রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: অদৃষ্টের পরপর চাবুকে নিঃস্ব একটা মুখ, আকাশের দিকে অসহায় তাকিয়ে অত রাতে কী খুঁজছে যেন। অবসন্ন শরীরটাও আর চলতে চাইছে না, বলটার মতোই বড় অবাধ্য সে, বসে পড়তে চায় মাটিতে। দু’টো আঙুল অজান্তে বিলি কাটছে সবুজ ঘাসে, দীর্ঘ সতেরো বছরের ইউরো-সফর আপাতত শেষ, অনুভূতির দেরাজে তো রেখে দিতে হবে সব। মাঝে লুকাকু (Rumelu Lukaku) এলেন। জড়িয়ে ধরলেন। চেতনা ফিরল। ক্যাপ্টেন্স আর্মব্যান্ডটাও তখনই চোখে পড়ল কি? খুলে তো ফেললেন একটানে, আছড়ে ফেললেন তীব্র আক্রোশে। টানেলে যেতে-যেতে তাতে আবার সপাটে লাথি।
শেষ, সব শেষ। আজ থেকে ইউরো কাপ থাকবে। কিন্তু আজ থেকে ইউরো কাপে আর কোনও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো থাকবে না।
আপনি ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে ভালবাসতে পারেন। আপনি ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে (Cristiano Ronaldo) ঘৃণা করতে পারেন। কিন্তু আপনি নিখাদ ফুটবল অনুরাগী হলে, পারফর্মারের পদতলে নিজেকে অর্পণ করে থাকলে, চোখের কোণে শিশিরবিন্দু নিশ্চিত টলটল করেছে গত রাতে, বার করতে হয়েছে রুমাল। পারফর্মার মহানায়ক হলে, সমর্থনের বিভাজন থাকবেই। পেলে-মারাদোনাকে নিয়ে হয়েছে। রোনাল্ডো-মেসি নিয়েও হবে। ক্যাপ্টেন্স আর্মব্যান্ডে সিআর সেভেনের সপাটে লাথি দেখে সোশ্যাল মিডিয়ার একাংশ রেগে লাল হয়ে লিখেছে, ‘তুমি দেশের ক্যাপ্টেন ক্রিশ্চিয়ানো, এ তুমি কী করলে?’ ব্রিটিশ কাগজদেরও পোয়াবারো। কিন্তু সমান্তরাল ভাবে কত বিলাপও তো ছিটকে আসছে গত রাত থেকে। চেনা, অচেনা, আধা-চেনাদের কেউ কেউ রবি-রাতে ইউরো (Euro 2020) থেকে রোনাল্ডো বিদায়ের পর কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সন্তান হারানোর শোকে। কেউ আবার প্রথমে ছুঁড়ে ফেলেছেন মোবাইল। পরক্ষণে আবার অন্য নম্বর থেকে চেনা সাংবাদিক বন্ধুকে ফোন করে আর্তনাদ করেছেন, “আচ্ছা, পর্তুগাল কি আর কোনও ভাবে কোয়ার্টারে যাবে না? আর দেখতে পাব না রোনাল্ডোকে?’
পাচ্ছেন না এরপর সেভিল স্টেডিয়ামে দাঁতে দেশের পতাকা চেপে স্থানুবৎ বসে থাকা পর্তুগিজ সমর্থকদের সঙ্গে নিজের মিল? বুঝতে পারছেন না এখনও, কতটা ভালবাসলে মানুষ এতটা পাগল হয়?
ইউরো খেলতে আসার আগে কী কী করেননি রোনাল্ডো! জুভেন্তাসকে (Juventas) চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতাতে পারেননি দেখে লোকে গালাগাল করেছে, তিনি কর্ণপাত করেননি। ইউরোর প্রথম প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিককুল তাঁর ক্লাব ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন করেছে এবং তিনি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন। বলে দিয়েছেন, ও সব পরে হবে। আগে ইউরো। ভেতরে ভেতরে আসলে ফুটছিলেন রোনাল্ডো। বলে দিয়েছিলেন, ছত্রিশেও নিজেকে অসম্ভব টগবগে লাগছে, হুবহু প্রথম ইউরোর মতো। হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে গোল শেষে জান্তব সিআর উল্লাস যার প্রামাণ্য নথি। দোষের মধ্যে রোনাল্ডো ভরসা করেছিলেন নিজের টিমকে। ভেবেছিলেন, এত নাম। এবার হয়তো দেশকে জেতানোর দায়ভার একা তাঁকে বইতে হবে না। ভুল ভেবেছিলেন। সিআর বুঝতে পারেননি, রোনাল্ডো-মেসির জীবনটা চিরকালীন ‘একা এবং কয়েক জন’। কখনওই এগারোর নয়। আর তাঁর ক্ষেত্রে সময় সময় ব্যাপারটা ‘একা এবং এক-আধ জন।’ যতই তিনি তিন জনের মধ্যে দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে পায়ে বল বসিয়ে দিন, দিয়েগো জোটারা বাইরেই মারবেন!
