ছবি প্রতীকী
কিংশুক প্রামাণিক: রাহুল গান্ধীর বোধোদয় খুব সময়োপযোগী। কিছুদিন আগে ‘আমি প্রধানমন্ত্রী হব’ বলে ফেলে নিজেকে অপরিণত প্রমাণ করেছিলেন রাজীব-তনয়। অচিরেই ভুল শুধরে তিনিই বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যে কেউ হতে পারেন। আরএসএসের কেউ না হলেই হল।’ এমনকী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা মায়াবতী হলেও কংগ্রেসের যে আপত্তি নেই, তা-ও রাহুল কবুল করেছেন মহিলা সাংবাদিকদের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায়। এসব দেখে মনে হচ্ছে, অবশেষে যৌথ পরিবারের সংজ্ঞাটা অনুধাবন করেছেন রাহুল। এটাও বুঝেছেন, কংগ্রেসের সেই দাদাগিরির দিন আর নেই। বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর শক্তিও একা কংগ্রেসের নেই। তাই সবাইকে পরিবারের মতো জোটবদ্ধ হতে হবে। বড় লক্ষ্যে পৌঁছতে আত্মত্যাগ, সংযম ও লোভ পরিহার করা জরুরি। যৌথ পরিবারে একদিকে যেমন থাকে সবার সমান অধিকার, তেমনই চাই কড়া অনুশাসন। কর্তা সেখানে একজনই। হয় তিনি সবার বড়, নতুবা সর্বসম্মত। এমন মানুষকেই সবাই মিলে কর্তা করেন, সবাই মিলে তাঁকে মেনেও চলেন।
বিজেপি-বিরোধী প্রস্তাবিত বিরোধী জোটটি ঠিক এমনই হওয়া উচিত। না হলে ভাল কিছু আশা করা ভুল হবে। জোটের কর্তা কে হবেন তা ঠিক হোক ভোটের পর। আশু উদ্দেশ্য– ৫৪৩টি লোকসভা আসনে না হলেও ৭০ শতাংশ আসনে বিজেপির বিরুদ্ধে একটিই প্রার্থী দাঁড় করানো। এবং বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে বেশি করে তাদের দখলে থাকা আসন ছিনিয়ে নেওয়া। এই পরিস্থিতিতে রাহুল যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর দৌড় থেকে নিজেকে আড়ালে সরালেন তা তাঁর পরিবারের সাবেক রাজনৈতিক পাণ্ডিত্যের কথা মনে করায়। হতে পারেন তিনি মতিলাল নেহেরুর চতুর্থ প্রজন্ম, কিন্তু রাজনীতিতে এখনও পর্যন্ত কুলীন হয়ে উঠতে পারেননি। তাঁর সময়ে কংগ্রেস আরও পশ্চাদ্গমণ করেছে। এখন কোনও বড় রাজ্য কংগ্রেসের হাতে নেই। গান্ধী পরিবারের খাস তালুক উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস চতুর্থ। আমেঠি, রায়বরেলিতে জিততে গেলে অন্যের সাহায্য নিতে হবে। এই দুরবস্থা নিয়ে রাহুলকে খুব একটা চিন্তিত কখনও মনে হয়নি। মায়ের আঁচলেই তিনি বিশ্রাম নিয়েছেন। তবে সুখের কথা, ইদানীং তাঁর আচরণ ও সিদ্ধান্তে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। তাঁর টুইট-বাণ তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আরও নানা ক্ষেত্রে তাঁর চেতনার উদয় কংগ্রেসকে প্রাসঙ্গিক করে তুলছে। সংসদে অনাস্থায় দুর্নীতি ইস্যু উসকে তীব্র আক্রমণ করার পর প্রধানমন্ত্রীর আসনে গিয়ে নরেন্দ্র মোদিকে নজিরবিহীনভাবে জড়িয়ে ধরেন রাহুল। তাতে আর কিছু না হোক নজর নিজের দিকে ঘোরাতে সক্ষম হন কংগ্রেস সভাপতি। আর রাহুলের জন্য মোদিকে এই চার বছরে প্রথমবার লোকসভায় বিব্রত মনে হয়েছে। তিনি সুবক্তা। যুক্তিতে ফালাফালা করার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু জবাবি-ভাষণ শুনে মনে হয়েছে তাঁর স্মার্টনেস শুষে নিয়েছেন ইন্দিরার নাতি।
যাই হোক, জোট যে একটা হবে তা বোঝাই যাচ্ছে। প্রায় সব বিরোধী দল একমত। এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা অনেকটা। তিনি দিল্লিতে এসেছেন। জোটের লক্ষ্যেই তাঁর ঠাসা সূচি। ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডে আসার জন্য সব বিরোধী নেতৃত্বকে আমন্ত্রণ শুরু করছেন। আশার কথা, সিপিএমকে আঁকড়ে থাকা রাহুল এখন তৃণমূলের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছেন। সবটাই বিজেপি-বিরোধী জোটের পক্ষে ইতিবাচক দিক। কিন্তু কাজটা খুব সোজা হবে না। