দেশজুড়ে কোটার নামে চলছে রাজনীতি। মণিপুরে জ্বলছে আগুন। তফসিলি জাতি থেকে তফসিলি উপজাতি হওয়ার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায়। যার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে আদিবাসী কুকিরা। সংরক্ষণ এখন ভোটব্যাংক রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার। ভোটব্যাংকের পলিটিক্স জাতিদাঙ্গার রূপ পেলে রক্তক্ষয় তো ঘটেই! লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
দেশের সংরক্ষণ ব্যবস্থা ফিরে দেখা প্রয়োজন– এই মন্তব্য করে একবার ঘোর বিপাকে পড়েছিলেন সংঘ-প্রধান মোহন ভাগবত। বিহার বিধানসভা ভোটের আগে ভাগবতের এই উক্তি ভরাডুবি ঘটিয়েছিল বিজেপির। ভাগবতের মন্তব্যকে প্রচারে হাতিয়ার করেছিলেন লালুপ্রসাদ যাদব। সরকারের কর্মসূচিতে সংরক্ষণ তুলে দেওয়ার মতো কোনও অ্যাজেন্ডা নেই, প্রতিটি সভায় নিয়ম করে এ-কথা বলেও নরেন্দ্র মোদি (PM Modi) ভোটারদের আস্থা জয় করতে পারেননি। তবে দেশজুড়ে ‘কোটা’র নামে রাজনীতি যে জায়গায় পৌঁছতে চলেছে, তাতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা ফিরে দেখার প্রয়োজনীয়তা এখন অনেকেই মনে করতে শুরু করেছে।
সংঘ পরিবার বরাবর নিম্নবর্গের সংরক্ষণের বিরোধিতা করে। তা বলে এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, বিজেপি (BJP) সংরক্ষণ নিয়ে রাজনীতি করতে পিছপা। সম্প্রতি কর্ণাটকেও বাজিমাত করতে বিজেপি সংরক্ষণকে হাতিয়ার করার চেষ্টা করেছিল। সেই রাজ্যে ওবিসি মুসলিমদের চার শতাংশ সংরক্ষণ তুলে দিয়ে সেটা দুই শতাংশ করে ভাগ করে দিয়েছিল ভোক্কালিগা ও লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের মধ্যে। বিজেপির এই রাজনীতি অবশ্য ভোটে কাজে আসেনি। ভোক্কালিগা ও লিঙ্গায়েত– দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিজেপির ভোট কমেছে। সংরক্ষণ উঠে যাওয়ায় কর্ণাটকের পিছিয়ে পড়া মুসলিমরা তো ক্ষিপ্ত হয়েই ছিল।
অগ্নিগর্ভ মণিপুর সংরক্ষণ নিয়ে ভেবে দেখার প্রশ্নটিকে ফের গোটা দেশের সামনে নিয়ে এসেছে। মণিপুরের আগুন কিছুতেই থামতে চাইছে না। টানা প্রায় একমাস ধরে পাহাড়ি রাজ্যটিতে আগুন জ্বলছে। শতাধিক মানুষের প্রাণ গিয়েছে। তফসিলি জাতি থেকে তফসিলি উপজাতি হওয়ার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায়। যার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে আদিবাসী কুকি-রা। মেইতেইরা ‘এসসি’ তালিকা থেকে ‘এসটি’ তালিকায় গেলে চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে তাদের কোটায় ভাগ বসাবে বলেই কুকি, নাগা আদিবাসীদের আপত্তি।
যুব সমাজের চাকরি না পাওয়ার হতাশাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতেই যে রাজনৈতিক দলগুলি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের যুবকের সংরক্ষণ বা কোটা পাওয়ার প্রত্যাশাকে উসকে দিচ্ছে, বলার অপেক্ষা রাখে না। এরকম কোটার দাবিতে আন্দোলন রাজ্যে রাজ্যে ঘটছে। ভোট সামনে এলেই এগুলি মাথাচাড়া দেয়। গুজরাটে ওবিসি সংরক্ষণ পাওয়ার জন্য প্যাটেলদের আন্দোলন মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। হরিয়ানায় জাঠ, রাজস্থানে গুর্জর, মহারাষ্ট্রে মারাঠা, অন্ধ্রপ্রদেশে কপু সম্প্রদায়, ইত্যাদি বিভিন্ন রাজ্যে আমরা এই ধরনের আন্দোলন দেখতে পাই। পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি কুড়মিরাও একই ধরনের আন্দোলন শুরু করেছে। মণিপুরে তফসিলি সম্প্রদায়ের মেইতেইরা যেমন তফসিলি উপজাতি হতে চাইছে, বাংলায় কুড়মিরাও তেমন তফসিলি জাতি থেকে তফসিলি উপজাতি হতে চাইছে। ১৯৩১ সাল পর্যন্ত তারা ‘এসটি’ তালিকাতেই ছিল বলে কুড়মিদের দাবি। মণিপুরের প্রসঙ্গ টেনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাতেও একটা জাতিদাঙ্গার পরিবেশ তৈরির চক্রান্ত চলছে।
