বিশ্বদীপ দে: দেখতে দেখতে ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার। এদেশ ২৬/১১ দেখেছে। দেখেছে সংসদে হামলা। এমন বহু। জঙ্গিদের অশ্লীল হত্যালীলা ও ধ্বংসের মত্ততায় সাধারণ মানুষের হৃদয়ে লেগেছে রক্তদাগ। একেকটি সন্ত্রাসের ঘটনার জলছাপ থেকে যায় বহু বহু বছর। গত মঙ্গলবার সেই তালিকায় নতুন সংযোজন পহেলগাঁও। কিন্তু এবারের হামলা সন্ত্রাসের চিরাচরিত চেহারাটাকেই বদলে দিয়েছে যেন। নারকীয়তার মডেল এখানে একটু অন্যরকম। ধর্মপরিচয় জেনে বেছে বেছে ‘হিন্দু নিধন’-এর এই সন্ত্রাস-মডেল আগের গুলির থেকে কিছুটা আলাদা। আর এতেই প্রমাদ গুনছে ওয়াকিবহাল মহল। সুদূরপ্রসারী হিংসার কোন বীজ পুঁততে চাওয়ার প্রবণতা রয়েছে এই ছকে?
প্রসঙ্গত, পুলওয়ামার পর জম্মু ও কাশ্মীরের মাটিতে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে গত মঙ্গলবার। বিকেলে পহেলগাঁওয়ের এক রিসর্টে পর্যটকদের উপর হামলা চালায় জঙ্গিরা। রীতিমতো ধর্মীয় পরিচয় দেখে দেখে হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের। স্থানীয় সূত্রের দাবি, জঙ্গিরা এসেছিল সেনার পোশাক পরে। সব মিলিয়ে ৪০ রাউন্ড গুলি চলেছে। মূলত আক্রমণ করা হয় অমুসলিমদের। যে কোনও জঙ্গি হামলাই আসলে বিশ্বাসভঙ্গ, নিষ্ঠুরতা এবং মানবতাকে থেঁতলে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্ত। এবং তা সব সময়ই আগামী হিংসার বীজ ছড়িয়ে রেখে যায়। সন্ত্রাসের প্রত্যক্ষ শিকার যতজন, পরোক্ষ শিকার তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রভাব এক অন্যরকম তীক্ষ্ণ হাতিয়ার হয়ে ওঠে সন্ত্রাসীদের। কিন্তু পহেলগাঁও হামলা যেন আরও নিষ্করুণ ভাবে এদেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকেই চূর্ণ করতে চাইছে।
আসলে এমনটাই হয়তো জঙ্গিদের অভীষ্ট। কাশ্মীরে সাম্প্রতিক অতীতে পরিযায়ী শ্রমিকরা ‘টার্গেট’ হয়েছেন জঙ্গিদের। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদীদের বুলেটে শহিদ হয়েছেন জওয়ানরা। কিন্তু এবার আলাদা করে ধর্মপরিচয় জেনে নিয়ে খুন করা হয়েছে পর্যটকদের। বিভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দা হলেও সকলেই হিন্দু। হ্যাঁ, হামলায় একজন মুসলিমেরও মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তিনি জঙ্গিদের লক্ষ্য ছিলেন না। তাদের বাধা দিতে গিয়েই প্রাণ হারিয়েছেন ওই ব্যক্তি। যাই হোক, হিন্দুদেরই এভাবে সুস্পষ্ট ভাবে টার্গেট করায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটা বিদ্বেষের আবহ তৈরি করে হিন্দু-মুসলিম বাইনারিকে আরও অক্সিজেন জোগানোই জঙ্গিদের উদ্দেশ্য। এহেন পরিস্থিতিতে ইসলামোফোবিয়া বাড়তে পারে। আর মনে রাখতে হবে, কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের উপরে ভীতি জন্মালে তা থেকে আগ্রাসনের জন্ম হবে। সেই আগ্রাসনের সুযোগ নেবে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। অন্যদিকে উগ্র ইসলামপন্থীরাও রসদ পাবে।
আর এহেন পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলিকে আরও দায়িত্ব নিতে হবে। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর আগে দশবার ভাবা দরকার। কিন্তু ততটা দায়িত্ববান কি তারা হবে? সম্প্রতি রবার্ট বঢরা বলেছেন, ”যদি আপনি এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণ করেন, তাহলে দেখবেন, জঙ্গিরা মানুষের ধর্মপরিচয় জানতে চেয়েছে। তারা কেন এটা করছে? কারণ আমাদের দেশে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে।” তিনি কংগ্রেসে যোগ দেননি এখনও। যদিও গতবারের লোকসভায় তিনি ভোটে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। তবু গান্ধী পরিবারের জামাই তিনি। তাই তাঁর এহেন মন্তব্যকে এড়িয়ে গেলে হবে না।
অন্যদিকে বাংলার বিরোধী দলনেতা তথা বঙ্গ বিজেপির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা শুভেন্দু অধিকারী পহেলগাঁও নিয়ে তাঁর মতামত জানিয়েছেন। সোশাল মিডিয়ায় তিনি লিখেছেন, ‘কাশ্মীর, পশ্চিমবঙ্গ কিংবা বাংলাদেশ, একটাই লক্ষ্য; হিন্দুদের বেছে বেছে করতে হবে শেষ।/ যখন হিন্দুদের বিরুদ্ধে শত অপকর্ম, /তখন ধর্মই হোক আমাদের একমাত্র বর্ম।’ অর্থাৎ হিন্দুত্ব নিয়ে সুর চড়িয়েছেন তিনি।
পহেলগাঁও হামলা নিয়ে মুখ খুলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দাবি, ভারতের আত্মায় আঘাত করার দুঃসাহস যারা দেখিয়েছে, তারা ছাড় পাবে না। এক্ষেত্রে তাঁর মুখে উচ্চারিত ‘ভারত-আত্মা’ কথাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই আত্মাকে রক্ষা করাই আসল উদ্দেশ্য। দেশের প্রধান শাসক দল বিজেপিকে বুঝতে হবে এদেশের ২০-২৫ কোটি মানুষ মুসলিম। যে ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’-এর কথা মোদি বলেন, সেটাই করে যেতে হবে। কেবল বিজেপিই নয়, প্রতিটি রাজনৈতিক দল তথা সমস্ত মানুষকে বুঝতে হবে তাদের সত্তাকে যেন বিষিয়ে তুলতে না পারে জঙ্গিরা। তবেই জঙ্গিদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে। নাহলে ভারতের আরেকটা আফগানিস্তান, আরেকটা বাংলাদেশ হয়ে ওঠা কিন্তু আটকানো যাবে না। তাই দায়িত্ব আমজনতার। আবেগ নয়, বিবেক দিয়ে বিচার করতে হবে।
শেষ করার আগে রবীন্দ্রনাথে ফিরি। ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘ধর্মমত ও সমাজরীতি সম্বন্ধে হিন্দু-মুসলমানে শুধু প্রভেদ নয়, বিরুদ্ধতা আছে, এ কথা মানতেই হবে। অতএব আমাদের সাধনার বিষয় হচ্ছে, তৎসত্ত্বেও ভালোরকম করে মেলা চাই। এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ আমাদের না হলে নয়।’ বহু বছর আগে বলা এই কথাগুলি আজও একই রকম প্রাসঙ্গিক। সাধারণ মানুষ, সাধারণ ভারতীয় নাগরিককে এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.