Advertisement
Advertisement
Kashmir

কাশ্মীর নিয়ে বৈঠক কৌশলগতভাবে বিজেপির চতুর রাজনীতি

মোদির কাশ্মীর নিয়ে এই বৈঠক কেন কৌশলগতভাবে তাঁর পিছু হটা নয়।

PM Modi's Kashmir meet is calculated political move | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:July 3, 2021 3:05 pm
  • Updated:July 3, 2021 3:05 pm  

যাঁরা বলছেন, কাশ্মীরের বৈঠক ডেকে নরেন্দ্র মোদি পিছু হটেছেন, বিজেপির মুখ পুড়েছে, তাই যাঁদের বন্দি করা হয়েছিল তাঁদেরই ডেকে এনে বৈঠক- এই বিশ্লেষণের সঙ্গে কিন্তু আমি একমত নই। আমার মনে হচ্ছে, আলোচ‍্য সূচি ছাড়াই এই বৈঠক ডাকা এবং সবাইকে আবার শামিল করা কৌশলগতভাবে বিজেপির চতুর রাজনীতি। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

 

Advertisement

সেদিন কথা হচ্ছিল পাকিস্তানের প্রবীণ সাংবাদিক জাহিদ হুসেনের সঙ্গে। ‘জুম’ প্রযুক্তির সাহায‍্য নিয়ে আমরা পরস্পরকে দেখছিলাম এবং কথা বলছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কাশ্মীর নিয়ে গত ২৪ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাশ্মীরি নেতাদের সঙ্গে যে-বৈঠকে বসলেন, ভারতে তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী? বললাম, সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশ বলছে, প্রধানমন্ত্রী চাপের কাছে নতিস্বীকার করে বৈঠকটি ডাকতে বাধ্য হয়েছেন! সব ভাল যার শেষ ভাল তার! বৈঠকটা যে হয়েছে এবং গুপকর সংগঠনের সব নেতা এসেছেন, কোনওরকম আলোচ‍্য সূচি ছাড়াই যে বৈঠকে বসেছেন- তাই-বা কম কী? বৈঠকে বিরাট কিছু লাভ হোক আর না-হোক, অন্তত যাঁদের নরেন্দ্র মোদি জেলে পুরে দিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যে আবার বৈঠক করছেন- এটাই তো একটা বড় পাওয়া!

পাকিস্তানের প্রবীণ সাংবাদিক বন্ধু তখন বললেন, পাকিস্তানেও কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া ‘নেতিবাচক’ নয়। যদিও ইমরান খান বলেছেন, যতদিন না পর্যন্ত ভারত সরকার আবার ৩৭০ ধারার সাংবিধানিক মর্যাদা কাশ্মীরকে ফিরিয়ে দিচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে কোনওরকম আলোচনায় তারা বসতে রাজি নয়। কিন্তু নেই মামার থেকে যে কানা মামা ভাল। পাকিস্তানও মনে করছে, অন্তত কাশ্মীর নিয়ে অনেক দিন পর একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে।

পাকিস্তানের প্রবীণ সাংবাদিক জাহিদ হুসেন শুধু একজন সাংবাদিক নন, তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিন-চারটি বইয়ের লেখক। ভারত-পাকিস্তান, ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্ক, পাকিস্তান-আমেরিকার সম্পর্ক- বিভিন্ন বিষয়ে তিনি বই লিখেছেন। বইগুলো শুধু পাকিস্তানের প্রকাশনা সংস্থা নয়, ভারতের প্রকাশনা সংস্থাগুলিও একইভাবে প্রকাশ করেছে। তিনি ‘লন্ডন টাইমস’-এর এবং ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর প্রতিনিধি হিসাবে এখনও, এই বয়সেও, কাজ করে যাচ্ছেন। এহেন জাহিদ হুসেন আশা করেন, দুই দেশের মধ্যে আর কোনও যুদ্ধ যেন না হয়। অর্থাৎ, যুদ্ধ কখনও ‘বিকল্প’ হতে পারে না। আমিও ওঁকে বললাম যে, যুদ্ধ এবং শান্তির মধ্যে শান্তিপ্রক্রিয়া ছাড়া আর অন‍্য কোনও বিকল্প রাস্তা যে নেই- সে ব‍্যাপারে একজন সাধারণ ভারতীয় নাগরিক হিসাবে আমিও একমত।

[আরও পড়ুন:  প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে বাড়ছে সাইবার আক্রমণ, মুক্তির উপায় কী?

