেন। কংগ্রেস শুধু গ্রামবাসীদের কাছে গিয়ে বলল, আপনাদের কাছে এসেছেন ইন্দিরা আম্মার পুত্রবধূ এবং নাতনি। ইন্দিরা আম্মা বলতে তখনও বেলারির গ্রামবাসীদের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে আসে। ইন্দিরা আম্মার নামে কেন এই ম্যাজিক? গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, ইন্দিরা আম্মাই ব্যাংক জাতীয়করণ করেছিলেন। ব্যাংক জাতীয়করণ হওয়ায় এই বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা বদলে যায়। ইন্দিরা আম্মার জন্যই মানুষকে আর চিটফান্ডে টাকা রেখে সর্বস্বান্ত হতে হয় না।
তিরিশ বছর পরেও ব্যাংক জাতীয়করণ নিয়ে মানুষের এই অন্ধ আবেগ খুব বিস্মিত করেছিল! এরপরে ২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে ‘মহামন্দা’-র সময় আমরা ফের ব্যাংক জাতীয়করণের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করেছিলাম। আমেরিকায় যখন একের পর এক বড়-বড় ব্যাংক অপরিশোধিত ঋণের জেরে উঠে যাচ্ছে, তখন ভারতে মন্দার কোনও ছাপই পড়ছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দৌলতে। যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ তৈরি করেছিল, তাকেই আজ বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে আর্থিক সংস্কারের নামে। দেশে যদি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক না থাকে, তাহলে প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে গিয়ে শাখা খুলবে কে? দেশের বড় অংশের মানুষ কি ফের ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে চলে যাবে? রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক না থাকলে ছোট ব্যবসায়ী ও কৃষকরা ঋণের জন্য কার কাছে যাবে? আবার কি তাহলে মহাজনের শোষণ ফিরে আসবে? এই প্রশ্নগুলির জবাব ছাড়াই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বেসরকারিকরণের কথা ভাবা হচ্ছে। আর, এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্তকেই একটি বড় সংস্কারি সিদ্ধান্ত হিসাবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। যেসব অর্থনীতিবিদ ব্যাংক-ব্যবস্থার সংস্কারের পদক্ষেপ হিসাবে বেসরকারিকরণের দাওয়াই দিয়েছেন, তাঁরা ‘গণ ব্যাংকিং’ নিয়ে কী ভেবেছেন, তা জানা নেই।
দেশের ব্যাংক-ব্যবস্থার সংকটের নেপথ্যে রয়েছেন যে বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার মালিক, তা প্রমাণিত সত্য। এটা কারও অজানা নয় যে, বিদেশে ফেরার ঋণখেলাপি বিজয় মালিয়া, মেহুল চোকসি, নীরব মোদি দেশের কর্পোরেট জগতেরই প্রতিনিধি ছিলেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণের ৫০ শতাংশ বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার হাতেই রয়েছে। যে ‘নন—পারফর্মিং অ্যাসেট’ তথা এনপিএ-র জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালন ব্যবস্থাকে দায়ী করা হচ্ছে, তার মূলে যে দেশের কর্পোরেট ব্যবস্থার হাত, সেকথা কেন উল্লেখ করা হচ্ছে না? যে কর্পোরেটাইজেশনের কথা বলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ হচ্ছে, সেই কর্পোরেট ব্যবস্থাই কিন্তু আজ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে দুর্বল করেছে। এ এক অদ্ভুত দুষ্টচক্র! এই চক্রকে ভাঙার চেষ্টা না-করে শুধুমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বেসরকারিকরণ আগামী দিনে ভারতের অর্থনীতির পক্ষে ভয়াবহ হতে পারে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক মানে আজও দেশের সাধারণ মানুষের একমাত্র সামাজিক সুরক্ষা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে মনে হয়, দেশের কোটি কোটি মানুষ সামাজিক নিরাপত্তার একমাত্র রক্ষাকবচ হারাতে চলেছে। দক্ষিণ ভারতের যেসব গ্রামে ২০ বছর আগে ইন্দিরা আম্মার নাম করলে লোকে ব্যাংক জাতীয়করণের কথা বলত, সেসব গ্রামে আজ দেশের প্রথম পূর্ণ সময়ের মহিলা অর্থমন্ত্রীর মুখে ব্যাংক বেসরকারিকরণের কথা কী প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে, তা জানতে বড় ইচ্ছা হয়। ঘটনাচক্রে এই অর্থমন্ত্রীও একজন দক্ষিণ ভারতীয়। ব্যাংক ফেলের যন্ত্রণা নিশ্চয়ই তিনি একটু বেশি বুঝবেন!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.