যদি ‘গুজরাট মডেল’ দেশের অর্থনীতি ও সুশাসনের ক্ষেত্রে একটি সফল মডেলই হয়, তাহলে সেখানে ভোটে জিততে কেন মোদি-শাহদের মেরুকরণের তাস ও ইস্তাহারে বিপুল খয়রাতি ঘোষণার উপর নির্ভর করতে হবে? কেনই বা আপ-এর মতো একটি দল কত ভোট কাটবে, তার হিসাবনিকাশ চালাতে হবে? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
পাঁচ বছর আগে গুজরাট বিধানসভা ভোটের প্রচারে রাহুল গান্ধী যখন মন্দিরে-মন্দিরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তখন তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন অধুনা প্রয়াত অরুণ জেটলি। তৎকালীন বিজেপির ওই অন্যতম শীর্ষনেতা বিরোধী দলকে কিছুটা পরামর্শ দেওয়ার সুরেই বলেছিলেন, ‘নরম হিন্দুত্বের কার্ড খেলে রাহুল আসলে সুবিধা করে দিচ্ছেন আমাদেরই। হিন্দুত্বের ভাবাবেগে মানুষ ভোট দিলে আর কংগ্রেসকে বাছবে কেন, সরাসরি বিজেপিকেই ভোট দেবে।’ ভোটের ফল বেরনোর পর দেখা গেল জেটলি ঠিক কথাই বলেছিলেন। হিন্দু ভোট বাড়াতে রাহুলের চাল কাজে দেয়নি। বরং বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছিল। কারণ রাহুলের ওই নরম হিন্দুত্বের প্রচারে সরকার বিরোধিতার অভিমুখ কিছুটা হলেও ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল।
২০০২-এর দাঙ্গার পর গুজরাটে মেরুকরণ স্পষ্ট। ১০ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলিম ভোট হাত চিহ্নের বাইরে কোথাও পড়ে না। লড়াইটা বাকি ৯০ শতাংশ হিন্দু ভোট নিয়ে হলেও, তার সিংহভাগ চলে যায় বিজেপির বাক্সে। ২০১৭-তে হিন্দু ভোট বাড়ানোর লক্ষ্যেই মন্দিরে মন্দিরে ঘুরেছিলেন রাহুল। রাজনৈতিক মহলে চর্চার কেন্দ্রে ছিল রাহুলের নরম হিন্দুত্ব। গতবারের ভুল এবার কংগ্রেস করতে চাইছে না। মোরবির সেতুভঙ্গ, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, শ্রমিকদের মজুরি ইত্যাদি ইস্যুতে এবার তারা সরকার-বিরোধী প্রচারের সূচিমুখ আরও তীক্ষ্ণ করতে সচেষ্ট। ধর্মের ইস্যুতে না গিয়ে তারা বিজেপির সঙ্গে পাঙ্গা নিতে চাইছে অর্থনীতি ও সুশাসনের প্রশ্নে। কংগ্রেসের এই সরকার-বিরোধী প্রচারের মোকাবিলায় বিজেপির কৌশল যে মেরুকরণ-ই, তা স্পষ্ট করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। আসলে ২৭ বছর ধরে বিজেপির উন্নয়নের আখ্যান শুনে শুনে যে গুজরাটের মানুষ ক্লান্ত, সেটা নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের চেয়ে আর ভাল বুঝবেন কে?