আলোচনা ছাড়া অন‍্য কোনও রাস্তা খোলা নেই। জাহিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, যেরকম পুলওয়ামা আক্রমণ হয়েছিল, উত্তরপ্রদেশে ভোট আসছে, ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচন আসছে, আবার আর একটা যুদ্ধ নরেন্দ্র মোদি করবেন না তো? আমি বললাম, একহাতে তো তালি বাজে না। পাকিস্তানও তো ‘সংঘর্ষ-বিরোধী চুক্তি’ ভঙ্গ করে বারবার সীমান্তে সন্ত্রাস করছে। ২০১৯-এ ৩৭০ ধারা সংসদে বিলোপ করার পর যে সংঘর্ষ-বিরোধী চুক্তি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ছিল- সেটাও আবার পাকিস্তানের দিক থেকেই ভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। সুতরাং পাকিস্তানের দিক থেকে প্ররোচনা থাকার দিকটাও ভাবতে হবে। ভারত সেখানে রাজনৈতিকভাবে ফায়দা নেওয়ার জন্য পাকিস্তান বিরোধিতাকে তাস হিসাবে ব‍্যবহার করে হিন্দুত্ববাদী ভোটকে সুসংহত করবে- এ তো রাজনীতির বিষয়। কিন্তু আমি স্বাধীন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি হিসাবে মনে করি, এই ধরনের রাজনীতি আর যেন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণ না হয়। এখন করোনা-পরিস্থিতিতে অর্থনীতি অনেক বেশি বিপর্যস্ত। এমনকী, ’৭১ সালের যুদ্ধ- যার জন‍্য অটলবিহারী বাজপেয়ীর মতো লোকও ইন্দিরা গান্ধীকে মা দুর্গার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন- সেই ইন্দিরা গান্ধীকেও ’৭৫ সালে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করতে হয়েছিল। তার কারণ যে শুধু ‘রাজনৈতিক’ ছিল, তা নয়। অনেকে বলেন, ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের ফলে অর্থনীতির বিপর্যয় হয়েছিল। সেজন্যই জরুরি অবস্থা জারি করার মতো আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সুতরাং, যুদ্ধ যেন আর কিছুতেই না হয়।

যাঁরা বলছেন, কাশ্মীরের বৈঠক ডেকে নরেন্দ্র মোদি পিছু হটেছেন, বিজেপির মুখ পুড়েছে, তাই যাঁদের বন্দি করা হয়েছিল তাঁদেরই ডেকে এনে বৈঠক- এই বিশ্লেষণের সঙ্গে কিন্তু আমি একমত নই। আমার মনে হচ্ছে, আলোচ‍্য সূচি ছাড়াই এই বৈঠক ডাকা এবং সবাইকে আবার শামিল করা কৌশলগতভাবে বিজেপির চতুর রাজনীতি। বিজেপি-চালিত কেন্দ্রীয় সরকার এতে ‘ক্লাইম্ব ডাউন’ করেছে, না কি কাশ্মীর নিয়ে এক বৃহৎ রণকৌশলের এটা একটা অঙ্গ- তা ভেবে দেখা খুব জরুরি। নরেন্দ্র মোদির কাশ্মীর নিয়ে এই বৈঠক কেন কৌশলগতভাবে তাঁর পিছু হটা নয়, সেটার জট আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করছি।

