বিজেপি-র লক্ষ্য ২০২৪। আগামী দিনের ‘টার্গেট’ দাক্ষিণাত্য। ইতিমধ্যে কে. চন্দ্রশেখর রাও ও তাঁর পরিবার নিয়ে ‘পার্টি’ বনাম ‘পরিবার’ তরজা শুরু হয়ে গিয়েছে। এমন ছক কষা হয়েছিল মহারাষ্ট্রেও। আসলে, বিজেপি অন্যান্য রাজ্যেও একনাথ শিণ্ডের মতো অসন্তুষ্ট ও শক্তিশালী নেতা খুঁজছে, যিনি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন। লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই
২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন কি ইতিমধ্যে সাঙ্গ? একক পার্টির নির্বাচনী গণতান্ত্রিক তরজা ক্রমশ গুরুতর এই প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর হিসাবে বুদ্বুদ তুলছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলি বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, ‘মোদি-ফায়েড’ বিজেপি কিন্তু নিজের লক্ষ্যে অবিচল। বিরোধী দলগুলি তুলনায় বিশৃঙ্খল।
মহারাষ্ট্রের জোট সরকারের পতন সম্ভবত বিজেপির ২০২৪ নির্বাচনের ঘুঁটি সাজানোর সবচেয়ে নাটকীয় দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয় বৃহত্তম লোকসভা আসনের রাজ্যটি হস্তগত করে আসলে বিজেপি সেই আপাত দুর্জ্ঞেয় ঘাঁটি কবজা করল, যে-ঘাঁটির উপর ভরসা করে বিরোধী পক্ষ ২০২৪ সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। শিব সেনার মধ্যে যে বিস্ফোরণ ঘটল, তা কেবল অন্তর্দলীয় ক্ষমতার কোন্দল নয়। বরং দিল্লিতে অবস্থিত শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বর এ এক বড়সড় কৌশল বা অভিসন্ধিও বটে, যা রাজ্যস্তরে খাটানোর জন্যই তৈরি করা। যে নির্মম পদ্ধতিতে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সম্পূর্ণ কাজে লাগিয়ে এগুলি পরিচালিত হয়েছে- তা সে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলির মাধ্যমে হোক (মূলত ইডি), বা গুজরাট ও অসমের স্থানীয় পুলিশ কিংবা মুম্বইয়ের রাজভবন- দেখে মনে হবে, বিরোধী শাসিত প্রত্যেকটি রাজ্য কেন্দ্রীয় নজরদারির আওতায় আছে। এমনকী, যেখানে বিজেপি ক্ষমতায় নেই, সেখানেও যেনতেন প্রকারে বিভিন্ন প্রভাব খাটিয়ে গদি ওল্টানোর প্রচেষ্টায় কোনও খামতি নেই। বিশেষ সূত্রে জানা গিয়েছে, এই অভিসন্ধির পরবর্তী টার্গেট: ঝাড়খণ্ড।
কাকতালীয়ভাবে, যে-সপ্তাহে উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন সরকার বেরিয়ে যাওয়ার পথে, সেই সময় বিজেপি হায়দরাবাদে একটি জাতীয় কার্যনির্বাহী বৈঠকের আয়োজন করেছিল। সামনের বছরের শুরুর দিকে তেলেঙ্গানায় বিধানসভা নির্বাচন। ফলে, বুঝতে অসুবিধা নেই, এই রাজ্য এখন বিজেপির আগামী টার্গেট। ইতিমধ্যে কে. চন্দ্রশেখর রাও ও তাঁর পরিবার নিয়ে ‘পার্টি’ বনাম ‘পরিবার’ তরজা শুরু হয়ে গিয়েছে। অনুরূপ ছক কষা হয়েছিল মহারাষ্ট্রের সরকার পতনের ক্ষেত্রেও- একজন মাটির কাছাকাছি নেতা বনাম প্রতিষ্ঠিত সুবিধাবাদী ঠাকরে বংশ। এখন বিজেপি অন্যান্য রাজ্যেও একনাথ শিণ্ডের মতো অসন্তুষ্ট ও শক্তিশালী নেতাকে খুঁজছে, যিনি, সেই রাজ্যে ক্ষমতাসীন পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন। তা, তেলেঙ্গানায় হোক বা অন্য কোথাও।
