সোমবার ৭৯ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন উত্তরাধিকার-কালবেলা-কালপুরুষের রূপকার জনপ্রিয় বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার। স্মৃতিচারণে অগ্রজকে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন তাঁর অনুজ সমকালীন বাংলা সাহিত্যের মুখ প্রচেত গুপ্ত।
প্রথম দেখলাম টেলিভিশনে। এই লেখা যখন লিখছি, তখনও মানতে পারছি না। আদতে আমি যে বিশ্বাসও করি না অমন মাপের একজন লেখক, ঔপন্যাসিক কখনও প্রয়াত হতে পারেন। এমন বরিষ্ঠ লেখকের পক্ষে নেই হয়ে যাওয়া অসম্ভব। অনন্তকাল তিনি বেঁচে থাকবেন। লেখার মধ্য দিয়ে। আমি তখন অনেক ছোট। শারদীয় প্রতিদিনে প্রকাশিত হয়েছিল সমরেশ মজুমদারের (Samaresh Majumdar) আমেরিকা ভ্রমণ। নাটকের দল নিয়ে উনি আমেরিকা গিয়েছেন। তারই অভিজ্ঞতা। এখনও মনে আছে রাত দুটো পর্যন্ত জেগে লেখা গোগ্রাসে শেষ করেছিলাম।
কখনও ভেবেছিলাম অমন মাপের এক সাহিত্যিক ‘সমরেশদা’ হয়ে উঠবেন। আসলে উনিই পেরেছেন অনুজদের আপন করে নিতে। অসংখ্য স্মৃতি তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে। বেশিরভাগই লেখা সম্পর্কিত। মনে পড়ছে এক শীতের সন্ধেবেলা। আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম উত্তর কলকাতার হেদুয়া পার্কে। সাহিত্যমূলক অনুষ্ঠানে দর্শকাসনের একদম পিছনে বসে সমরেশ মজুমদার। অনুষ্ঠান তখনও শুরু হয়নি। দেখতে পেয়ে দৌড়ে গেলাম। চা এল। শুরু হল জমাটি আড্ডা। বললাম, লিখছি যেটুকু তেমন তো প্রশংসা পাই না। উনি জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমাকে প্রশংসা করে না? হাসতে হাসতে বলেছিলেন, শুধু একজন সত্যিকারের পাঠকের সমালোচনা, প্রশংসা গ্রহণ কোরো। একজন সাধারণ পাঠক যদি প্রশংসা করে অথবা সমালোচনা করেন তবে তা অভ্যাসের মধ্যে নিও। তখন আমার অল্প বয়স। বুঝতে পেরেছিলাম, বড় লেখকরা কী ভাবেন। ওঁর সেই কথা আমার কানে আজও বাজে। ‘‘পাঠক কী বলেন সেটা শোনার চেষ্টা কোরো। যদি তা শুনতে পাও তবে তা গ্রহণ কোরো।’’ সেই হাড় কাঁপানো শীতের সন্ধেটার কাছে আমি আজীবন ঋণী হয়ে থাকব।
এরপর কতবার খবরের কাগজে ওঁর সাক্ষাৎকার পড়েছি। সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় আমার নাম বলেছেন। দেখে আমার যে কী লজ্জা লাগত। বলতাম আপনি আমার মতো সামান্য একজনের..। তবু উনি শুনতেন না। এমনই তাঁর স্নেহের আধার। কতরকমভাবে উনি ভালবাসা বিলিয়ে দিতেন, সে তাঁকে না চিনলে বোঝা অসম্ভব। আর একবার লকডাউনের সময়। সকলেই ঘরবন্দি। সমরেশদাকে একদিন ফোন করলাম। অতিমারীর প্রেক্ষাপটে এক দম্পতিকে নিয়ে গল্প বলতে শুরু করলেন। একটা জায়গায় এসে আচমকা চুপ। আমি বললাম বাকিটা? বললেন, এরপর তুমি লিখবে। ভাবা যায়! কত ভালবেসে একটা আস্ত গল্পের প্লট দিয়ে দিলেন। আফসোস সেই গল্পটা লিখে তাঁকে শোনানো হল না। অমন বিখ্যাত একজন লেখক, অনুজ লেখককে একটা গল্পের কাঠামো বলে দিচ্ছেন, এটা চাট্টিখানি কথা! আজকের দিনে বারবার সেকথা মনে পড়ছে।
