প্রতীকী ছবি।
অক্সফ্যামের রিপোর্টে ভারতের ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষমে্যর ছবিটি প্রকট হয়েছে আরও। সরকারের উদ্দেশে তাদের পরামর্শ হল, ভারতের কর-কাঠামোর ক্ষেত্রে কয়েকটি সংস্কার আনার প্রস্তাব। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
‘অক্সফ্যাম’-এর রিপোর্ট ফের খবরে। এই রিপোর্টের কারণেই প্রতি বছর প্রচারের অালো পেয়ে যায় ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’। কয়েক দিন আগেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল (Arvind Kejriwala) প্রশ্ন তুলেছিলেন, ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামে কেন সরকারি পয়সা খরচ করে মন্ত্রী, আমলারা যান? দিল্লির উপরাজ্যপাল ভি. কে. সাক্সেনা সেই রাজে্যর প্রাথমিক শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দলের ফিনল্যান্ড যাওয়ার ফাইল আটকে দিয়েছেন।
উপরাজ্যপালের প্রশ্ন, দিল্লির এই শিক্ষকদের সরকারি খরচে ফিনল্যান্ড ঘুরিয়ে এনে রাজে্যর কী উপকার হবে– তা কি ‘কস্ট-বেনিফিট অ্যানালিসিস’ করে দেখা হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে কেজরিওয়াল পাল্টা জানতে চেয়েছেন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে যোগ দিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও আমলারা যে, ফি-বছর সুইজারল্যান্ডে যান, তার কি কোনও ‘কস্ট-বেনিফিট অ্যানালিসিস’ হয়েছে?
অক্সফ্যামের রিপোর্ট কেজরিওয়ালের তোলা এই প্রশ্নটাকে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক মনে করছে। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামে ফি-বছর অক্সফ্যামের রিপোর্ট নিয়ে পর্যালোচনা শুনে ফিরে আসার পর কি আমাদের মন্ত্রী, আমলারা দেশে বৈষম্য কমানোর কার্যকর কোনও পদক্ষেপ করেন? সরকারি খরচে সুইজারল্যান্ডে গিয়ে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামে অংশ নেওয়ার উপকারটা তাহলে কী?
এবারও অক্সফ্যাম তাদের রিপোর্টে ভারতের ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষমে্যর ছবিটি তুলে ধরে একগাদা পরামর্শ দিয়েছে। সব ক’টা পরামর্শই সরকারের উদ্দেশে। এই পরামর্শগুলোর মধে্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ভারতের কর-কাঠামোর ক্ষেত্রে কয়েকটি সংস্কার আনার প্রস্তাব। সামনেই কেন্দ্রীয় বাজেট। অক্সফ্যামের িরপোর্ট নিয়ে তার আগে দেশজুড়ে যথেষ্ট তর্ক-বিতর্ক হবে। বিরোধীরা কেউ কেউ এই রিপোর্টকে সরকারের সমালোচনায় হাতিয়ার বানাবে। কিন্তু, বৈষম্য কমানোর লক্ষে্য প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোর কিছুই হবে না। অক্সফ্যামের সংস্কারমূলক প্রস্তাবগুলো যে, সরকারের কাছে কোনও গুরুত্ব পায় না, তা স্পষ্ট হয় প্রতি বছর বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার রিপোর্ট দেখেই।
এবার অক্সফ্যাম যে-রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের হাতে দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ রয়েছে। আর আয়ের মাপকাঠিতে নিচে থাকা দেশের ৫০ শতাংশ মানুষের কাছ থেকে যেখানে সরকার ১৪.৮৩ লক্ষ কোটি টাকা জিএসটি আদায় করছে, সেখানে আয়ের মাপকাঠিতে উপরে থাকা ধনী ১০ শতাংশের কাছ থেকে আদায় করা জিএসটি-র পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশ। যে কোনও পণ্য ও পরিষেবা কিনলেই জিএসটি দিতে হয়। সরকারের আয়ের প্রধান সূত্র যে এই জিএসটি, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। জিএসটি-র ভার মূলত এসে পড়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের ঘাড়েই। দেশে আয়ের চূড়ান্ত বৈষম্য থাকলেও কর আদায়ের ক্ষেত্রে এই অদ্ভুত ব্যবস্থাটাই কেন্দ্রীয় সরকার চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর।