দক্ষিণ ভারত যে বিজেপির ভবিষ্যতের ‘পাখির চোখ’, তা-ও ভাল করে বোঝা যাবে এমত তথ্য থেকে যে, রাজ্যসভায় চারজন রাষ্ট্রপতি মনোনীত প্রার্থী-ই দক্ষিণ ভারতের মানুষ। একে ‘রাজনৈতিক প্রতীকীবাদ’ ছাড়া আর কী বলা যায়! ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি ৩০৩টি আসনের মধ্যে মাত্র ২৯টি আসন দাক্ষিণাত্যের পাঁচটি রাজ্য থেকে আদায় করে নিতে পেরেছিল। তার মধ্যে কেবল কর্নাটক থেকেই এসেছিল ২৫টি আসন। এই দখিনা ধাক্কা থেকে বোঝা যায়, বিজেপি তার গেরুয়া ঝড় সেই-সেই জায়গায় পৌঁছে যেতে চাইছে, যেখানে দলটি এখনও পর্যন্ত জেতেনি- এমনকী, যদি রাতারাতি সুফল না-মেলে, তাহলেও বা কী, চেষ্টা তো তাদের জারি আছে। হিন্দু-গরিষ্ঠ ভূখণ্ডে সম্পৃক্তি চলে এসেছে, এখন লক্ষ্য: দাক্ষিণাত্য।
এই বিস্তার কেবল ভৌগোলিক নয়। সামাজিক স্তরেও বিজেপি তার ভিত শক্ত করতে তৎপর। রাষ্ট্রপতি হিসাবে ওড়িশার আদিবাসী মহিলা দ্রৌপদী মুর্মুকে মনোনীত করা সেই তৎপরতার উদাহরণ, একটি সচেতন কৌশল। ২০১৯ সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি আদিবাসী সংরক্ষিত আসনের ৪০ শতাংশ আসনে জয়লাভ করে রীতিমতো আধিপত্য কায়েম করেছিল। এই জয়ের অঙ্ক পূর্ববর্তী নির্বাচনের তুলনায় ৬ শতাংশেরও বেশি। সত্যি বলতে, ওবিসি-এসসি-এসটিদের মধ্যে জোট তৈরি করে ভারতের শহুরে অঞ্চলের তুলনায় বিজেপি প্রান্তীয় অঞ্চল থেকেই বেশি ভোট তুলে এনেছিল। এই প্রকল্প- বিজেপির তথাকথিত গড়পড়তা সমর্থক তথা উচ্চজাতের ব্রাহ্মণ-বেনিয়া গোষ্ঠীর চেয়েও বেশি ভোট এনে দিয়েছিল দলকে।
মজার বিষয়, সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে বিজেপি উত্তরপ্রদেশের রামপুর এবং আজমগড় লোকসভা আসনে জিতেছে। দু’টি জায়গাতেই মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, ফলে ঐতিহ্যগতভাবে সেখানে বিরোধীরা জেতে। বিজেপি মুসলিম ভোটের একটি বড় অংশ পেয়ে জিতেছে, এ-কথা হয়তো অতিরঞ্জন। কিন্তু এই জয়গুলো রাজনৈতিকভাবে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিজেপির সম্পূর্ণ আধিপত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে। অখিলেশ যাদব যে তাঁর সমাজবাদী দলের প্রার্থীদের প্রচারের জন্য ময়দানে নামলেন না, তা এমন একটি অনুপস্থিত নেতৃত্বকে প্রকাশ করে, যা নির্বাচনের ময়দানে বিজেপির বিপুল উপস্থিতির সম্পূর্ণ বিপরীত।
২০২৪ বিজেপির কাছে যেখানে ‘পাখির চোখ’, এর বিপরীতে বিরোধীরা একজোট হতেই পারছে না- এহেন বৈপরীত্যটি ধাক্কা মারে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারাভিযানের মধ্য দিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তৈরির সুযোগ ছিল, কিন্তু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে তা বিপর্যস্ত, ব্যর্থ। বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা প্রাথমিক বৈঠকে কয়েকটি মূল দল অংশগ্রহণ করেনি, দূরে থাকাটাই বেছে নিয়েছিল, আম আদমি পার্টিও তার মধ্যে ছিল। এই বৈঠক ডাকা হয়েছিল কোনও একটি নাম নিয়ে ঐকমত্য গড়ে তুলতে, যে-নাম বিজেপি মনোনীত প্রার্থীকে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ দিতে পারে। অশীতিপর যশবন্ত সিন্হা ছিলেন চতুর্থ পছন্দ। এখন, দ্রৌপদী মুর্মুর মনোনয়ন সেসব ফাটল প্রশস্ত করেছে: ‘ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা’ যেমন রাষ্ট্রপতি পদে আদিবাসী মহিলা প্রার্থীকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তেমনই শিবসেনা-ও (উদ্ধব গোষ্ঠী) দ্রৌপদী মুর্মুকে সমর্থন করতে আগ্রহী।
