নতুন জোট সরকার গঠন করে নরেন্দ্র মোদি তঁার তৃতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্ব শুরু করলেন বটে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পূর্বতন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া বিজেপি সরকার যে-নিয়মে চলছিল, সেই নিয়ম-ই বহাল রয়েছে। এবং পরীক্ষা দুর্নীতি, রেল দুর্ঘটনা, মণিপুর হিংসা– সব চলছে, এবং প্রধানমন্ত্রী নিশ্চুপ। ওদিকে, তঁার ‘মন কি বাত’ রেডিও-বার্তা ফের শুরু করছেন। কিচ্ছু বদলায়নি। এ কি লোকসভা নির্বাচনের জনাদেশের অপমান নয়? লিখলেন রাজদীপ সরদেশাই।
অভূতপূর্ব এই লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আরও বিনীত করে তুলবে, আমরা ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মোদি সরকারের ভাবখানা এমন, তারা আদপে ‘চারশো পার’ অর্থাৎ ৪০০টি আসন জিতেই এই জয় নিশ্চিত করেছে। আর কংগ্রেসও কিছু কম যায় না। তাদের ভাব এমন যেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারাই পেয়েছে। ভারতীয় রাজনীতিকে যেখানে মেরুবিভাজন থেকে কিছুক্ষণের জন্য অন্তত বের করে শ্বাস নিতে দেওয়া দরকার, সেখানে উলটে ভেদাভেদ-বৈরিতার পুনরুত্থান ঘটছে নবকলেবরে। বিশ্বাস না-হলে জ্বলজ্বলে উদাহরণ– লোকসভা স্পিকারের নির্বাচন নিয়ে অহেতুক বখেড়া ও কেঁাদল! দেখেই বোঝা যাবে, শান্তি ও ঐক্য নির্মাণের চেষ্টায় নিদারুণ অভাব না থাকলে এমনটা ঘটে না।
দুশ্চিন্তার আরও অনেক লক্ষণ রয়েছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের পিছনে এখনও পড়ে রয়েছে ইডি। ইডি-র একটি মামলা থেকে জামিন পেয়েছেন, তার হয়তো কয়েক ঘণ্টা হয়েছে বড়জোর, কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে এসেছে সিবিআই। ঔপন্যাসিক অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে ১৪ বছরের পুরনো মামলা আবার নতুন করে ফাইলের স্তূপ থেকে তুলে আনা হয়েছে এবং তঁার বিরুদ্ধে নতুন করে বিচারের ঘটা জেগেছে। উত্তরপ্রদেশে বুলডোজার দিয়ে ঘর-বাড়ি ভাঙার কাজ চলছে বহাল তবিয়তে।
আর গোরক্ষকদের জুলুম আবার শুরু হয়ে গিয়েছে– তিনজন গবাদি পশু ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তারা, এই মাসের শুরুর দিকের কথা।
ভোটারদের এই জনাদেশকে যেভাবে তীব্র অসম্মানিত করা হচ্ছে, তাতেও আর অবাক হওয়া উচিত মনে হচ্ছে না। নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাতন্ত্রর অন্যতম পদ্ধতিই হল– তঁার শাসনব্যবস্থায় যা কিছু রাজনৈতিক বা সামাজিক দুর্বলতা, সেসব সর্বসমক্ষের কাছে পুরোপুরি আড়াল করে রাখা। গান্ধীনগর থেকে দিল্লি– অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে প্রধানমন্ত্রিত্ব জুড়ে, তঁার ২৩ বছরের নিরবচ্ছিন্ন শাসনকালে, নরেন্দ্র মোদি একবারও তঁার সরকারের দুর্বলতা বা অক্ষমতা বা ভুল সিদ্ধান্তকে স্বীকার করেননি জনসমক্ষে। যা থেকে সহজেই বোঝা যাবে, কেন ৪ জুন বিজেপির নাকানিচোবানি খাওয়া জনাদেশ প্রাপ্তির পরেও, নরেন্দ্র মোদির হাবভাব– যেন কিছুই হয়নি, কিছুই বদলায়নি। সেই একইরকম ক্যাবিনেট মন্ত্রক, দেশ-বিদেশে সেই একইরকম বানানো ঘটনাচ্ছটা বলে দিচ্ছে– নরেন্দ্র মোদি তঁার প্রধানমন্ত্রিত্বের তৃতীয় দফাতেও নিজেকে বদলাতে নারাজ; তা তিনি যতই বর্তমানে একটা জোট সরকারের প্রধান নেতৃত্ব হয়ে থাকুন না কেন। উলটে, চলতি হাওয়ার পঙ্ক্তি হয়েই তঁার শাসন চলছে বেমালুম। কিন্তু, এটাই কি হওয়ার কথা, এমনই হয়? না কি, এটা তঁার অজেয় থাকার বিপুল ভনিতা? ক্ষমতাসীন সরকারের এই আয়োজন কি তাহলে বাস্তবোচিত না থেকে এখনও ঔদ্ধতে্য ডুবে আছে?