প্রথমত, সংবিধানের ৩৭০ ধারার যে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তা নরেন্দ্র মোদি ফিরিয়ে দিচ্ছেন না। বরং এখন সরকার কাশ্মীর ন‍্যারেটিভকে ৩৭০ ধারা থেকে সরিয়ে নিয়েছে। কাশ্মীরি রাজনৈতিক নেতাদের দাবি, কাশ্মীরকে আবার রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে। পৃথক যে রাজ্যের মর্যাদা ছিল, নির্বাচিত সরকার ছিল, তার জায়গায় এখন রাজ্যকে ভাগ করে দিয়ে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ বারবার বলেছেন যে, সঠিক সময়ে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তবে কবে, তা এখনও বলা হয়নি। ৩৭০ ধারা আবার ফিরিয়ে দিতে হবে- এই দাবিটা কাশ্মীরি নেতারা করছেন বটে, কিন্তু সেই দাবির আগে তো পৃথক রাজ্যের মর্যাদাটা ফিরে পেতে হবে। আবার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় এসে একটা নির্বাচিত সরকার গড়ে তুলতে হবে। অতএব মোদি, বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব এবং সংঘ পরিবারের যে কর্মসূচি, তার প্রেক্ষিতেই কিন্তু কাশ্মীরি নেতাদের সঙ্গে দর-কষাকষি করছেন। আপাতত তাদের এখন লক্ষ্য একটাই- যেভাবে হোক ভোট করে যাতে আবার তারা ক্ষমতায় আসতে পারে। আবার যাতে তারা রাজ‍্য সরকার গঠন করতে পারে। কাশ্মীরি নেতাদের কাছে দাবি করার জায়গাটাও সংকীর্ণ।

দ্বিতীয়ত, ‘কোভিড ১৯’-এর ফলে দেশজুড়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয়েছে। কাশ্মীরেও সেই বিপর্যয়ের প্রতিফলন হয়েছে। করোনার ফলে লকডাউন, তার ফলে কাশ্মীরের উন্নয়ন যে মার খেয়েছে- তাতে সন্দেহ নেই। এই মুহূর্তে আর্থিক দিক থেকে কেন্দ্রের উপরও কাশ্মীরের মানুষ অনেকটা নির্ভরশীল। আর্থিক সুযোগ-সুবিধাগুলো পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস এবং নতুন করে ব‍্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়ন চালু করার চেষ্টা- এসব ব্যাপারে কাশ্মীরি নেতাদেরও কেন্দ্রের সঙ্গে সহযোগিতার রাস্তায় যেতে হবে এখন। এই পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর সংঘর্ষ-বিরোধী চুক্তি ভেঙে দিয়ে যদি এখন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে গোলাবর্ষণ এবং নানারকমের জঙ্গি কার্যকলাপ বাড়ে, তাতে লাভ কার? ভারত-বিরোধী সেন্টিমেন্ট আছে, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা কাশ্মীরে প্রকাশ্যে হিংসাত্মক কার্যকলাপ অনেকখানি কমেছে। তা এই মুহূর্তে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। করোনা বিপর্যয়ের মোকাবিলা কাশ্মীরের মানুষের কাছেও কিন্তু গোটা দেশের মানুষের মতোই একইরকমভাবে অগ্রাধিকার।