প্রধান বিরোধী দল হিসাবে কংগ্রেসের দুর্দশা সবচেয়ে প্রকট। ২০১৯-এর পর থেকে কংগ্রেসের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ স্থান থেকে যেভাবে দলত্যাগ শুরু হয়েছে, তার এখনও কোনও শেষ দেখা যাচ্ছে না। প্রতি সপ্তাহে, দিল্লির রাজনৈতিক বাজারে গুজব রটছে- পরবর্তী কোন নেতা এই বিপর্যস্ত দল ছাড়বেন। মে মাসে চিন্তন শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল দলের মনোবল বাড়ানোর জন্য। কিন্তু দলের যোগাযোগ সংস্থাপক টিমকে পুনঃসক্রিয় করতে না পারলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া কি সম্ভব? কেননা, এই দলের নেতৃত্ব এতটাই জটিল, এতটাই অস্পষ্ট যে, মনে হবে দলটি নাবিকবিহীন জাহাজ হয়ে উত্তাল সমুদ্রে ভাসছে। একসময়ের কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি মহারাষ্ট্রেই তাদের লড়াইয়ের মনোভাবের অভাব দৃশ্যমান। দলীয় নেতারা সেখানে সম্প্রতি সবার আগে জোট সরকার থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
তাহলে, ২০২৪ সালে ফের ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদি কি হ্যাটট্রিক করবেন? ভারতীয় রাজনীতিতে ২০ মাস অনেকটা সময়। কোন ঘটনা রাজনীতির ভাগ্যাকাশে বদল ঘটাবে, আগে থেকে বোঝা কঠিন। তবে বিজেপির হাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, রয়েছে মিডিয়া এবং প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি- এসবই ‘স্বাধীন ও ন্যায্য’ নির্বাচনের ধারণাকে উপহাসে পরিণত করেছে। ভেঙেচুরে যাওয়া, ছত্রখান হওয়া বিরোধীরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা ‘দখল’ বা ‘পুনরুদ্ধার’ করতে চাইছে বটে, কিন্তু কার্যকর পালটা-আখ্যান বা নেতৃত্বের মডেল তৈরি করতে পারেনি। ফলে এই ব্যর্থতা, বিজেপির নিরঙ্কুশ ক্ষমতার পথকে, আরও সহজ করে তুলছে। ‘একদলীয় আধিপত্য’ বা ‘ওয়ান পার্টি ডমিনেন্স’ (OPD) ব্যবস্থা আপাতত একটি অনিবার্য বাস্তব বলে মনে হতে পারে। যদিও গণতন্ত্রে এর প্রভাব ভীষণ প্রতিক্রিয়াশীল। এর সুবাদে ‘এক জাতি, এক নেতা এবং এক ছবি’-র প্রবণতা গণতন্ত্রে প্রবেশ করতে পারে বিপজ্জনকভাবে।
পুনশ্চ বিজেপির সাম্প্রতিক ‘অপারেশন লোটাস’ এখন গোয়ার বালুতট কাঁপাচ্ছে। ছোট এক রাজ্য, যেখানে বিজেপি মাত্র কয়েক মাস আগে নির্বাচন জিতেছে, সেটাকেও তারা ‘বিরোধী-মুক্ত’ রাজ্য বানাতে বদ্ধপরিকর। এদিকে কংগ্রেসের অভিযোগ, তাদের বিধায়কদের দল বদলানোর জন্য প্রত্যেককে ৪০ কোটি টাকা অবধি ‘অফার’ করা হয়েছিল। নির্বাচনের আগে তাঁদের মন্দির, মসজিদ এবং গির্জায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যেখানে তাঁরা কোনও ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত না করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন। মনে হচ্ছে না- বিজেপির প্রস্ফুটিত পদ্মের সামনে, এখন এমনকী, ভগবানও নিষ্ক্রিয় আর নিষ্প্রভ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.