শেষ ভরসা ছিল নিজের দু’টো পা। কে জানত, মোক্ষম সময়ে তারাও বিশ্বাসঘাতকতা করবে! থিবাও কুর্তোয়াকে একবার তো পেয়েও গিয়েছিলেন রোনাল্ডো। কোণটা অত দূরূহ না হলে কে বলতে পারে, হয়তো সজোর ফ্রিকিকটা কুর্তোয়া বাঁচাতে পারতেন না। খেলা শেষে লুকাকু যেমন জড়িয়ে ধরেন রোনাল্ডোকে, কুর্তোয়াও তাই করেন। ভিডিওটা ভাইরাল হয়। সিআরকে দুঃখ করে বলতে শোনা যায়, “শোনো হে, বড় বাঁচা বেঁচে গেলে। বলগুলো আজ একটাও গোলে যেতে চাইল না।” শুধু ফ্রিকিক নয়। বেলজিয়াম (Belgium) বক্সে পরের পর স্পটজাম্প দিয়েও বলের নাগাল সে ভাবে পাননি রোনাল্ডো। হয় এ রকম এক এক দিন। মহানায়ককে যখন ট্র্যাজিক নায়ক বানাবে বলে ঠিক করে ফেলে ফুটবল-অদৃষ্ট। সে দিন ফ্রিকিক কিপারের হাতে যাবে। অমানুষিক লাফ দিয়েও বলে ছোঁয়ানো যাবে না মাথা। অযাচিত বিতর্কও বাঁধবে সে দিন ক্যাপ্টেন্স আর্মব্যান্ড ছুঁড়ে ফেলা নিয়ে। কেউ ভাবতে বসবে না, নিজের উপর অসীম রাগেও এটা করে থাকতে পারেন অধিনায়ক। মনে তাঁরও হতে পারে, আসল সময়ই পারলাম না, কীসের সর্বাধিনায়ক আমি?
সোমবার দুপুর দুপুর দেখা গেল, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা বিদায়ী বার্তা দিয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো। লিখেছেন, ‘যা চেয়েছিলাম, তা পাইনি। কিন্তু ছিটকে গেলেও আমরা গর্বিত। আমরা সবটুকু দিয়েছিলাম। আমরা আবার ফিরে আসব।’ ফিরে তো আসতেই হবে রোনাল্ডোকে। ফিরে আসতে হবে রোনাল্ডোর টিমকে। আজও পর্তুগাল টিমে তাঁর কোনও বিকল্প নেই। এই ছত্রিশেও ইউরো গ্রুপ পর্বে সাতানব্বইটার মধ্যে উনআশি পাসই নির্ভুল দিয়েছেন রোনাল্ডো। সমগ্র টিমে যা কেউ পারেননি। টুর্নামেন্টে পর্তুগালের সাত গোলের মধ্যে পাঁচটাই রোনাল্ডোর। ইউরোয় হয়তো এই শেষ। ‘হয়তো’ শব্দটা রাখতে হচ্ছে কারণ ফিনিক্সের মৃত্যু ঘটে না। আর দেড় বছরের মধ্যে কাতার বিশ্বকাপ আছে। ফিরে তো সেখানে আসতেই হবে তাঁকে।
এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে ফিরে আসতে হবে তাঁর অর্বুদ-অর্বুদ ‘পুজারি’দের জন্য। যাঁরা বুকের বাঁ দিকে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-জার্মানিকে জায়গা দিয়েও সযত্নে লালন-পালন করেছে আর এক ‘দেশে’-র, যার নাম ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো! ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে ফিরে আসতে হবে সেই পর্তুগিজ তরুণ-তরুণীর জন্য যাঁরা পাঁচ বছর আগে প্যারিস ফ্যানজোনে গভীর চুম্বনে হারিয়ে গিয়েছিল ‘সব পেয়েছির দেশে’, তাঁদের একটা ক্রিশ্চিয়ানো আছে ভেবে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে ফিরে আসতে হবে সেই অচেনা বাঙালি যুবকের জন্য, যিনি গত রাতে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন সাধের ফোনটাকে আছড়ে ফেলে। কাতার পর্যন্ত এঁরা কেউ ঘুমোবেন না। প্রতি রাতে ‘মৃত্যুযন্ত্রণা’ শেষেও এঁদের ‘মুক্তি’ ঘটবে না। কাতার পর্যন্ত এঁরা বেঁচে থাকবেন হৃদয়ে এক উপাসনা-সঙ্গীত নিয়ে। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ফের পড়তে চাইব তোমার পায়ের পদ্যটাই/বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি শুধু তোমাকেই চাই!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.