আয়কর, কর্পোরেট কর ইত্যাদি প্রত্যক্ষ কর সরাসরি বড়লোকদের ঘাড়ে চাপালে আর্থিক বৈষম্য কমতে পারে, কিন্তু সে-পথে হঁাটে না কোনও সরকারই। অক্সফ্যাম তাদের রিপোর্টে বলেছে, দেশে ১০ জন সবচেয়ে বড়লোকের উপর যদি এককালীন ৫ শতাংশ আয়কর চাপানো হয়, তাহলেই সরকারের ঘরে চলে আসতে পারে অতিরিক্ত ১.৩৭ লক্ষ কোটি অতিরিক্ত টাকা। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সারা বছরের মোট খরচ ৮৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, সরকার দেশের সবচেয়ে বড়লোক ১০ জনের কাছ থেকে সামান্য পরিমাণ অতিরিক্ত আয়কর আদায় করলেই স্বাস্থ্যমন্ত্রকের সারা বছরের খরচের দেড়গুণ তুলে আনতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ শিল্পোদে্যাগী গৌতম অাদানির সম্পত্তির মূল্য ২০১৭ থেকে ২০২১-এর মধে্য শেয়ার বাজারে যা বেড়েছে, তার উপর এককালীন কর চাপালেই সরকার পেতে পারে ১ লক্ষ ৭৯ হাজার কোটি টাকা। যা দিয়ে সরকার দেশের ৫০ লক্ষ প্রাথমিক শিক্ষকের একবছরের বেতন দিতে পারে।
অক্সফ্যাম তাদের রিপোর্টে দেশে আর্থিক বৈষম্য কমানোর যেসব দাওয়াই দিয়েছে, তা মোটেই অভিনব নয়। অতীতেও তাদের রিপোর্টে এই সমস্ত দাওয়াইয়ের কথা ছিল। কিন্তু, আমাদের বর্তমান সরকার অর্থনীতিতে ‘ট্রিক্ল ডাউন’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। তারা মনে করে, বড়লোকদের আরও কিছু কর ছাড় দিয়ে আয় বাড়াতে উৎসাহী করা উচিত। বড়লোকরা যদি আরও আয় বাড়ানোর উৎসাহ বোধ করে, তাহলে তাদের নানাবিধ অর্থনৈতিক উদে্যাগ গরিব মানুষের কাছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে যাবে। লকডাউনের সময় আমরা দেখেছি, কেন্দ্রীয় সরকার আয় বাড়াতে নিয়মিত পেট্রোল ও ডিজেলের উপর কর চাপাচ্ছিল। অথচ আচমকা ছাড় দেওয়া হল কর্পোরেট করে। কর্পোরেট করে ছাড়ের যে ঘাটতি, তা তোলা হল পেট্রোল ও ডিজেলের উপর বাড়তি কর থেকে। পেট্রোল ও ডিজেলের উপর বাড়তি এই করের বোঝা কারা বহন করে? পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বাড়লে পরিবহণের খরচ বাড়ে।
যার প্রভাব সমস্ত পণে্যর উপর গিয়ে পড়ে। এই পণে্যর প্রধান ক্রেতা নিম্নবিত্ত ও গরিব মানুষ। অক্সফ্যাম তাদের এই রিপোর্টে বলেছে, ২০২০-র লকডাউনের সময় থেকে ২০২২-এর মধে্য দেশে বিলিওনিয়ারের সংখ্যা ১০২ থেকে বেড়ে ১৬৬ হয়েছে। এই বিলিওনিয়ারদের আয় এই সময় রোজ ৩ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা করে বেড়েছে। তাহলে কর্পোরেট করে ছাড় দেওয়ার কি এটাই মূল উদ্দেশ্য ছিল? অথচ কেন্দ্রীয় সরকার অনায়াসেই কর্পোরেট করের হার কিছুটা বাড়িয়ে পেট্রোল ও ডিজেলের অতিরিক্ত ব্যয় সামাল দিতে পারত। তাতে এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কবলে দেশের কোটি কোটি গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষকে পড়তে হত না।
অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি যে দেশের গরিব জনতাকে আরও গরিব করছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। যদিও সরকার ‘ট্রিক্ল ডাউন’-এর তত্ত্বকেই অঁাকড়ে ধরে থাকছে। এখনও দেশবাসীকে শুধুমাত্র আর্থিক বৃদ্ধির নানা পরিসংখ্যানের গল্প শোনানো হচ্ছে। বার্ষিক আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬ না ৭ শতাংশ– সেটা বিচার করে কী হবে, যদি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সেই তিমিরেই থেকে যায়! দেশের বড়লোকদের আয় কয়েক গুণ বাড়লেও বাড়ছে না লগ্নি, কর্মসংস্থান ও গরিব মানুষের আয়। অক্সফ্যামের রিপোর্ট প্রতি বছর এই বাস্তব দেশবাসীর সামনে তুলে ধরছে। কিন্তু পরিস্থিতির কোনও বদল দেখা যাচ্ছে না। খুব বড়লোকদের করের বোঝা বাড়ানোর কোনও চেষ্টা এবারের বাজেটেও থাকবে না। জিএসটি এবং পেট্রোল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরকারের অায় বাড়ানোর চেষ্টাই বহাল থাকবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.