নিট-ইউজি এবং ইউজিসি-নেট পরীক্ষার ঘটনাই দেখুন না। রাস্তায় নামতে বাধ্য হল পড়ুয়ারা। এত বড় একটা দুর্নীতির ঘটনা, অথচ অদ্ভুতভাবে, মোদি সাহেব বেমালুম স্পিকটি নট। তিনি সমস্ত দায়িত্ব শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানের উপর ন্যস্ত করেছেন, সরকারের তরফে বক্তব্য রাখার জন্য। যথারীতি, পূর্বতন বিজেপি সরকারেও ধর্মেন্দ্র প্রধানই শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ফলে, এহেন ঘটনায় তঁার আকাশ থেকে পড়ার সুযোগও নেই। তবু, কা তব কান্তা। আদপে, এই পেপার লিক দুর্নীতিচক্র পুরনো পাপ ভূত হয়ে ফিরে আসার ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত। বিগত সাত বছরে, ৭০-এরও বেশি জাতীয় ও রাজ্য স্তরের পরীক্ষার পেপার লিক হয়েছে, আর তা রুখতে কর্তৃপক্ষ ধরাশায়ী, উপরন্তু জড়ভরত। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, ধর্মেন্দ্র প্রধান প্রাথমিকভাবে এই দুর্নীতি কিছুতেই মানতে রাজি হননি, তারপর দোষ দাগলেন প্রতিবাদী পরীক্ষার্থীদের উপর, আর শেষমেশ একে নিতান্ত ভুলচুক বলে ধার্য করলেন– ফলে, বুঝতে অসুবিধা হয় না, তিনি এক সমান্তরাল বিশ্বে বসবাস করছেন, যেখানে তিনি ভাবছেন, তিনি যা বলবেন, মানুষ সেটাই বিশ্বাস করে নেবে। ধর্মেন্দ্র প্রধান হয়তো ভেবেছিলেন, তঁাকে ওড়িশার প্রথম বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী করে দেওয়া হবে, কিন্তু এখন তঁাকে তঁার নিরবচ্ছিন্ন দায়িত্বের ভারে পরীক্ষা সংক্রান্ত দুর্নীতির মুখোমুখি হতেই হবে। ফলে, তিনি এখন বেশ চাপে।
উপহাসের কথা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বার্ষিক বক্তৃতা ‘পরীক্ষা পে চর্চা’-য়, পড়ুয়ারা যখন জিজ্ঞেস করেছিল কম্পিটিটিভ পরীক্ষার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেব– তিনি তখন নিজের প্রতি গর্বের আখ্যান গেয়েছেন। আর বাকি মোদি-কেন্দ্রিক ইভেন্টে যেমনটা হয়ে থাকে, বেশ মহড়া দেওয়া এমন সব আয়োজনে নরেন্দ্র মোদি হয়ে ওঠেন ‘ফিল-গুড’ গুরু, ভাল ভাল নিশ্চিন্ত উপদেশ দেন। এই ‘চর্চা’-তেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
কিন্তু পরীক্ষার্থীরা যে এই দুর্নীতির পঁাকে পড়ে সাহায্য চেয়ে, বিভ্রান্ত হয়ে মরিয়া অবস্থায়, এখন মোদিজির টিকি-টিরও পাত্তা নেই। কোনওরকম ব্যবস্থা বা আশ্বাসবাণী তো দূর, পরীক্ষার্থীদের প্রতি সহমর্মিতার একবিন্দু শব্দ খরচ তিনি করার প্রয়োজন বোধ করেননি। এই সরকার কোনওভাবেই তাদের নির্বিবাদীকল্পলতা কমফর্ট জোন থেকে বেরতে রাজি নয়, যেন যে কোনওরকম খারাপ খবর বা অভিযোগ বা অনুযোগ তাদের কাছে অভিশাপ।
কেন্দ্রীয় সরকারের এহেন কল্পময় সুখী সত্য-গ্রহণে অনিচ্ছুক দশার আরও একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রায় ১৩ মাস হতে চলল, মণিপুরে হিংস্রতার ধারা কিন্তু অব্যাহত। নিজের রাজনৈতিক মহিমা কাজে লাগিয়ে শান্তি আবাহনের ঝুঁকি নেওয়া তো দূর, প্রধানমন্ত্রী এর থেকে দূরে থাকাই বেছে নিয়েছেন। এমনকী, এই অশান্ত পরিস্থিতি-কালীন একবারও তিনি মণিপুর পরিদর্শনের প্রয়োজন বোধ করেননি। দীর্ঘ নির্বাচনী প্রচার অভিযানকালে, নরেন্দ্র মোদি গুচ্ছ গুচ্ছ মিডিয়া ইন্টারঅ্যাকশনে গিয়েছেন, কিন্তু একবারের জন্যও মণিপুরের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেননি। যদিও, এও দস্তুর, তাবৎ মিডিয়াকুল তঁাকে এহেন প্রশ্ন করারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। উলটে এসবের কৈফিয়ত দেওয়ার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-র উপর। তিনিই এই রাজে্য শান্তি ফেরাবেন, রক্তারক্তি থামাবেন। এবং, অমিত শাহ একাধিক উচ্চস্তরীয় রিভিউ মিটিং করেছেন মণিপুরের সুরক্ষা মন্ত্রকের সঙ্গে, কিন্তু সেখানে গিয়ে রাজনৈতিক মধ্যস্থতা এবং মানুষের মধে্য পৌঁছে যাওয়াটা যে জরুরি, তাতেই যে নিরাময় ঘটবে– সেসবের চিন্তা বা পদক্ষেপ তো কই ধরা পড়ছে না!
