ফাইল ছবি।
প্রধানমন্ত্রী হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণ করেই চলেছেন। আদানি-আম্বানিদের নাম করে আত্মলজ্জা বাড়াচ্ছেন। বিরোধীরা মনে করছে, জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। বিজেপি মুখ থুবড়ে পড়বে। আমি সংশয়ী। বিজেপির সাড়ে তিনশো সিটের ঝুলি ঝুপ করে আড়াইশোর নিচে নামবে? তবে, আসন কমবে বড় মাত্রায় নিশ্চিত। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
হঠাৎই চেনা দৃশ্যপট বদলে বদলে যাচ্ছে। ভোটের চালচিত্র উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। যে-নির্বাচনকে মনে করা হচ্ছিল নিতান্ত একপেশে, ম্যাড়মেড়ে, কোনও এক জাদুকাঠির স্পর্শে তাতে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। উত্তেজনার খই ফুটছে। দিকে দিকে হিসাব কষা হচ্ছে, চারশো পার থেকে স্খলন কতটা, তিনশো, আড়াইশো, দুশো নাকি দেড়শো! সম্ভাব্য পদস্খলনের শঙ্কার জন্মদাতা ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতির মালিক স্বয়ং। হঠাৎ তিনি বেশি-বেশি হিন্দু-মুসলমান শুরু করলেন। পাকিস্তানের ভয় দেখাতে লাগলেন। ভরা জনসভায় আদানি-আম্বানিকে টেনে আনলেন। পরম বন্ধুদের পথে বসানোর নেপথ্য কারণ কী, এখনও সেই গবেষণা অব্যাহত। সুহৃদদের সঙ্গে নিজেকেও কেন বেইজ্জত করলেন, গাড্ডায় ফেললেন, বিরোধীদের হাতে তুলে দিলেন শক্তিশেল, রাজনীতির জ্ঞানীদের পাশাপাশি সত্যান্বেষীদেরও তা বিহ্বল করেছে। কেউ জানে না প্রধানমন্ত্রীর মতিভ্রমের নেপথ্য কারণ।
বিচ্যুতি? অবশ্যই। কারণ, দ্বিতীয়বার আদানি-আম্বানি কিংবা কালো টাকার উচ্চারণ তিনি আর করেননি। তঁার সব কথা লুফে নিয়ে যারা চতুর্গুণ বিক্রম দেখায়, কী আশ্চর্য, তারাও বেবাক! একটি শব্দও আর উচ্চারিত হল না! ফলে বোঝা গেল, ওই কথা বলা মোটেই যে ঠিক হয়নি প্রধানমন্ত্রী তা বুঝেছেন। তাই একের পর এক কিল হজম করে চলেছেন। জনপ্রিয় বিশ্বাস, কোনও কারণে উনি বিচলিত বোধ করছিলেন। ক্ষমতা হারানোর শঙ্কায় ভীত হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎই বিনাশের ইঙ্গিত পাচ্ছিলেন। তাই বুদ্ধিনাশ। বৈশাখস্য প্রথম দিবসেও কিন্তু বিনাশ অথবা বিপরীত বুদ্ধির কোনও অঁাচ ছিল না। সেদিন প্রবল ঢক্কানিনাদ সহযোগে উন্মোচিত হয়েছিল ‘মোদি কি গ্যারান্টি’। দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের ফাইভ স্টার পার্টি অফিসে সে কী উন্মাদনা! দেশবাসীর দুঃখমোচনের আখ্যান উপস্থাপিত গ্যারান্টির আধারে। দিনভর তা নিয়ে ‘গোদি মিডিয়া’ গমগম করল।
ন’-দিন আগে কংগ্রেস প্রকাশ করেছে তাদের ইস্তাহার। সেখানে জ্বলজ্বল করছে কোটি কোটি লাখপতি তৈরির প্রতিশ্রুতি। শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত বেকারদের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার প্রকল্প। কৃষকদের জন্য এমএসপি-র আইনি স্বীকৃতি। সেসব উপেক্ষা ও ছত্রাখান করে বিরোধীদের কটাক্ষ অব্যাহত রেখে প্রধানমন্ত্রী দিয়ে চললেন ভাষণ। পরিচিত ঢঙে। একের পর এক জনসভায়। তখনও তঁার বিশ্বাস ‘আয়েগা তো মোদি হি’। এইভাবে কেটে গেল ১৯ এপ্রিল। সাঙ্গ প্রথম দফার ভোট। তার পরই শুরু বিচ্যুতি পর্ব।
