১৮ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন জৈন আচার্য শ্রী ১০৮তম বিদ্যাসাগরজি মহারাজ। শুধুমাত্র জৈন ধর্মাবলম্বীরা নন, তাঁর মূল্যবোধকে পাথেয় করে এগিয়ে যাচ্ছেন অসংখ্য অ-জৈন ভারতীয়ও। কেবল আধ্যাত্মিকচর্চাই নয়, দেশের সার্বিক বিকাশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিচর্যাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে সওয়াল তুলেছেন। জেলবন্দিদের অবস্থার উন্নয়নেও কাজ করেছেন পূজ্য আচার্যজি। লিখলেন নরেন্দ্র মোদি।
সন্ত শিরোমণি আচার্য শ্রী ১০৮তম বিদ্যাসাগরজি মহারাজ (Acharya Vidyasagar Maharaj) সমাধিস্থ হয়েছেন সম্প্রতি। আমাদের সবাইকে শোকাহত করে তাঁর এই মহাপ্রস্থান। অন্তর্ভেদী প্রজ্ঞা, সীমাহীন দয়া এবং মানবতার উন্নয়নে নিরলস অঙ্গীকার– সব মিলিয়ে জীবনকালে এক সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিক ভাবনার সাক্ষ্য রেখে গেলেন তিনি। অসংখ্য অনুষ্ঠানে তাঁর আশীর্বাদ গ্রহণের সুযোগ হয়েছে আমার। আমাকে তো বটেই, অসংখ্য মানুষকে দেখিয়েছেন জীবনের পথ। তাঁর প্রয়াণে তাই প্রিয়জন-বিয়োগের যন্ত্রণা অনুভব করছি।
আচার্যজির উষ্ণ স্নেহ ও আশীর্বাদ নেহাত সৌজন্য প্রদর্শন ছিল না– তা ছিল আধ্যাত্মিক শক্তি, ক্ষমতায়ন এবং প্রেরণামূলক। আমরা, যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছি, তাঁরা ভাগ্যবান। জ্ঞান, অনুকম্পা এবং সেবার জন্য সর্বদা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন পূজ্য আচার্যজি।
তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই তপস্বী, এবং তাঁর মধ্যে মহাবীরের জীবনের প্রতিরূপ দেখতে পাওয়া যায়। কাজকর্ম এবং শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে জৈন ধর্মের মূল নীতিকে তুলে ধরেছেন। সততা, সত্যবাদিতা এবং কর্মই ছিল আচার্যজির জীবনের প্রধান অবলম্বন। অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন। জৈন সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনি পরিচিত লাভ করলেও তাঁর প্রভাব শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ধর্মীয় বিশ্বাস, অঞ্চল এবং সংস্কৃতি নির্বিশেষে সব ধরনের মানুষ তাঁর সান্নিধ্যে আসেন। আধ্যাত্মিক চেতনা জাগরণের লক্ষ্যে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গিয়েছেন– বিশেষত তরুণদের মধ্যে। তাদের এমন শিক্ষা দান করতে চেয়েছিলেন, যার শিকড় প্রোথিত থাকবে আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের মধ্যে।
বিদ্যাধর (শৈশবের নাম) থেকে ‘বিদ্যাসাগর’ পর্যন্ত তাঁর উত্তরণ ছিল জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানদানের প্রতি গভীর অঙ্গীকারের এক নিরবিচ্ছিন্ন যাত্রাপথ। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা হল সমাজকে আলোকিত করার হাতিয়ার। প্রকৃত জ্ঞানার্জনের পাথেয় হিসাবে আত্মসচেতনতা ও আত্মচর্চার গুরুত্বের উপর জোর দিতেন। জীবনভর শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করার প্রেরণা জোগাতেন অনুগামীদের। প্রায়ই বলতেন– অতীতের শিক্ষা থেকে সরে এলে, জলের ঘাটতির মতো আমরা গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলির সমাধান বের করতে পারব না। বিশ্বাস করতেন– দক্ষতা এবং উদ্ভাবনমূলক শিক্ষায়। ভারতের ভাষাগত বৈচিত্র নিয়ে প্রভূত গর্ববোধ করতেন, এবং তরুণদের ভারতীয় ভাষা-শিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। পূজ্য আচার্যজি নিজে সংস্কৃত, প্রাকৃত এবং হিন্দিতে প্রচুর লেখালিখি করেন। কীভাবে মাটির কাছাকাছি থেকেও সন্ত হিসাবে এক অসামান্য উচ্চতায় পৌঁছন তা প্রতিভাত হয় তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ‘মুখমতি’-তে।