এবার রেলপথে নামা যাক। মোদি সরকারের গর্বের অলংকার-ভূষণ বলে কথা। হা হতোস্মি, একাধিক রেল দুর্ঘটনা! সাম্প্রতিকতম– কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস এবং মালগাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ– যা, রেলওয়ে সুরক্ষা পদ্ধতির খামতির ফাটলে আরও তীব্র আলোকপাত করেছে। এই দেশের বহুধাবিস্তৃত বিপুল রেলপথ জালিকায়, বহু প্রতীক্ষিত অ্যান্টি-কলিশন সিস্টেম ‘কবচ’ আয়োজন কতিপয় রেলপথে প্রযুক্ত! এবং, শিক্ষামন্ত্রীর মতোই, অশ্বিনী বৈষ্ণো-ও যথারীতি নতুন সরকারে সেই রেলমন্ত্রী হিসাবেই নিযুক্ত হয়েছেন। উপর্যুপরি, রেলওয়ে ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রক ছাড়াও তঁাকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। খোরাক বলব না কি নিয়তি, জানি না, এই দুর্ঘটনার দিন, আমাদের এহেন মাল্টি-টাস্কিং মন্ত্রীমশাইকে গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মহারাষ্ট্র নির্বাচনের কো-ইনচার্জ হিসাবে। আমাদের দেশ কি একজন ফুলটাইম রেলমন্ত্রীও পাবে না? না কি, এই প্রশ্ন করাটাও এখন সিলেবাস বহির্ভূত হয়ে দঁাড়িয়েছে? একের পর এক বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ট্র্যাকে নামানোর সময় সাহংকারে সবুজ পতাকা নাড়াতে যখন পিছপা হয় না এই সরকার ও তার নিযুক্ত মন্ত্রী, তাহলে রেলের বিপর্যয়ের দায় নেওয়ার বেলায় এই স্বীকৃতিমোহ কোথায় পালায়? সতি্যটি এই, তীব্র এক উদাসীন নিষ্কর্মা পরিচালন পদ্ধতি চলছে এই কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায়, যেখানে সমস্তটা চলছে হাতে গোনা কয়েকজনের নিয়ন্ত্রণে। আর সেখানে সরকার ও পার্টির মধে্যকার বিভাজন-রেখা হয়ে আছে আবছা। সেখানে, সিদ্ধান্ত-গ্রহণ এতটাই অস্বচ্ছ যে, তার ফলাফলের দায়ভার নেওয়ার নূ্যনতম অওকাদটুকু নেই।
আর এখানেই গয়ংগচ্ছ যেমন-কে-তেমন সরকার পরিচালন পদ্ধতির ফিরে আসা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আগের বার, দানবীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি বকলমে মোদি সরকার এল আর একরোখা পদক্ষেপ শুরু হল। একে একে কোণঠাসা করা হল বিরোধী পক্ষকে, আর কোনওরকম সরকার-বিরোধিতা বা সরকারের সমালোচনাকে দাগিয়ে দেওয়া শুরু হল ‘দেশদ্রোহী’ রূপে। কিন্তু, ২০২৪-এর নির্বাচন দেখিয়েছে, মোদির একাধিপত্য আর আখ্যানমুখ হিসাবে নেই– একইসঙ্গে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে বিরোধী পক্ষ, যার ফলে বিরোধী স্বরের জোর আরও বাড়বে, এমনকী তারা নতুন নতুন ভাবনাচিন্তা ও লক্ষে্যর আয়োজন করতেও পারবে। জনসাধারণ্য পরিগণিত একটা স্বৈরাচারী সরকার হয়তো তাদের হাবভাব সহজে বদলাবে না, কিন্তু একদিন না একদিন তাদের স্বেচ্ছাচারী কল্পনাচর্চা ছেড়ে বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়তে হবেই। প্রায় একটা দশক ক্ষমতাসনে থেকে, অন্ধের পটি বেঁধে সবকিছুকে অস্বীকার করা মোটেই আর বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
পুনশ্চ: এই সপ্তাহান্ত থেকে, প্রধানমন্ত্রী (PM Modi) আবার তঁার মাসিক ‘মন কি বাত’ রেডিও-বার্তা দেওয়া শুরু করবেন। যা থেকে বোঝা যায়, তিনি তঁার জনসংযোগের ধরন মোটেই পালটাচ্ছেন না। তাহলে, মোদিজির কাছে আমার একান্ত চাওয়া, তঁার ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানেই না হয় তিনি আমার আজকের লেখায় তুলে আনা প্রশ্নগুলোর জবাব দিন, তা সে যতই অস্বস্তিকর লাগুক না কেন!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.