তৃতীয়ত, কাশ্মীরের নেতারা শুধু রাজ্যের মর্যাদা পাওয়া নয়, চাইছেন অবিলম্বে নির্বাচন হোক। আবার নির্বাচন করার ক্ষেত্রেও মোদি এবং অমিত শাহ জানিয়ে দিয়েছেন, আগে ‘ডি-লিমিটেশন’ হবে এবং তারপর নির্বাচন হবে। ডি-লিমিটেশন নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। মূল যে-অভিযোগ বিজেপির বিরুদ্ধে কাশ্মীরি নেতারা করছেন, সেটা হল: ডি-লিমিটেশন এমনভাবে করা হচ্ছে, যাতে জম্মু এবং শ্রীনগরের হিন্দু ও মুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত বদলে যায়! যেভাবে জম্মুতে হিন্দুর স‌ংখ‍্যা বেশি এবং কাশ্মীরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বাস, সেইটা বদলে মোটামুটি সমান-সমান হিন্দু কাশ্মীরে প্রতিষ্ঠা করার একটা প্রয়াস রয়েছে। শ্রীনগর তখন মুসলিম-প্রধান এলাকা থাকবে না। সেক্ষেত্রে ভোটে তার একটা ফায়দা বিজেপি নিতে চায় বলে বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ। এমনকী, সাচার কমিটির রিপোর্টেও বলা হয় যে, শুধু কাশ্মীর নয়, দেশজুড়ে মুসলিম-প্রধান আসনগুলোকে তফসিলি জাতিপ্রধান করে দেওয়া হয়েছে। তাই ডি-লিমিটেশন বিষয়টি বিচার-বিশ্লেষণ করে পর্যালোচনা করা উচিত। এখন কাশ্মীরি নেতারা এই ডি-লিমিটেশনের ক্ষেত্রেও সরকারের নরম মনোভাব আশা করছেন। সেক্ষেত্রে সরকার যদি নরম মনোভাব নেয় এবং ডি-লিমিটেশনের ক্ষেত্রে কিছুটা পর্যালোচনার সম্ভাবনা রেখেই নির্বাচনে যেতে রাজি হয়, তাহলে তা কাশ্মীরের বিক্ষুব্ধ নেতাদের দিল্লির কাছ থেকে একটা মস্ত বড় পাওনা! সুতরাং তাঁদের এখন নাকের বদলে নরুন পেয়েই খুশি থাকতে হবে।

এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি করাটা কিন্তু মোদি সরকার, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এবং সংঘ পরিবারের একটা মস্ত বড় সাফল্য। পাকিস্তান যেভাবে ঘোষণা করে দিয়েছে যে, এই মুহূর্তে ৩৭০ না-ফেরত দেওয়া পর্যন্ত তারাও আলোচনা করবে না, সেই কঠোর জায়গা থেকে পাকিস্তান কিছুটা নরম হবে কি হবে না- সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এটা ঠিক যে, ভারতেরও কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আলাপ-আলোচনা বন্ধ রাখা কঠিন। কারণ আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় চিন, পাকিস্তান শুধু নয়, পাকিস্তান-চিন অক্ষের সঙ্গে রাশিয়াও যোগাযোগ স্থাপন করেছে। আমেরিকা এতদিন ধরে আফগানিস্তানে সেনা বহাল রেখে যথেষ্ট ক্লান্ত। সেখানে দেখা গিয়েছে যে, তালিবানদের নির্বংশ করে দেওয়া যায়নি। উলটে শিবশঙ্কর মেনন, তাঁর সাম্প্রতিকতম বইতে লিখেছেন যে, ক্লান্ত আমেরিকা চিন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে ওখানে আবার একটা তালিবানি সরকার গঠনের ক্ষেত্রে মদত দিচ্ছে কি না সেটা বোঝা দরকার। যে-কারণে অজিত ডোভাল এবং জয়শঙ্কর প্রকাশ্যে না-হলেও তালিবানি নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। পাকিস্তানও দেখা যাচ্ছে সে ব‍্যাপারে বিরোধিতার সুর চড়ায়নি। এমনকী, ‘এনএসএ’দের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পাকিস্তান, আফগানিস্তান নিয়ে সরব হয়নি। গতবারে অজিত ডোভালকে কাশ্মীর ইস‍্যু উত্থাপন করার জন্য বয়কট করতে হয়েছিল। এবারে সেখানে পাকিস্তান কাশ্মীর ইস‍্যু উত্থাপন করেনি। তাহলে একটা তালিবানি সরকার গঠনের চেষ্টা হচ্ছে। সেটার নেপথ্যে আমেরিকারও পরোক্ষ মদত আছে কি না এবং চিন যেভাবে সড়ক নির্মাণ করতে চাইছে, যেভাবে শুধু চিন নয়, রাশিয়াও তাতে উৎসাহ দিচ্ছে, বেশ কিছু আমেরিকান তৈল কোম্পানিও উৎসাহ দিচ্ছে, সেটা কিন্তু রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে অত‍্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

চিনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের রণকৌশলের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে আগামী দিনে বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা কী হয়, ভারতকে তার উপরও কড়া নজর রাখতে হচ্ছে। ভারত-পাক আলোচনার পটভূমি যে নেই তা নয়, আছে। কিন্তু ভারত চেষ্টা করছে নিজেদের ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস’ দিয়ে আলোচনা শুরু করতে। পাকিস্তানের কাছে মোদি সরকার এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, কোনওভাবে ৩৭০ ধারা আর ফিরে আসবে না। সুতরাং, কথা বলতে গেলে এটা মাথায় রেখেই কথা বলতে হবে। পাকিস্তানের প্রবীণ সাংবাদিক বন্ধুবর বলছিলেন, ভারতে মোদির বাধ্যবাধকতা আছে। তাঁর পক্ষে এখন ৩৭০ ধারা ফেরত দেওয়া কার্যত অসম্ভব, কেননা বিজেপি ও আরএসএস-এর মতাদর্শের খাঁচাতে নরেন্দ্র মোদি নিজেই এখন বন্দি হয়ে আছেন। বাজপেয়ী ছিলেন উদার মুখ। আদবানি কট্টর আরএসএসের মুখ। এরই মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে এবং জোট সরকারের অনেক বাধ‍্যবাধকতার মধ্য দিয়ে বিজেপি চলতে বাধ্য হয়েছিল তখন। কিন্তু আজকের বিজেপি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং নরেন্দ্র মোদিই বাজপেয়ী, নরেন্দ্র মোদিই আদবানি। এই পরিস্থিতিতে ৩৭০ ধারা যেটা ইস্তাহারের অন‍্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, সেটা বিজেপি সফলতার সঙ্গে করে দেখিয়েছে। যার জন্য এদেশের বিজেপি সমর্থকদের সমর্থন নরেন্দ্র মোদি সরকার পাচ্ছে।

এরকম অবস্থায় শুধু পাকিস্তানের জন‍্য আলোচনা শুরু করতে ৩৭০ ধারাকে আবার কোনওভাবে ফিরিয়ে দেওয়া কার্যত অসম্ভব! আবার ইমরান খানেরও ঘরোয়া রাজনীতির চাপ আছে। ভারতে তো নরেন্দ্র মোদির উপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু ইমরান খানের উপর রয়েছে, আছে মোল্লাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ। সুতরাং এরকম একটা পরিস্থিতিতে বাঘের পিঠে চেপে বসার পরিস্থিতি। এক্ষুনি তাই আলাপ-আলোচনা শুরু করা কঠিন। কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে আলাপ-আলোচনাটা শুরু করে নরেন্দ্র মোদি যে পরিস্থিতিটা শুরু করে দিলেন, তাতে অন্তত পাকিস্তানে একটা মন্দের ভাল প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও কিন্তু আলাপ-আলোচনার পক্ষে কথা বলছে। এর বড় কারণ- বাইডেন প্রশাসনের চাপ। আমেরিকা চাইছে, ভারত-পাকিস্তান এবারে আলাপ-আলোচনার পথে আসুক।

নরেন্দ্র মোদি তাই কাশ্মীর নিয়ে কোনও কিছুই ঘোষণা না করে শুধু একটি বৈঠক করে আমেরিকার কাছেও কিন্তু একটা ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন। ৩৭০ ধারা তোলার পরে পাকিস্তান তো পৃথিবীজুড়ে একটা বড় ইস‍্যু করার চেষ্টা করেছিল। রাষ্ট্র সংঘ থেকে শুরু করে পৃথিবীর অন‍্যান‍্য দেশের জনমত সংগ্রহের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দেখা গিয়েছে, তাতে পাকিস্তানের পক্ষে কেউ এসে দঁাড়ায়নি। উলটে পাকিস্তান ‘ফিন‍ানশিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স’-এর ‘গ্রে লিস্ট’-এ থেকে গিয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের ৩৯ জন সদস্যের এই গোষ্ঠীর ‘টেরর গ্রুপ’ হিসাবে পাকিস্তানের থেকে যাওয়াটা ইমরান খানের পক্ষে যথেষ্ট অস্বস্তির কারণ।

এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের উপরে সন্ত্রাস নিয়ে চাপ বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে ভারত। রাষ্ট্রসংঘ তার ‘ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স’-এর গ্রে লিস্টে পাকিস্তানকে রেখে দেওয়ায় ভারতের পক্ষে পাকিস্তানের উপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ এসেছে। ভারত, এর ফলে, পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে, কিন্তু ৩৭০ ধারা তুলছে না। এত কিছুর পরেও কাশ্মীর ইস্যুতে নরেন্দ্র মোদির শেষরক্ষা হবে কি না, সেই প্রশ্নটা এখনও অমীমাংসিত। এতদিন রাজ‍্যপালের শাসন যেভাবে লাদাখ, জম্মু এবং কাশ্মীরকে আলাদা করে প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তাতে সন্ত্রাস কমেছে, কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু জঙ্গিরা যে তলে-তলে প্রস্তুতি নিচ্ছে না, সুযোগের অপেক্ষায় নেই এবং তারা যে সন্ত্রাস ভুলে গিয়েছে- তা তো নয়! সাম্প্রতিক ড্রোনের ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে, কাশ্মীরে সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, ততই এই সন্ত্রাস বাড়ার সম্ভাবনাও থাকবে। হুরিয়ত নেতাদের সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক করে কাশ্মীরি নেতাদের আলোচনায় শামিল করা হয়েছে। হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে তৎকালীন পাক হাই কমিশনার আবদুল বাসিতের বৈঠকের জন্য বিদেশ সচিব পর্যায়ের বৈঠকটাই বাতিল করে দিলেন মোদি।

তারপর থেকে এখনও হুরিয়ত নেতাদের কোনওরকম আলাপ-আলোচনার পর্যায়ে আনা হয়নি। কিন্তু সেটাই সঠিক রাস্তা কি? প্রাক্তন ‘র’ প্রধান দুলাত লিখেছেন, নরসিমা রাও এই প্রক্রিয়া শুরু করেন। অটলবিহারী বাজপেয়ী সেই প্রক্রিয়া জারি রেখেছিলেন। সম্প্রতি আবদুল বাসিত, তাঁর সদ‍্য প্রকাশিত বই ‘Hostility a diplomat diary on Pakistan-India relations’-এ লিখেছেন, ‘হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে দেখা করা বা বৈঠক করাটা নতুন কিছু বিষয় ছিল না। তবু সেটাকে ছুতো করে নরেন্দ্র মোদি বিদেশ সচিব পর্যায়ের বৈঠক যে বাতিল করে দিয়েছিলেন, তারপর আজ পর্যন্ত সেই আলোচনার প্রক্রিয়া কিন্তু আর শুরু হয়নি। তার জন্য অনেকে আমাকে ব‍্যক্তিগতভাবে দায়ী করেছেন। আসলে পরিস্থিতি এর জন্য দায়ী ছিল।’

সেই পরিস্থিতি কি বদলে গিয়েছে? অর্থাৎ হুরিয়ত নেতাদের সম্পূর্ণ বাইরে রেখে কাশ্মীরে কি শান্তিপ্রক্রিয়া আনা সম্ভব হবে? সুতরাং নরেন্দ্র মোদির কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের রাস্তা একমুখী, উভমুখী নয়। এখন দিল্লিতে বসে এই একমুখী কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের প্রয়াস এবং সেখানে কার্যত বুলডোজার দিয়ে সমরনীতির প্রয়োগের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন এবং উন্নয়নের চেষ্টা, সত্যি সত্যি আগামীতে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান নিয়ে আসতে পারবে কি? না কি চলবেই তৈলাক্তবাঁশে বাঁদরের ওঠা-নামা?

[আরও পড়ুন:  প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে বাড়ছে সাইবার আক্রমণ, মুক্তির উপায় কী?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement