‘দেশপ্রেম’ আর ‘পপুলিজম’ এক নয়। শক্তিশালী নেতৃত্ব আসলে এক যৌথ নেতৃত্ব, কোনও একটি মানুষের একনায়কতন্ত্রী নেতৃত্ব নয়। দেশপ্রেমের জন্য ব্যবহৃত চিৎকৃত ভাষায় অ্যাড্রিনালিন ক্ষরিত হয়, কিন্তু জাতীয়তাবাদ সফল হয় তখনই- যখন মণিপুরের হিংসা হয় না। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন বিশেষ বিমানে বিদেশে কোথাও পৌঁছলে- সামনের সিঁড়ি দিয়ে তিনি ধীরে ধীরে নামতেন। তাঁর হাঁটুতে ব্যথা ছিল, পরে তো শল্য চিকিৎসাও হয়। ক্যামেরায় দেখা যেত, তাঁর পিছন পিছন নামছেন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ব্রজেশ মিশ্র, বিদেশমন্ত্রীর মেয়ে-জামাই, কখনও কখনও নাতনিও। রাজীব গান্ধী থেকে মনমোহন সিং, প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এই প্রথা ছিল। নিচে সে দেশের রাষ্ট্রনায়ক বা রাষ্ট্রনেতার প্রতিনিধি। পাত্র-মিত্র-অমাত্য।
সময়ের হাত ধরে এই প্রোটোকলে পরিবর্তন এসেছে। এখন আমরা কী দেখি? দেখি যে,
সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নামছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে পিছনে আর কেউ নেই। বেশিরভাগ সময় ক্যামেরায় লং শটে দেখা যায় একক মোদিকে। তা সে কেদারনাথের গুহাতে ধ্যানমগ্ন তপস্বী রূপেই হোক আর লাল কেল্লায় রেড কার্পেটের উপর হেঁটে যাওয়া। যেন একাকী নির্জন রাজা।
বিগত স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শোনার পর দেশজুড়ে নানা বিশ্লেষণ শুনছি। একপক্ষ মোদি-ভক্ত। তারা বলছে- ২০২৪ সালে তিনিই আবার বক্তৃতা দেবেন, তার চেয়েও বড় কথা- আগামী হাজার বছরের ভারত সভ্যতাকে তিনি এক নতুন পথ দেখিয়েছেন। অন্যপক্ষ কট্টর মোদি-বিরোধী। তারা বলছে, এ হল মোদির বাক্চাতুর্যে ভরা মিথ্যাভাষণ। ইংরেজিতে একে বলে ‘ডিমাগগ’। ডিমাগগের আভিধানিক অর্থ, অসত্যকে মিথ্যা আশ্বাস ও চাতুর্যের সাহায্যে আমজনতার কাছে বিশ্বাসযোগ্য ‘মিথ’ হিসাবে তুলে ধরা।
আমরা সিপিএম জমানা থেকে ‘দলতন্ত্র’ শব্দটা শুনে আসছি। কিন্তু এ হল ‘মোদি-তন্ত্র’। বিজেপি নয়, আরএসএস তথা সংঘ পরিবার নয়, এনডিএ নয়, এ হল একক মোদি-তন্ত্র। কোনও পক্ষের জার্সি গায়ে না চাপিয়ে আসুন এই মোদি-তন্ত্র প্রতিষ্ঠার রণকৌশলটির খোসা ছাড়ানোর চেষ্টা করি।
২০১৪ সালে মোদি যখন ক্ষমতাসীন হন, তখন ‘ব্র্যান্ড মোদি’-ই ছিল বিজেপির সবচেয়ে বড় নির্বাচনী অস্ত্র। মোদি যেন অরণ্যদেব বা ‘সুপারম্যান’। ‘যদা যদা হি ধর্মস্য’ আবহে এক নয়া-অবতারে আগমন। ২০১৯-এর ভোটেও ছিল ‘মোদিত্ব’। হিন্দুত্ব ও মোদিত্ব দুই মিলে এক শক্তিশালী রাষ্ট্রনেতার নেতার উদ্ভব ও অভিষেক হয়।
কর্ণাটকে কংগ্রেসের বিজয়লাভের পর বিরোধী রাজনীতির পরিসরে পরিবর্তন এসেছে। এ হল
ল’ অফ নেচার। দশ বছর পর মোদির জনপ্রিয়তায় অবক্ষয়ও হচ্ছে। কারণ কোনও নির্বাচন-ই শুধুমাত্র একটা ‘ফ্যাক্টর’ দিয়ে হয় না। এ হল নানা উপাদানের প্যাকেজ। সরকারের যোগ্যতা, কাজকর্ম, অর্থনীতি, জনদরদী প্রকল্প। কিন্তু এরপরেও ২০২৪ সালে বিজেপির প্রধান নির্বাচনী অস্ত্রের নাম যে মোদি-তন্ত্র, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, এ বছরের লালকেল্লায় তাঁর ভোট-বক্তৃতা।
আগে বলা হত, ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’। এবারও আশা দিয়ে দেশের ১৪০ কোটি মানুষকে আপন ‘পরিবার’ বলে উল্লেখ করে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- ‘ইয়ে মোদিকা গ্যারান্টি হ্যায়’। ‘মন কি বাত’ থেকে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবের জবাবি ভাষণ- সর্বত্রই এই মোদি-তন্ত্র দেখছি। বস্তুত ২০১৪ থেকেই নরেন্দ্র মোদি নিজেই নিজের বিপণনের রণকৌশল নিয়েছেন। দেশে-বিদেশে সর্বত্র। ১৫ আগস্টের এই বক্তৃতা সম্পর্কে ‘দ্য হিন্দু’-র সম্পাদকীয় বলছে, এটি মোদির সেল্ফ কনগ্র্যাচুলেটরি স্পিচ, মানে নিজেকেই শুভেচ্ছা-জ্ঞাপন।