সালের নববর্ষের কথা। কলেজ স্ট্রিটের এক বিপণিতে দু’জনে কয়েক হাত দূরে। বসে আছি। কয়েকজন অনুরাগী ওঁর পা ছুঁতে এল। উনি কিছুতেই প্রণাম নেবেন না। বললেন, প্রণাম আবার সবাইকে করা যায় নাকি! সমরশেদা কিছুতেই প্রণাম নিতেন না। বলতেন, প্রণাম করবে শুধু মা-বাবাকে। যদি কেউ আকস্মিক প্রণাম করে ফেলত সমরেশদা তাঁকে অটোগ্রাফও দিতেন না। মৃদু রাগ করে বলতেন, তুমি প্রণাম করেছ কেন? আমি সই দেবই না।
সমরেশদা ছিলেন আড্ডাবাজ। একবার সান্ধ্য আড্ডার পরিকল্পনা চলছে। সাহিত্যিকরা তো বটেই, থাকবেন গিল্ডের কর্তারাও। আমাকে বললেন, ওইদিন কিন্তু আসতেই হবে। দেখো, আড্ডায় ফাঁকি দিও না। সমরেশদার সঙ্গে গল্প মানে অনেক কিছু শেখার। সে আড্ডায় কোনও পরনিন্দা ছিল না। অসংখ্য সাক্ষাতেও কোনও দিন কোনও অনুজ সাহিত্যিকের প্রতি কটু কথা তাঁকে বলতে শুনিনি। কাউকে ছোট করাও তাঁর রক্তমজ্জায় ছিল না। বরং উলটো। কোনও আনকোরা নতুন সাহিত্যিকের লেখা ভাল লাগলে তিনি সম্পাদক, প্রকাশকের কাছে অনুরোধ করতেন, ‘‘বড় ভাল লিখছে। ওঁর লেখা ছাপুন।’’
সমরেশ মজুমদারের সাহিত্য বিচার করার যোগ্যতা আমার নেই। তাঁর রচনাশৈলী তাঁকে সারা পৃথিবীর বাঙালি পাঠকের কাছে অমর করে রাখবে। উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, এই ট্রিলজি পড়েননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আজ মনে পড়ছে ওঁর শেষ ধারাবাহিক উপন্যাসটা। যেখানে উঠে এসেছিল ডুয়ার্সের চা বাগান, জলপাইগুড়ি। ইতিহাসে ঠাসা একটা দলিল। একেকটা সংখ্যা পড়তাম আর ওঁকে ফোন করতাম। এত সাবলীলভাবে মিশতেন, প্রশংসা যেমন করতে পারতাম, তেমনই বলতাম, ‘‘সমরেশদা লেখার এই জায়গাটা কেমন যেন লাগল।’’ এমন কথা তাঁকেই বলা যায়। কীভাবে গল্প বলতে হয়। এটা তাঁর সাহিত্য পড়ে শিখতে হয়।
লেখার বিষয় এবং প্রকাশভঙ্গি, দুই ক্ষেত্রেই সমরেশদার হাতে একটা জাদু ছিল। কোনও লেখায় কোনও চটকদার বিষয় ছিল না। স্বচ্ছন্দে একটা জীবনের কথা বলতে পারতেন। দৌড়ের মতো একটা উপন্যাস লেখা সম্ভব নয়। আমরা যাঁরা লিখতে শিখছি, যাঁরা আগামী দিনে লেখালিখির জগতে আসবেন, সকলে যেন তাঁর গল্প বলার ভঙ্গিটা বারবার দেখি। সবশেষে বলব, সমরেশদা আছেন। সমরেশদা থাকবেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.