মণিপুরের পরিস্থিতির সঙ্গে এখনও বাংলার অবস্থার সাযুজ্য নেই। তবে রাজনৈতিক দলগুলির ভোটব্যাংকের পলিটিক্স যে কখন কোন পরিস্থিতির জন্ম দিয়ে দেয়, তা আগাম বলা যায় না। মণিপুরে কুকি আদিবাসীদের বনাঞ্চল থেকে উচ্ছেদের ঘটনা সাম্প্রতিক গন্ডগোলে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী মেইতেই সম্প্রদায়ের, সেখানকার আমলারাও অধিকাংশ মেইতেই। রাজ্য সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পরিধি ক্রমশ সম্প্রসারিত করে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করছে বলে কুকিদের সেখানকার বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ। কুকি সম্প্রদায়ের এক বিজেপি বিধায়কের নেতৃত্বেই সেই আন্দোলন চলছিল। বাংলার জঙ্গলমহলে অবশ্য আদিবাসীদের জমি ও বনাঞ্চল থেকে উচ্ছেদের আশঙ্কা নেই। আদিবাসীদের জমি থেকে যে কোনওভাবেই উচ্ছেদ করা হবে না, তা ফের আশ্বস্ত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মণিপুরের মতো জাতপাতের উত্তেজনা এখনও বাংলায় নেই। কিন্তু কোথাকার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, তা আগাম বলা যায় না।
সংবিধান-প্রণেতারা সংরক্ষণকে দেখেছিলেন জাতপাত ব্যবস্থার ঐতিহাসিক ভুলের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার হাতিয়ার হিসাবে। সংরক্ষণ পিছিয়ে পড়া অংশকে তুলে এনে একটা এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে, যেখানে সবার ক্ষেত্রে সুযোগ গ্রহণের সমান অবস্থা থাকবে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সংরক্ষণের সেই উদ্দেশ্য অর্জন করা যায়নি। সংরক্ষণ ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতে পারেনি। বরং সংরক্ষণ এখন ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ১৯৯০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভি. পি. সিং ‘মণ্ডল কমিশন’-এর প্রস্তাব গ্রহণ করার পর থেকেই বোঝা গিয়েছে সংরক্ষণ ভোটের রাজনীতিতে কত শক্তিশালী অস্ত্র। বস্তুত, নয়ের দশক থেকে দেশে এমন কোনও ভোট মিলবে না যেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংরক্ষণের বিষয়টি সামনে আসেনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংরক্ষণকে ব্যবহার করে ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতি করার চেষ্টা করেছে। কখনও সেটা সফল হয়েছে। কখনও সফল হয়নি। ২০১৫ সালে বিহারে লালুপ্রসাদ যাদব-নীতীশ কুমাররা সংরক্ষণ ইস্যুকে ভোটে সফলভাবে ব্যবহার করেছেন। আবার ২০১৭-য় গুজরাটে হার্দিক প্যাটেলরা সংরক্ষণ ইস্যুকে ব্যবহার করেও কংগ্রেসের জয়ের রাস্তা খুলতে পারেনি।
রাজ্যে অন্তত চারটি লোকসভা কেন্দ্রের ক্ষেত্রে কুড়মি ‘ভোট ফ্যাক্টর’ বলা হয়ে থাকে। এবারের কুড়মি আন্দোলনে সেই বিষয়টি কোনও রাজনৈতিক দলের নজরে রয়েছে কি না, তা বলা যায় না। মণিপুরে মেইতেই ভোটব্যাংক রক্ষা করতে গন্ডগোলে বিজেপির ভূমিকা রয়েছে বলে বিরোধী দলগুলির অভিযোগ আছে। লোকসভা ভোটের আগে আরও কোন কোন রাজ্যে এই ধরনের সংরক্ষণের দাবি মাথাচাড়া দেবে, জানা নেই। ভোটব্যাংকের পলিটিক্স জাতিদাঙ্গার রূপ পেলে রক্তক্ষয় ঘটে। সংরক্ষণ যখন কাজের কাজ না করতে পেরে শুধুমাত্র ভোটব্যাংকের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, তখন এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সমীক্ষা হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.