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে অনেকটা পথ পেরতে হবে বিরোধীদের। জোট হলেই বিজেপি ক্ষমতা হারাবে এমন ধারণা উপনির্বাচনগুলির পর আরও জোরদার। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। বিজেপি নির্বোধ নয়। বিনা যুদ্ধে তারা হার মানবে কেন? ভোটে জোটের মোকাবিলা করতে হবে ধরে নিয়ে নানা কৌশল নিতে শুরু করেছে গেরুয়া শিবির। ট্রাম্প কার্ড সেই হিন্দুত্বই। সেটা কিন্তু তারা খেলতে শুরু করেছে। অসমের ঘটনা ভারতের ইতিহাসে নজিরবিহীন। আধার কার্ড আছে অথচ নাগরিকত্ব নেই। আশ্চর্য কাণ্ড ঘটিয়ে দিয়েছে অসমের বিজেপি সরকার। সবটাই মেরুকরণের রাজনীতি। এখন অসমই বিজেপির মডেল। খুব অঙ্ক কষে করা।
অতঃপর মনে হয়, মোদিকে ক্ষমতাচ্যুত করা খুব সোজা হবে না। লিখে দেওয়া যায় ওসব ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ বা ‘অচ্ছে দিন’-এর স্লোগান নয়, লোকসভা ভোটে মেরুকরণেই জোর দেবে বিজেপি। উত্তরপ্রদেশ-সহ ‘কাউ জোন’-এ যা শুরু হয়ে গিয়েছে। দলিত হত্যার পর, গোরক্ষা, গণপ্রহারের ঘটনা, মেরুকরণ আরও নিশ্চিত করে তুলেছে। অসম-কাণ্ড প্রমাণ করল বিজেপি কী চায়। ৪০০ মিটার দৌড়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে অসমের মেয়ে হিমা দাস তাঁর রাজ্যকে বিশ্ববন্দিত করেছিলেন। আর সেই রাজ্যের ৪০ লক্ষ মানুষকে নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ দিয়ে বিজেপি দেখিয়ে দিল ক্ষমতার জন্য তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এ এক ভোটের মেরুকরণ। সবাই নিন্দা করছে। বিজেপি কিন্তু হাসছে। কারণ, এই সিদ্ধান্তের পর লোকসভা ভোটে যদি অসমের ১৪টি আসনের ১০-১২টি বিজেপি পেয়ে যায়, তাহলে অবাক হওয়ার থাকবে না। এটা যে মেরুকরণের খেলা সেটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের কথা শুনলেই বোঝা যাবে। তিনি বলেছেন, ‘ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। কাউকে অসম থেকে উচ্ছেদ করা হবে না।’ অর্থাৎ মেরুকরণ নিশ্চিত করে নাগরিকপঞ্জিটা খুড়োর কলের মতো ঝুলিয়ে দেওয়া হল। ৪০ লক্ষ মানুষ এখন সেখানে ছাগলের তৃতীয় ছানা।
[দেশে প্রতি ঘণ্টায় ৮টি শিশু নিখোঁজ হয়]
একইভাবে বাংলাতেও বিজেপি মেরুকরণের আপ্রাণ চেষ্টা করবে লোকসভা ভোটে। সেটা হবে হয়তো অন্য কোনও কায়দায়। সব মিলিয়ে তাদের লক্ষ্য, যেনতেনপ্রকারে আবার ক্ষমতায় ফেরা। যত খারাপই হোক, অন্তত ২০০ আসন জিততে মরিয়া হবে বিজেপি। তাতে সরকার গঠনের চাবি থাকবে হাতে। দর কষাকষির খেলায় তখন দু’টো লক্ষ্য হবে। এক, এনডিএ-তে নানা টোপ দিয়ে মায়াবতী, চন্দ্রবাবু নায়ডু, চন্দ্রশেখর রাও, এমনকী ডিএমকে-কে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। এবং আবার মোদিকে প্রধানমন্ত্রী বানানো। ‘প্ল্যান এ’ সফল না হলে বিজেপির দ্বিতীয় লক্ষ্য, নিজে সরকার বানাতে না পারলেও যে কোনওভাবে রাহুল গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্ব রোখা। কারণ, কংগ্রেস সর্বভারতীয় দল। তাদের উত্থান একদম নয়। সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক দল থেকে কেউ ‘সেভেন কল্যাণ মার্গ’-এ আসতেই পারে। সেটা বিজেপির কাছে মন্দের ভাল। সম্ভবত রাহুল এই সত্যটা বুঝেছেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বে বাধা আসবেই। তাই সুবোধ বালকের মতো নিজেকে এই দৌড় থেকে দূরে সরিয়েছেন। এটা তাঁর দিক থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত। কারণ, কংগ্রেসকে বাঁচতে হলে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। আগে বিজেপি হারুক, তারপর প্রধানমন্ত্রিত্ব।
অতএব বলা যায় লোকসভা ভোটের আগে জাতীয় রাজনীতি এক সন্ধিক্ষণে উপস্থিত। লড়াই তীব্র। বিরোধীদের কাজটাই বেশি শক্ত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.