কাজের মধ্য দিয়ে আচার্যজি সমাজের নিপীড়িতদের জাগ্রত করেন। স্বাস্থ্য পরিষেবা পরিবর্তনের লক্ষ্যেও প্রভূত কাজ করেছেন। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রের সঙ্গে, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া এলাকার কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বাস্থ্য পরিচর্যার প্রতি তঁার এক সর্বাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, যেখানে আধ্যাত্মিক ভাবনার সঙ্গে শারীরিক সুস্থতাকে একসূত্রে গেঁথেছিলেন তিনি। দেশ গড়ার ক্ষেত্রে আচার্যজির অঙ্গীকার নিয়ে চর্চার জন্য আমি আগামী প্রজন্মের কাছে বিশেষভাবে আরজি জানাচ্ছি।
ভোটদান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মতপ্রকাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার বলে তাঁর বিশ্বাস ছিল। সওয়াল করতেন সুস্থ এবং স্বচ্ছ রাজনীতির পক্ষে। বলতেন– ব্যক্তিস্বার্থ নয়, মানুষের কল্যাণেই নীতি প্রণয়ন করতে হবে। বিশ্বাস করতেন– নাগরিকদের নিজেদের প্রতি তো বটেই, একইসঙ্গে পরিবার, সমাজ, সর্বোপরি দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন শক্তিশালী রাষ্ট্রগঠনের ভিত্তি তৈরি করে। সততা, অখণ্ডতা এবং আত্মনির্ভরতার মতো গুণাবলি চর্চায় অজস্র মানুষকে অনুপ্রাণিত করতেন। ‘বিকশিত ভারত’ গড়ার লক্ষ্যে আমরা এখন যে-কাজ করে চলেছি, তিনি তার প্রতিও গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশ্বজুড়ে যেখানে পরিবেশগত অবনমন ক্রমবর্ধমান, সেখানে প্রকৃতির ক্ষতি যাতে ন্যূনতম হয়, সেই লক্ষ্যে জীবনযাপনের ডাক দিয়েছিলেন পূজ্য আচার্যজি। দেশের অর্থনীতিতে কৃষিক্ষেত্রের ভূমিকা যে গুরুত্বপূর্ণ, বারবার স্মরণ করাতেন সে-কথাও। আধুনিক কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলার উপর জোর দিতেন। জেলবন্দিদের অবস্থার উন্নয়নেও কাজ করেন।
পূজ্য আচার্যজি যা কিছু করেছেন শুধুমাত্র বর্তমানের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ নিয়েও বিস্তর ভাবনাচিন্তা ছিল তাঁর। গত বছর নভেম্বর মাসে আমি ছত্তিশগড় গিয়েছিলাম। ডোঙ্গরগড়ের চন্দ্রগিরি জৈন মন্দির দর্শনের সুযোগ হয়েছিল। ভাবতেও পারিনি, সেটাই হবে আচার্যজির সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ! সেই মুহূর্তগুলি আমার কাছে বিশেষভাবে স্মরণীয়। দীর্ঘ অনেকক্ষণ কথা হয় আমাদের। দেশের সেবায় তিনি আমার প্রয়াসকে আশীর্বাদ জানান উদার হস্তে, অকুণ্ঠ চিত্তে। আমাদের দেশ যে-পথে এগচ্ছে এবং বিশ্বমঞ্চে ভারত যেভাবে সমীহ আদায় করে নিচ্ছে, তা নিয়ে তিনি আনন্দ প্রকাশ করেন। আচার্যজির শান্ত চাহনি এবং মৃদু হাসি অদ্ভুত মানসিক প্রশান্তির বার্তা বহন করত। এমনকী, তা যে কোনও লক্ষ্যপূরণেও ইন্ধন জোগাত। তাঁর আশিস আত্মার উপর মলমের মৃদু প্রলেপের মতো। আমার চারদিকে এক ঐশ্বরিক অস্তিত্বের অনুভব প্রদান করত তা।
সন্ত শিরোমণি আচার্য শ্রী ১০৮তম বিদ্যাসাগরজি মহারাজকে যাঁরা চিনতেন এবং তঁার শিক্ষা ও জীবনাদর্শ যাঁদের স্পর্শ করেছে, তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁর অভাব গভীরভাবে অনুভব করবেন। তিনি প্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবেন অনুগামীদের মনে। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা তাঁর মূল্যবোধকে মূর্ত করে তোলার অঙ্গীকার করছি। এভাবে আমরা তাঁর আত্মার প্রতি শুধু শ্রদ্ধা নিবেদন করব না, সেই সঙ্গে আমাদের দেশ ও মানুষের কাছে তাঁর মিশনকে ছড়িয়ে দিতে পারব।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.