দুলাল দে: শরদ পাওয়ার (Sharad Pawar) তখনও বিসিসিআইয়ের (BCCI) মসনদে বসেননি। তখন ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন প্রয়াত প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি (Priya Ranjan Dasmunsi)। ডিসেম্বরের এক রাতে দিল্লিতে তাঁর বাসভবনে বসে বলছিলেন, “শরদ পাওয়ার এলে বিসিসিআই খুব ভাল চালাবে।”
——সেই রাজনীতির লোক..।
হেসে বলেছিলেন, “শোন, এদেশে রাজনৈতিক লোক ছাড়া কোনও কিছু হবে না। এই যে ভারতীয় দল হঠাৎ করে বিদেশে যাবে। কোনও রাজনৈতিক কানেকশন না থাকলে ফুটবলাররা তাড়াতাড়ি ভিসা পর্যন্ত পাবে না।”
দেবাশিস দত্তর নেতৃত্বে মোহনবাগান (Mohun Bagan) ক্লাবের নতুন কমিটি নির্বাচিত হয়েছে ২৪ মার্চ। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও কি ক্লাব চত্বরের ভিতর দেখা গিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও প্রশাসনিক সভা? কিংবা তৃণমূলের কোনও ছোটখাটো মিটিং? কিংবা তৃণমূলের পতাকার দাপাদাপি?
তৃণমূল ছেড়েই দিন। সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি, কোনও রাজনৈতিক পার্টির কি কোনওরকম আস্ফালন দেখা গিয়েছে সবুজ—মেরুন লনে? তা হলে নতুন কমিটি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই হঠাৎ করে কিছু মানুষ মোহনবাগান ক্লাবে রাজনৈতিক প্রভাব দেখাতে শুরু করলেন কীভাবে? তা হলে কি ময়দানের কোনও ক্লাব কমিটিতে এই প্রথম কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রবেশ?
হয় আপনি ইচ্ছে করে ইতিহাস বিস্মৃত হতে চাইছেন। অথবা কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক প্রচার করে পরিস্থিতিকে ঘোরালো করতে চাইছেন।
যত দূর জানি, মোহনবাগান ক্লাবের সংবিধানে এরকম কিছু লেখা নেই, যেখানে তিনজন তৃণমূল, দু’জন কংগ্রেস, একজন বিজেপি, চারজন সিপিএম পার্টি থেকে কমিটিতে নিতে হবে। মোহনবাগান কমিটিতে আসার একমাত্র শর্তই হচ্ছে, তাঁকে মোহনবাগানের সদস্য হবে। তিনি হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, নাকি তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম? মোহনবাগান কমিটিতে সুযোগ পাওয়ার জন্য এগুলি কোনও যোগ্যতাই হতে পারে না। সবুজ—মেরুনের মূল গেট, যা কিছুদিন পরেই চুনী গোস্বামীর নামাঙ্কিত হবে, সেই গেট পেরিয়ে কোনও সদস্যের ক্লাবে ঢুকে পড়ার পর তাঁর প্রতীকী রং একটাই। সবুজ—মেরুন। তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক সত্তা, বা ধর্ম, সব কিছুই মোহনবাগান ক্লাবের গেটের বাইরে। তিনি মোহনবাগানি। এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। শতবর্ষ ধরে বহু গুনী মানুষ নক্ষত্রের মতো মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গলে বিভিন্নভাবে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এই দুই ক্লাব হচ্ছে বাঙালির সূর্য। যেখানে এসে ব্যাপ্তিতে অনেক বড় নক্ষত্রও মিশে যান।
মোহনবাগান কমিটির নির্বাচিত কিংবা মনোনীত কোনও সদস্যকে আপনার পছন্দ না—ই হতে পারে। এক্ষেত্রে আপনার পছন্দ, বা অপছন্দ নির্ভর করতে পারে শুধুমাত্র ব্যক্তিটির যোগ্যতার উপর। আপনার মনে হতেই পারে, ব্যক্তিটি সেই পদের যোগ্য নন। তা হলে আপনি নির্বাচনে আসীন হয়ে তাঁকে হারিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু আপনি কিছুই করলেন না। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুধু প্রচার করে গেলেন, মনোনীত কিংবা নির্বাচিত ব্যক্তিটি তৃণমূলের বলে তাঁর মোহনবাগানি হওয়ার অধিকার নেই। এরকমটা হয় না কি?
প্রতিটি বাঙালি জ্ঞান হওয়ার পরই হয় মোহনবাগান, না হয় ইস্টবেঙ্গল, না হলে মহামেডান। তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা তৈরি হয় অনেক পরে। তা হলে কি যে মুহূর্তে কোনও ব্যক্তি তাঁর রাজনৈতিক চেতনায় আবিষ্ট হবেন, সেই মুহূর্তে তাঁর ক্লাব—প্রেম বর্জন করতে হবে?
আর ব্যাপারটা তো এরকম নয়। ১৮৮৫—তে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হওয়ার ঠিক চার বছর পরই প্রতিষ্ঠিত হয় মোহনবাগান ক্লাব। সেই সময় অনেক ক্লাব থাকলেও বাঙালি তখন জাতীয়তাবাদের আবেগে তাড়িত মোহনবাগান ক্লাব ঘিরে। বিখ্যাত আইনজীবী ভূপেন্দ্রনাথ বসু হলেন ক্লাবের প্রথম সভাপতি। পাশাপাশি তিনিও তখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। ১৯১৪—তে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতিও হলেন। তা হলে আদ্যোপান্ত কংগ্রেসি মনোভাবাপন্ন ভূপেন্দ্রনাথ বসু যখন মোহনবাগানের সভাপতি হলেন, ক্লাব তাঁবুকে কি কংগ্রেসের পার্টি অফিস বানিয়েছিলেন?
আজকের দিনে এরকম কোনও প্রতিষ্ঠিত নেতা যদি মোহনবাগান ক্লাবের সভাপতি বা অন্য কোনও পদে বসতেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় উঠে যেত! পরবর্তী ক্ষেত্রে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী যখন মোহনবাগানের কার্যকরী কমিটিতে ছিলেন, তিনি কি ক্লাবে তাঁর পার্টির প্রচার করতেন?
পাশের ক্লাবের দিকেই তাকান না। সিপিএম বিধায়ক শচীন সেন একদা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সচিব ছিলেন। সিপিএম বিধায়ক মানস মুখোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সহ—সভাপতি ছিলেন। একবারের জন্যও এরকম অভিযোগ ওঠেনি যে, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে সিপিএম নিয়ন্ত্রণ করছে। বরং কমিটিতে না এসেও সেই সময়ের ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী, আরএসপির ক্ষিতি গোস্বামী নানাভাবে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে সাহায্য করেছেন। পুরোটাই ক্লাব প্রেম থেকে। এর পিছনে কোনও রাজনৈতিক রং ছিল না। তিনি কখনও নির্বাচনে দাঁড়াননি। কিন্তু কংগ্রেস, পরবর্তীতে তৃণমূল নেতা প্রয়াত সোমেন মিত্রর নাম বরাবর জড়িয়েছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের নির্বাচনে। কিন্তু ক্লাবের অভ্যন্তরীণ পরিচালন পদ্ধতিতে কখনও তার প্রভাব পড়েনি। তা হলে মোহনবাগানে তিন সহ—সভাপতি অরূপ রায়, মলয় ঘটক, কুণাল ঘোষ এবং ফুটবল সচিব পদে স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম দেখে ক্লাবের ভিতর তৃণমূল ঢুকে পড়ল, এরকম ভাবনা কেন?
মহামেডানের আনোয়ার আলির কথা ভুলে গেলেন? একদা প্রভাবশালী প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মহামেডানের সভাপতি ছিলেন। পরবর্তী ক্ষেত্রে ফরোয়ার্ড ব্লকের কলিমুদ্দিন শামসও মহামেডানের সভাপতি। মহামেডানে সুলতান আহমেদ কিংবা ইকবাল আহমেদের নামও ভুলে গেলেন! তো হঠাৎ করে শুধুই মোহনবাগান ক্লাবে রাজনৈতিক দাপাদাপি কীভাবে খুঁজে পেলেন?
‘মোহনবাগানি’ মলয় ঘটক কিংবা অরূপ রায় তো এই প্রথম নন। এর আগেও ছিলেন। ক্রীড়ামন্ত্রী হওয়ার আগে অরূপ বিশ্বাসও ছিলেন মোহনবাগানের সহ—সভাপতি। ছিলেন প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও। এবার সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের জায়গায় সংযোজন হয়েছে কুণাল ঘোষের নাম। সোমেশ্বর বাগুইকে দেখে তো কেউ বলছেন না, কংগ্রেস নেতা ক্লাবে ঢুকে পড়েছেন!
একইভাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়ের কাছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব কর্তাদের সাহায্য চাওয়াটাও অত্যন্ত পজিটিভভাবেই দেখা উচিত। ইস্টবেঙ্গল—মোহনবাগান—মহামেডানের মতো ক্লাবগুলি কোনও সমস্যায় পড়লে মুখ্যমন্ত্রীর কাছেই তো দরবার করবে। তিনিই তো অভিভাবক। তিন প্রধানের সমস্যায় মুখ্যমন্ত্রী পাশে থাকবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। এর মধ্যে রাজনীতির রং কোথায়? যদি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের লনে তৃণমূলের পতাকা উত্তোলিত হত, তা হলে না হয় তৃণমূলের দাপট বলা যেত। একই কথা প্রযোজ্য মোহনবাগানেও। কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা, এই তকমাটা কোনও ব্যক্তির মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান ক্লাবের কর্তা হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্যতা হতে পারে না। মাপকাঠি একটাই হওয়া উচিত, তিনি কর্তা হওয়ার যোগ্য, না অযোগ্য।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.