সহকর্মী-সাংবাদিক বুদ্ধদেব সেনগুপ্ত গুজরাট চষে বেড়াচ্ছেন। ওঁর কাছেই জানতে পারলাম, মোরবির মতো ছোট শিল্প শহরে রাস্তার ধারের রেস্তরাঁতেও একটা হাতরুটির দাম ৪০ টাকা। অসম্ভব মূল্যবৃদ্ধিই ভোটে প্রধান ইস্যু। গত অক্টোবরে মাসে করা লোকনীতি-সিএসডিএসের সমীক্ষা জানাচ্ছে, ৫১ শতাংশ উত্তরদাতা-ই মূল্যবৃদ্ধিকে প্রধান চিন্তার বিষয় বলছেন (সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে)। জিনিসপত্রর এত দাম, অথচ রাজ্যের বিরাট সংখ্যক শিল্পশ্রমিকের আয় মাসে আট থেকে দশ হাজারের বেশি নয়। নরেন্দ্র মোদির উন্নয়নের মডেলে গুজরাটে কিছু কলকারখানা হলেও শ্রমিক শোষণ এক চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছেছে। স্থায়ী চাকরি বলে কিছু নেই। ঠিকাদারের অধীনে কারখানায় চুক্তিতে কাজ। যেখানে মাসে আট-দশ হাজারের বেশি কেউ বেতন দিতে রাজি নয়। গুজরাটের অনুর্বর জমিতে কৃষিতে আায় তো ঐতিহাসিকভাবেই কম। আহমেদাবাদের চাকচিক্য ও কিছু ছোটখাটো কারখানার অস্তিত্ব দিয়ে তথাকথিত ‘গুজরাট মডেল’ দেশের অন্যত্র এতদিন বিক্রি হলেও, তা দিয়ে যে রাজ্যে ভোট টানা মুশকিল, তা মোদি-শাহরা যথার্থই উপলব্ধি করেন। এবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো নেমে এসেছে মোরবির সেতুভঙ্গ। ৩০ অক্টোবর মোরবিতে সেতু ভেঙে ১৫০ জনের মৃত্যুর আগে মোদি গোটা রাজ্য তিনবার পাক খেয়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকার নতুন প্রকল্প উদ্বোধন সেরে ফেলেছিলেন। সেসব-ই ভাঙা মোরবি সেতুর সঙ্গে মাচ্ছু নদীর জলে ভেসে গিয়েছে ধরে নিয়েই মেরুকরণকে হাতিয়ার করে নতুনভাবে প্রচারের কৌশল সাজিয়েছেন মোদি-শাহ।
‘২০০২ সালে ওদের উচিত শিক্ষা দেওয়ায় রাজ্যে পাকাপাকি ভাবে শান্তি এসেছে’- গুজরাটের প্রচারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গলায় এই মন্তব্য শুনে শোরগোল পড়ে গিয়েছে দেশে। কিন্তু শাহ যে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবেই গোধরার দাঙ্গার স্মৃতিকে উসকে দিতে চাইছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০০২-এর শিক্ষা কী? মিম-প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি গুজরাটে ভোটের প্রচারেই ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘২০০২-এর দাঙ্গায় বিলকিস বানোকে যারা ধর্ষণ করেছিল, তাদের মুক্তি পাওয়া, গুলবার্গ সোসাইটির হত্যাকাণ্ড, এহসান জাফরিকে পুড়িয়ে খুন করা, বেস্ট বেকারিতে আগুন লাগা– এসব অমিত শাহদের দেওয়া শিক্ষা।’ শহুরে মধ্যবিত্ত হিন্দু-ভোট টানতে এভাবেই লাগাতার গোধরার স্মৃতি উসকে দিয়ে আসছেন শাহ-মোদিরা।
২০০৭-এর গুজরাট বিধানসভা ভোটের প্রচারে খোদ মোদির (Narendra Modi) ভাষণে এই ধরনের মন্তব্য শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছিল এই প্রতিবেদকের। আহমেদাবাদ শহরে এসে প্রচারে মোদি বললেন, ‘কাল্লু-মাল্লুদের রাজ আহমেদাবাদ শহরে আমরাই খতম করেছি।’ মোদি তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। গুজরাটি ভাষায় দেওয়া ভাষণে মোদি এই মন্তব্য করতেই শ্রোতাদের মধ্যে তুমুল হর্ষধ্বনি দেখা গেল। পাশে বসে থাকা গুজরাটি সাংবাদিক অনুবাদ করে দিলেন মোদির বক্তব্য। আসলে প্রতি ভোটেই আস্তিন থেকে শহরবাসীর কাছে এই নিরাপত্তার তাসটি বের করেন মোদি-শাহরা। নীতি আয়োগের হিসাবে, গুজরাটের ৪৪.৫ শতাংশ মানুষ শহরের বাসিন্দা। গত বিধানসভা ভোটে গুজরাটের শহরকেন্দ্রিক তথা আহমেদাবাদ, সুরাত, বরোদা, রাজকোটের মতো বড় শহরের ৫৮টি আসনের মধ্যে ৪৪টি জিতেছিল বিজেপি। বিজেপির বাকি ৫৫টি আসন এসেছিল আধা-শহর ও গ্রামীণ এলাকা থেকে। এই আধা-শহর ও গ্রামীণ এলাকায় কংগ্রেস জিতেছিল ৬৩টি আসন। অর্থাৎ, মূল্যবৃদ্ধির বাজারে এবার শহরের ভোট ধরে রাখা কতখানি বড় চ্যালেঞ্জ মোদি-শাহদের কাছে!
