ফাইল ছবি
‘যোগী হঠাও’ অভিযানে দিল্লিতে দরবার শুরু হয় নিত্য। অবস্থা কতটা করুণ, বোঝা যায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলে। এমনটা হতে পারে আন্দাজ করেই ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য সচেষ্ট হন প্রধানমন্ত্রী। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা-মোদির পর আরও একটা টানটান ডুয়েল শুরু হয়েছে। তবে এই দ্বৈরথ পারিবারিক- নরেন্দ্র মোদি বনাম যোগী আদিত্যনাথ (Yogi Adityanath)। জাতীয় রাজনৈতিক চর্চায় এই মুহূর্তের সেরা আকর্ষণ এই দ্বৈরথ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ একই দলের নেতা হলেও, রাজনীতির কারণে তাঁদের অবস্থান এখন দুই মেরুতে। এতটাই, যে, ৫ জুন আদিত্যনাথের জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী মোদি কেন তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে টুইট করলেন না- তা নিয়ে বিস্তর জলঘোলা চলছে। হুট বলতে যিনি টুইটে অভ্যস্ত, সেই প্রধানমন্ত্রীর এহেন নীরবতার নেপথ্যে দুই নেতার আকচাআকচিকেই কারণ হিসাবে খাড়া করা হচ্ছে। চর্চাটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে দেখে মোদির ঘনিষ্ঠ মহল সাফাই দিয়েছে- কোভিডের দরুন তিনি নাকি ইদানীং কারও জন্মদিনে টুইট করছেন না। ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। নেতার দেখাদেখি একই পথের পথিক হয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও দলের সভাপতি জগৎ প্রকাশ নাড্ডাও।
সত্যি-মিথ্যের ঘেরাটোপের বাইরের রটনা অনুযায়ী, যোগীকে এখন একেবারেই সহ্য করতে পারছেন না মোদি। তাঁর বিশ্বাস, যোগীকে এইভাবে আগলহীন রাখা হলে উত্তরপ্রদেশের ভোটে দলের ভরাডুবি অবধারিত। ফলে মোদিই হয়ে গিয়েছেন এখন যোগীর এক নম্বর প্রতিপক্ষ। রটনার উলটো প্রচারে, মোদি আবার যোগীর ‘চোখের বালি’। যোগীর বিশ্বাস, ভোটের আগে হাত-পা বেঁধে তাঁকে জড়ভরত করে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। শেষ পর্যন্ত তা করা গেলে, সেটা হবে হারাকিরির সমতুল্য। উত্তরপ্রদেশের ভোট-উপাখ্যান এই দ্বৈরথে পেন্ডুলামের মতো
দুলে চলেছে।
আগামী বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চে যে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভার ভোট, উত্তরপ্রদেশ সেগুলির অন্যতম। বাকি চার রাজ্য হল পাঞ্জাব, গোয়া, উত্তরাখণ্ড ও মণিপুর। বছর-শেষে ভোট গুজরাত ও হিমাচল প্রদেশে। পাঞ্জাব ছাড়া সব রাজ্যেই বিজেপি ক্ষমতায়। উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতাসীনের চালচিত্রটি আবার ঈর্ষাজনক। ২০১৭ সালে ৪০৩ আসনের মধ্যে বিজেপি একাই জিতেছিল ৩১২টি, জোটের সংগ্রহ ৩২৫। সেই উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে কি না- এই মুহূর্তের বড় জল্পনা তা। জল্পনা-যজ্ঞে ঘি ঢেলে দিচ্ছে মোদি-যোগী দ্বন্দ্ব।
