গণ আন্দোলন থেকে উঠে আসা বামপন্থী গাব্রিয়েল বরিচ চিলি-র নতুন প্রেসিডেন্ট। ‘পিঙ্ক টাইড’ আসছে? লিখছেন মিলন বশিষ্ট
‘তুমি সমস্ত গাছ কেটে ফেলতে পারো, তাতে কি বসন্ত আসবে না?’ পাবলো নেরুদার এই বিখ্যাত পঙ্ক্তি এতদিন চিলির নাগরিকরা ব্যবহার করতেন সামরিক শাসক অগুস্ত পিনোচে-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের দিনগুলোকে স্মরণ করে। কে জানত, কথাগুলিকে হালে আবার প্রাসঙ্গিক করে তুলবেন ৩৫ বছরের যুবক গাব্রিয়েল বরিচ ফন্ট। চিলির নতুন প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট। মাত্র ৩৫ বছর বয়স।
বরিচ বামপন্থী। যেসব দাবি বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি চিলির রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ হয়ে ও সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে ক্ষমতায় বসতে চলেছেন, সেগুলি সামাজিক অসাম্য দূর করার কথা বলে। ১০ বছর আগে ছিলেন চিলির বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবাদী মুখ। এক যুগের মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতিতে তাঁর এই নাটকীয় উত্থান তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতোই। শরীরে ট্যাটু, দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করা মার্কিনি গায়িকা টেলর সুইফটের ভক্ত গাব্রিয়েল বরিচ দক্ষিণ আমেরিকার সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতিতে সম্ভবত প্রথম রাজনীতিক, যিনি টাই পরেন না। আপন মানসিক অসুস্থতার কথা এত জোর গলায় বলেন যে, চিলির তরুণ প্রজন্ম তাঁর সঙ্গে ‘আইডেন্টিফাই’ করতে পারে।
এতটাই সেই দেশের তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে তাঁর ‘কানেক্ট’ বা ‘সংযোগ’ যে, প্রবল দক্ষিণপন্থী হোসে আন্তোনিও কাস্ট-কে হারিয়ে যখন দেশের সর্বকালের তরুণতম রাষ্ট্রনায়কের জয়ের খবর ঘোষিত হচ্ছে, তখন সান্তিয়াগোয় মানুষের ঢল। জনজোয়ারে ভাসতে ভাসতে ৩৫ বছরের নতুন প্রেসিডেন্ট মঞ্চে পৌঁছেছেন ফেন্সিং টপকে। তাঁর গত এক দশকের রাজনীতির ট্রেডমার্ক স্টাইলে। তারপরে টাই না-পরা নতুন রাষ্ট্রনায়ক গালের দাড়িতে হাত বুলিয়ে সমর্থকদের উদ্দেশ্যে যেটা বলেছেন, সেটাও অবিস্মরণীয়: আমি প্রত্যেকের প্রেসিডেন্ট, যাঁরা আমাকে ভোট দেননি, তাঁদেরও।
লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার সঙ্গে বামপন্থার সংঘাত বহু পুরনো। মার্কিনি মদতে অজস্র সামরিক অভ্যুত্থান আর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের রমরমা তামাম দুনিয়া দেখেছে। সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়ায় ভর করে জিতে আসা নতুন প্রেসিডেন্টের এ-কথা বলার জন্য ধক লাগে বইকি। টেলিভিশনে বিশ্ব যখন সেই দৃশ্য দেখেছে, তখন জেনে গিয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে এক নতুন তারকার আর্বিভাব ঘটেছে, যিনি আদতেই ‘স্ট্রিট ফাইটার’।
দু’-বছর আগে চিলি উত্তাল হয়েছিল স্বৈরতান্ত্রিক সময়ের সংবিধান বাতিলের দাবিতে। সেই গণ আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকেছেন বরিচ। এরপর যখন চিলিতে গণভোট হল এবং দেখা গেল মানুষের রায় সংবিধান সংশোধনের পক্ষে, বোঝা গিয়েছিল, দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশে কী প্রবল পরিবর্তনের হাওয়া! সেই হাওয়ায় ভেসেই এক নতুন জোট এল, যে-জোটে চিলির কমিউনিস্ট পার্টিও শরিক দল। আর সেই জোটের নেতা গাব্রিয়েল বরিচ ক্ষমতায়।
লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে গত কয়েক দশক ধরেই ‘ব্লু টাইড’ আর ‘পিঙ্ক টাইড’ দুটো খুব পরিচিত আর প্রতিস্পর্ধী শব্দ। বরিচের জয়কে ওই মহাদেশে ‘পিঙ্ক টাইড’-এর ফিরে আসার চিহ্ন বলে মনে করা হচ্ছে। ‘ব্লু’ মানে দক্ষিণপন্থা বা দক্ষিণপন্থী দলগুলির শাসন। যখন লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশে দক্ষিণপন্থী দলগুলি জেতে, তখন বলা হয় ‘ব্লু টাইড’ বা ‘নীল ঢেউ’ চলছে। আর, ‘পিঙ্ক’ মানে মেশানো লাল, অর্থাৎ যে দল বা রাজনৈতিক শক্তিগুলির একটা কমিউনিস্ট অতীত বা বামপন্থী ঝোঁক আছে। কিউবা বা ভেনেজুয়েলার মতো সরাসরি কমিউনিস্ট সরকারকে বাদ দিলে লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলিতে যখন সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী দলগুলো জিততে থাকে, তখন বলা হয় ‘পিঙ্ক টাইড’ এসেছে। পতাকার রং হয়তো লাল নয়, কিন্তু দিনবদলের এই পৃথিবীতে যাঁরা নিজেদের ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট’ বলে পরিচয় দেন, তাঁদের জয়কে ‘পিঙ্ক টাইড’-ই বলা হয়।
চিলিকে দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি ধরা হয়। এর আগে পেরুতে ক্ষমতায় এসেছেন পেদ্রো কাস্টিলো আর হন্ডুরাসে সিওমারা কাস্ত্রো। দু’জনেই গণ আন্দোলন থেকে উঠে আসা নেতা, ঘোষিত বামপন্থী। ব্রাজিল আর কলম্বিয়ায় সামনের বছর নির্বাচন। সমস্ত ‘ওপিনিয়ন পোল’ বলছে, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী নেতারা ক্ষমতায় আসবেন। ব্রাজিলের ঘটনাটি আলাদাভাবে উল্লেখ করার মতো, কারণ সেখানে ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভার-র, যিনি দুর্নীতির অভিযোগে জেল খেটেছেন। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট লুলা-র ফিরে আসাটা চমকপ্রদ, কারণ আদালতের রায়েই তাঁর নির্বাচনে লড়ায় নিষেধাজ্ঞা ছিল, আবার ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের রায়েই তিনি নির্বাচনী দৌড়ে ফিরে এসেছেন। সব ওপিনিয়ন পোলে ব্রাজিলের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান বোলসেনেরো-র থেকে দ্বিগুণেরও বেশি মানুষের সমর্থনে এগিয়ে থাকা লুলা ক্ষমতায় এলে হয়তো দক্ষিণ আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসকে নতুন করে লিখবেন। চিলিতে বরিচ, পরে ব্রাজিলে লুলা আর কলম্বিয়ায় গুস্তাভ পেত্রো জিতলে- দক্ষিণ আমেরিকায় ‘গোলাপি ঢেউ’-এর প্রবল উপস্থিতি মেনে নিতেই হবে।
ফুটবলীয় শ্রেষ্ঠত্ব, সাহিত্য সৃজন (ম্যাজিক রিয়ালিজম) এবং সামাজিক অসাম্য থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক বাস্তবতা। লাতিন আমেরিকা মূলত তিনটি কারণে সুবিদিত। চে গুয়েভারা বা ফিদেল কাস্ত্রোর বামপন্থার অমোঘ রোমান্টিক আকর্ষণে বিশ্ব ভেসেছে বারবার। ধনতান্ত্রিক আমেরিকার নাকের ডগায় বসে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়েছে লাতিন আমেরিকা। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ তামা পাওয়া যায় যে-দেশে, যে-দেশের গড় মাথাপিছু আয় ভারতের থেকে ৬ গুণ তো বটেই, চিনের থেকেও বেশি, বাজার অর্থনীতির সেই চ্যাম্পিয়ন চিলিতে একজন বামপন্থী সামাজিক অসাম্য দূর করার কথা বলে ভোটে জিতছেন, এই খবরে তো বিশ্ব কেঁপে উঠবেই। মনে রাখতে হবে, মার্কিন রাজনীতিও কিন্তু এখন আর আগের সেই জায়গায় নেই। বস্টনের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে এখন মিশেল উ নামে এক অভিবাসী মহিলা মেয়র, দ্বিধাহীনভাবে নিজেকে যিনি ‘বামপন্থী’ বলেন।
চিলির বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার মিগুয়েল লিটিনের লুকিয়ে দেশে ফেরা এবং পিনোচের শাসনের অপব্যবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে তথ্যচিত্র বানানো নিয়ে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস লিখেছিলেন ‘ক্ল্যান্ডেনস্টাইন ইন চিলি’। যা বাংলায় অনুবাদ করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ‘চিলিতে গোপনে’ নামে। পিনোচের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটেছে ৩৫ বছর আগে। সেই দেশ এখন একনায়কতন্ত্রের সময়কার সংবিধানকেও বাতিল করে দিচ্ছে। এই বদলে দেওয়ার সময়ের নেতা গাব্রিয়েল বরিচ। এই চমকপ্রদ জয়, এই ‘গোলাপি ঢেউ’ তাহলে কী বলে? বলে যে, স্ট্রিট ফাইটারদের দিকে নজর রাখুন। গণ আন্দোলন আখেরেই রাজনৈতিক ইতিহাস বদলে দিতে পারে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.