২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গার সেই মুখ, যাঁকে বহুজাতিক সংবাদসংস্থার ছবিতে দেখা গিয়েছিল মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বেঁধে দু’হাতে তলোয়ার তুলে ধরে উল্লাস করতে, সে-ই অশোক পারমারের ঠিকানা এখন আহমেদাবাদ শহরের ফুটপাতে। ভোটের আগে সাংবাদিকরা তাঁর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। পারমার মোদি-শাহর বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। দাঙ্গায় যে তাঁর মতো গরিব মানুষের কোনও লাভ হয় না, জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পেরেছেন পারমার। তবে পারমারের এই কণ্ঠস্বর গুজরাটের ভোটারদের মনে আদৌ দাগ কাটতে পারছে কি না, তা টের পাওয়ার সুযোগ এখনও ঘটেনি। কিন্তু মোদি-শাহদের মেরুকরণের উদ্যোগকে যে পুষ্ট করে চলেছেন আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল, তা নিয়ে সংশয় নেই। গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কংগ্রেস নরম হিন্দুত্বের পথ এবার এড়িয়ে চললেও, কেজরিওয়াল হিন্দুত্বকে গুজরাট ভোটের প্রচারে উচ্চগ্রামে নিয়ে গিয়েছেন। নিজেকে হিন্দুত্ববাদী বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করছেন। ইস্তাহারে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, ভোটে জিতলে সবাইকে অযোধ্যায় রাম মন্দির দেখাতে নিয়ে যাওয়ার। দাবি করছেন নোটের উপর লক্ষ্মী-গণেশের ছবি ছাপার। গুজরাটের ভোটের প্রেক্ষিতে কেজরিওয়াল কি এবার গতবারের রাহুলের ভূমিকায় থাকতে চাইছেন? যাতে হিন্দুদের বড় রক্ষক কে- এই প্রশ্নে কেজরিওয়ালকে বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে মোদি-শাহরা দশ গোল দিতে পারেন!
গুজরাটের (Gujarat) রাজনীতি যেখানে বরাবর বিজেপি-কংগ্রেসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে, সেখানে তৃতীয় শক্তি হিসাবে কেজরিওয়ালের আবির্ভাবের হেতু কী, সেই প্রশ্ন বেশ কিছুদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে, আপ-এর ভোট ৭ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি ছাড়াবে না। স্বাধীনতার পর থেকে গুজরাটের নির্বাচনের ফলাফল দেখলে বোঝা যায়, গান্ধীর রাজ্যে কংগ্রেসের ভোট কখনওই ৩৫ শতাংশের নিচে যাওয়া সম্ভব নয়। গতবার কংগ্রেস ৪১.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আপ-এর আগমন কি তাহলে কংগ্রেসের হিন্দু ভোটে থাবা বসাতেই? এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে ৮ ডিসেম্বর।
এবারের ভোটের পর যে মোদির তথাকথিত গুজরাটের উন্নয়ন মডেল একটি মিথে পর্যবসিত হবে, তা নিয়ে সংশয় নেই। একদিকে অমিত শাহ ‘ওদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে’ মন্তব্য করে মেরুকরণ তীক্ষ্ণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, অন্যদিকে বিজেপির ইস্তাহারে গুচ্ছ-গুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেদের ২৭ বছরের ব্যর্থতাকেই বেআব্রু করা হয়েছে। যদি ‘গুজরাট মডেল’ দেশের অর্থনীতি ও সুশাসনের ক্ষেত্রে একটি সফল মডেলই হয়, তাহলে সেখানে ভোটে জিততে কেন মোদি-শাহদের মেরুকরণের তাস ও ইস্তাহারে বিপুল খয়রাতি ঘোষণার উপর নির্ভর করতে হবে? কেনই বা আপ-এর মতো একটি দল কত ভোট কাটবে, তার হিসাবনিকাশ চালাতে হবে? গুজরাট মডেলকে সামনে রেখে ২০১৪ সাল থেকে ভোট করে আসছেন মোদি। এবার বোঝা যাচ্ছে, সেই গুজরাট মডেল খোদ গুজরাটেই কাজ করছে না। দেশের অন্যত্র যে এই গুজরাট মডেল অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে, তা বলা বাহুল্য।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.