মোদির (Narendra Modi) রাজনৈতিক উত্থানের চেয়েও চমকপ্রদ ও আকস্মিক আদিত্যনাথের উদয়। ৫ জুন পঞ্চাশ পেরনো এই গেরুয়াধারীর জন্ম পাউড়ি গাড়ওয়ালে। কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত পরিচিত ছিলেন অজয়মোহন বিস্ত নামে। নয়ের দশকের প্রথম দিকে অযোধ্যা আন্দোলন যখন তীব্র, সে সময় তিনি গৃহত্যাগী হন। অযোধ্যা আন্দোলনের ঢেউ তাঁকে টেনে আনে গোরক্ষপুরে। সংস্পর্শে আসেন গোরক্ষনাথ মঠের মোহান্ত অবৈদ্যনাথের। দীক্ষিত হন। নাম হয় আদিত্যনাথ। শুরু হয় সংসার-ত্যাগীর নতুন জীবন। তখন তাঁর একুশ বছর বয়স।
গেরুয়াধারী আদিত্যনাথ কট্টর হিন্দুত্ববাদী হলেও কস্মিনকালেও সংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। গুরু অবৈদ্যনাথের মতোই নাড়া বেঁধেছিলেন ‘হিন্দু মহাসভা’-র সঙ্গে। অবৈদ্যনাথ বিজেপিতে যোগ দিলে তিনিও অনুসারী হন। ১৯৯৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত টানা পাঁচবার গোরক্ষপুর থেকে লোকসভায় বিজেপির টিকিটে জেতেন। কিন্তু স্বকীয় অস্তিত্ব বিসর্জন দেননি কখনও। বিজেপিতে থাকলেও চিরকাল চালিত হয়েছেন নিজের ইচ্ছায়। হিন্দুত্ববাদের সংজ্ঞা তৈরি করেছেন নিজের মতো করে। হিন্দুত্বের বিকাশে গড়ে তুলেছেন ‘হিন্দু যুব বাহিনী’। রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে এই বাহিনীর নির্দেশই শেষকথা।
উত্তরপ্রদেশে বিজেপিতে থেকেও তাঁর অবস্থান বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতো। অবশ্যই অনুপেক্ষণীয়। এতটাই প্রবল তাঁর উপস্থিতি যে, ২০১৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর দাবি অস্বীকার করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং সংঘ পরিবার। মনে পড়ছে, সেই সময় বারাণসীর রাজনীতিক, গাজিপুর থেকে জেতা তিনবারের সাংসদ মনোজ সিন্হার (এখন জম্মু-কাশ্মীরের উপ-রাজ্যপাল) নাম মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মোদির পাকা ঘুঁটি কাঁচিয়ে সংঘ মেনে নেয় আদিত্যনাথের দাবি, যিনি ততদিনে ৮৮ জন বিধায়কের সমর্থন আদায় করে নিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের প্রশাসন সেই থেকে এখনও পর্যন্ত তাঁরই নির্দেশে ওঠে-বসে। ভাল-মন্দ সব সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে শুধু তিনিই। মোদি সেখানে দর্শকমাত্র।প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা কতটা গুরুত্বহীন, তার সেরা উদাহরণ নিয়ে এই মুহূর্তে মোদি-যোগী দড়ি টানাটানি তুঙ্গে। চরিত্রটির নাম অরবিন্দ শর্মা।
এই কাহিনি সবিস্তার বলার আগে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। নানা প্রশাসনিক কারণে যোগী অনেক দিন ধরে দলেও প্রবল সমালোচিত। একটা কারণ, অতিরিক্ত জাতিবাদ। নিজে ঠাকুর বলে জাতপাতের এই পৃষ্ঠভূমিতে ঠাকুরদের প্রতিপত্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন। ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরা কোণঠাসা। মাত্রাছাড়া ‘হিন্দুত্ববাদ’ সামাজিক পরম্পরাকে বিষিয়ে তুলেছে। ‘হিন্দু যুব বাহিনী’-র দাপাদাপিতে অতিষ্ঠ দলিত ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো চেপে বসেছে কোভিড নিয়ন্ত্রণে সরকারের হিমশিম হাল ও ক্ষোভ ধামাচাপা দিতে অহেতুক নিষেধাজ্ঞা। অগুনতি মৃত্যু, চরম অব্যবস্থা এবং প্রতিকারহীনতার কারণে যোগী-বিরোধিতা তীব্র আকার নিয়েছে। সত্য ও ক্ষোভ চাপা দেওয়ার নানাবিধ ফরমানে তিতিবিরক্ত মানুষ।বিজেপি নেতারাও খোলাখুলি যোগীর বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেন। ‘যোগী হঠাও’ অভিযানে দিল্লিতে দরবার শুরু হয় নিত্য। অবস্থা কতটা করুণ, বোঝা যায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলে। এমনটা হতে পারে আন্দাজ করেই ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য সচেষ্ট হন প্রধানমন্ত্রী। ঠিক হয়েছিল, উত্তরাখণ্ডের পালাবদলের সময় উত্তরপ্রদেশেও ঘটানো হবে ‘পরিবর্তন’। মোদি বুঝেছিলেন, বিধানসভা ভোটের ফল খারাপ হলে যোগীর তুলনায় তাঁর ক্ষতি ঢের বেশি। সেই আন্দাজ তাঁকে সক্রিয় করে তুলেছিল অরবিন্দ শর্মাকে বেছে নিতে।
গুজরাত ক্যাডারের আইএএস অরবিন্দ চিরকাল মোদির বিশ্বস্ত। চাকরি ছাড়িয়ে মাস কয়েক আগে মোদি তাঁকে উত্তরপ্রদেশের বিধান পরিষদের সদস্য করেন। যোগীর রাশ টানতে তাঁকে উপমুখ্যমন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন মোদি। কিন্তু বেঁকে বসেন যোগী। সেই থেকে থেমে রয়েছে মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ। দফায় দফায় বৈঠক করছেন সংঘ নেতারা। বৈঠক হচ্ছে মোদি, শাহ, নাড্ডা ও সংঘ পরিবারের মধ্যেও। ‘যোগী হঠাও’ অভিযানের পালেও রীতিমতো বাতাস বইছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এমনই দাপট যে, সরানো তো দূর অস্ত, মোদির ইচ্ছানুযায়ী ডানা ছাঁটাও এখনও যায়নি। অথচ দিন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। মোদির কাছে এ এক ‘সসেমিরা’ হাল।
উত্তরপ্রদেশে যোগী যদি সমস্যা হন, সমাধানও তাহলে তিনিই। সম্ভবত এই উপলব্ধি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হয়েছে। ফলে মনে হচ্ছে, ‘যোগী হঠাও’ অভিযান শেষ। সেক্ষেত্রে প্রথম রাউন্ডে যোগীই জয়ী। পরবর্তী রাউন্ডে রয়েছে প্রশাসনিক পরিবর্তন। তা কতটা কাজের হবে, সন্দেহ সেখানেও। কেননা, দুয়ারে বর্ষা। মাস তিনেক তাতে কাটবে। নতুন প্রশাসনের হাতে থাকবে বড়জোর দু’মাস। জানুয়ারি থেকেই চালু হয়ে যাবে নির্বাচনী আচরণবিধি। এই সময়ের মধ্যে যোগী-সৃষ্ট ক্ষতের মেরামত করা কতটা সম্ভব?
প্রশ্নটা বিবেচিত বিজেপির অভ্যন্তরেই। পঞ্চায়েত ভোটের ফল যোগীর প্রতি অনাস্থারই প্রতীক। প্রধানমন্ত্রী এমনি এমনি টিকা-নীতিতে বদল ঘটাতে আগ্রহী হননি। সুপ্রিম কোর্টের ধমক একটা কারণ। কিন্তু আরও বড় কারণ কোভিড-পর্বের অসন্তোষ মেটানো। উত্তরপ্রদেশে দুর্বল হওয়ার অর্থ, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়া। মোদি-যোগী দ্বৈরথ টেনে আনছে বাজপেয়ী-কল্যাণ সিংয়ের লড়াইয়ের স্মৃতি। নয়ের দশকের শেষের সেই লড়াইয়ের পরিণতি সবার জানা। দলত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন কল্যাণ সিং। সেই সময়ে কল্যাণ সিংয়ের রাজনৈতিক উচ্চতা ও গ্রহণযোগ্যতা আজকের যোগী আদিত্যনাথের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এটা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি– অটলবিহারী বাজপেয়ীর মতো নরম মনের মানুষ বলে নরেন্দ্র মোদি পরিচিত নন। হার-জিত যাই-ই হোক, মোদি-যোগী দ্বৈরথ কিন্তু মেসি-রোনাল্ডোর মতো জমে গিয়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.