অর্থনীতি, বিদেশনীতি, দারিদ্রমোচন, আঞ্চলিক বৈষম্য, এমনকী মণিপুর- ভক্তদের বক্তব্য, সব ক্ষেত্রেই তিনি আশার আলো দেখিয়েছেন। আর, প্রধান আক্রমণের লক্ষ্য করছেন কংগ্রেসকে। তিনি মানুষের কাছে আবার নতুন স্বপ্নের সওদাগর হতে চাইছেন। মূল্যবৃদ্ধি বা অর্থনৈতিক সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন, আবার আশ্বাসও দিয়েছেন- তিনিই এই অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যাবেন ভারতকে।
এমন ভাবার কারণ কী? আসলে, আমরা তো কেউই দুর্বল নেতৃত্ব চাই না। ভাবি, ‘স্ট্রং লিডারশিপ’ দেশকে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাবে। নরেন্দ্র মোদি বলে নন, ট্রাম্প থেকে টনি ব্লেয়ার, প্রত্যেকে নিজেকে শক্তিশালী নেতা হিসাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তবু মানুষের অসন্তোষে তাঁরাও ভোটে হেরেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি-বিষয়ক এমিরেটাস অধ্যাপক আর্চি ব্রাউন তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য মিথ অফ দ্য স্ট্রং লিডার’ বইয়ে বলেছেন- শক্তিশালী জননেতা একক নয়, যৌথ নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করবেন। বিরোধী নেতা থাকার সময় টনি ব্লেয়ার এই ‘স্ট্রং অ্যান্ড উইক’ নেতৃত্বের থিমে প্রচার চালান। তিনি প্রধানমন্ত্রী জন মেজরকে ‘দুর্বল’ আখ্যা দিতেন। প্রচার করতেন এই মর্মে যে, ‘আমি আমার দলকে নেতৃত্ব দিই আর জন মেজর দলের অন্যদের কথা অনুসরণ করেন।’ শক্তিশালী নেতা, শক্তিশালী জাতি, শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের প্রোপাগান্ডা দুনিয়া জুড়ে চলছে। তুরস্কের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট এরদোঁয়া স্বৈরাচারী হয়েও কীভাবে জিতলেন, তা আমরা দেখলাম।
এই প্রোপাগান্ডার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াকে, ডিজিটাল প্রযুক্তিকে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোসন স্ট্যানলি তাঁর বই ‘হাউ প্রোপাগান্ডা ওয়াকর্স’-এ বলেছেন- বক্তৃতার ভাষায় রাজনৈতিক মতাদর্শগত ঘোষণাকে ‘মেকানিজম’ হিসাবে ব্যবহার করেন এই তথাকথিত একনায়কতন্ত্রী নেতারা। তবে কি ‘প্রোপাগান্ডা’ অতীতে ছিল না? ছিল। মাওয়ের চিন বা স্তালিনের রাশিয়ায় এই পরিবর্তন দেখা যায়নি? দেখা গিয়েছে। তবে হালের জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমের জন্য সেই প্রোপাগান্ডা পপুলিজম যথেষ্ট নয়।
ভারতে মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে ভয়াবহভাবে। খুচরো ব্যবসার ক্ষেত্রে এই মুদ্রাস্ফীতি একমাসে বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। নীতি আয়োগের নতুন সমীক্ষা বলেছে, ভারতে দারিদ্র্য কমেছে। কিন্তু সি. রঙ্গরাজনের মতো বিশেষজ্ঞ কমিটি আবার এই পরিসংখ্যান, সংখ্যাতত্ত্ব, মানদণ্ড পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন- মানুষ কতটা খরচ করতে পারছে তার ভিত্তিতে দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অসাম্যর বিচার করা প্রয়োজন। শুধু বৃদ্ধির হার নয়, আমজনতার আর্থিক গুণগত মানের প্রকৃতি মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন।
আসন্ন ভোটে এ-দেশের গণদেবতা বলবে, মোদি-তন্ত্রে এখনও তাদের আস্থা আছে, না কি তারাও বুঝছে- দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ আর ‘পপুলিজম’ এক নয়। শক্তিশালী নেতৃত্ব আসলে এক যৌথ নেতৃত্ব, কোনও একটি মানুষের একনায়কতন্ত্রী নেতৃত্ব নয়। দেশপ্রেমের জন্য চিৎকৃত ভাষা, কথার কথকতায়, জনপ্রিয় অ্যাড্রিনালিন নিঃসরণের পপুলিজম থাকে, কিন্তু জাতীয়তাবাদ সফল হয়- যখন মণিপুরের হিংসা হয় না, যখন দেশের ভেতর আঞ্চলিক বৈষম্য তৈরি হয় না। ভারতের ভিতর যুক্তরাষ্ট্রীয় সংঘাতের বিবাদ মিটলে বিশ্বের মঞ্চেও সতি্য সতি্য ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
মূল প্রশ্ন তাই একটাই। কী চাই? গণতন্ত্র না মোদি-তন্ত্র?
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.