ক্ষমতার অলিন্দের ফিসফিসানি, গোয়েন্দা রিপোর্টে ভোটদানে অনীহা, বিজেপি নিয়ে একঘেয়েমি এবং দৈনন্দিন সমস্যার সুরাহা না-হওয়া ভোটের হার কমার কারণ চিহ্নিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী চিন্তিত হয়েছিলেন। তিনি বুঝে যান, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার মতো মারকাটারি কোনও ইস্যু এবার তৈরি হয়নি। ফলে হাওয়া ওঠেনি। ‘হাওয়া’ তুলতে প্রধানমন্ত্রী তাই পা ফেললেন উগ্র-হিন্দুত্ববাদের চেনা আঙিনায়। পরপর দু’টি জনসভায় টেনে আনলেন কংগ্রেসের অভিপ্রায়, যার স্পষ্ট ইঙ্গিত নাকি রয়েছে তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে। দেশ শুনল এক কাল্পনিক কাহিনি। মানুষের সম্পদ কেড়ে কঁাড়ি কঁাড়ি বাচ্চা পয়দা করনেওয়ালি ও ঘুসপেটিয়াদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার গল্প। পরদিন সেই কাহিনি আরও পল্লবিত হল। শোনা গেল, মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেওয়ার ভয়ংকর ছকবাজির কথা। কারও দুটো মোষ থাকলে একটা দখল নেওয়ার পরিকল্পনা। এক্স-রে মেশিন নিয়ে ঘরে ঘরে ঢুঁ মারার গল্প, যে-মেশিন মানুষের সোনাদানা ও জমিজমার হদিশ দেবে। মুসলমান জুজুর সেই ভয় দেখানোর মধ্যেই নতুন টুইস্ট। হাজির হলেন আদানি-আম্বানি, টেম্পো বোঝাই কালো টাকা নিয়ে। কত কালো টাকায় কী সওদা হয়েছে সেই হিসাব তিনি চেয়ে বসলেন কংগ্রেসের শাহজাদার কাছে। ভরা জনসভায়।
বাইরের বলে এমন খোঁচা নরেন্দ্র মোদি গত দশ বছরে একবারও দেননি। কংগ্রেস ক্যাচটা ধরে ফেলেছে। ময়দান ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তঁার হয়েছে কি না, আপাতত চলছে সেই নিয়ে গবেষণা। সেদিনই বোঝা গেল মোদি বিভ্রান্ত, বিচলিত ও চিন্তিত। এমন অসংলগ্ন আচরণ করার মানুষ তিনি নন। বোকামিও। কারণ, ওই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি স্বীকার করে নিলেন নোটবন্দি কাজে দেয়নি। কালো টাকা যেমন ছিল তেমনই আছে। এজেন্সিগুলোও সরকারের দেখিয়ে দেওয়া রাস্তায় হঁাটে। এ-কথাও তিনি বুঝিয়ে দিলেন, আদানি-আম্বানিরা কালো টাকার কারবারি। তঁারা কংগ্রেসকে টাকা জোগাচ্ছে অথচ ইডি-সিবিআই তঁাদের সংসারে হানা দিচ্ছে না। অতএব প্রমাণিত, আর্থিক দুর্নীতির টার্গেট শুধুমাত্র বিরোধীরাই।
এই অসংলগ্নতা মোদিকে বেআবুরু করে দিয়েছে। একেবারে খোলাখুলি তিনি চিহ্নিত হচ্ছেন ‘মার্কামারা মিথ্যেবাদী’ হিসাবে। বিরোধী নেতারা বারবার তা বলছেন। গণমাধ্যমে লেখালিখি হচ্ছে। ঠাট্টা-ইয়ার্কিও। আদানি-আম্বানি মন্তব্যের পরদিন প্রধানমন্ত্রী কোনও জনসভা করেননি। সামাজিক মাধ্যম জানাল, ‘দেশবাসীকে আজ একটাও মিথ্যে কথা শুনতে হয়নি। কারণ, মোদি ভাষণ দেননি!’ প্রধানমন্ত্রিত্বের পদমর্যাদা এভাবে নষ্ট আগে কেউ করেনি। অকুতোভয় এক বালক রাজাকে ‘উলঙ্গ’ বলেছিল। গোটা বিরোধীকুল এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ‘মিথ্যেবাদী’ বলছে! অসম্মান ও লজ্জার একশেষ!
প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদের মধ্যে এই তীব্র শত্রুতা, তিক্ততা, পারস্পরিক ঘৃণার এমন প্রবল বিকিরণ আগে দেখা যায়নি। দেশের কোনও প্রধানমন্ত্রীর জীবনের বিভিন্ন পর্যায় ঘিরে এত বিতর্কও কখনও হয়নি আগে। জাগেনি এত অবিশ্বাস। গুজরাতের ভাটনগর স্টেশনে আদৌ তিনি চা বিক্রি করেছেন কি না, কেউ জানে না। কোনও প্রমাণ নেই। ভারতীয় রেলের কাছে কোনও রেকর্ডও নেই। তঁার শিক্ষাগত যোগ্যতাও প্রশ্নাতীত নয়। ডিগ্রির দাবি এখনও অস্বচ্ছতার পর্দায় ঢাকা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে সত্যাগ্রহ করে জীবনের প্রথম জেল খাটার কোনও প্রমাণ মেলেনি। মিথ্যাচারিতার এমন বিপুল রেকর্ডের অধিকারী কংগ্রেসের ইস্তাহার নিয়েও যে তিনি অবলীলায় অনর্গল অসত্য বলবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
বিস্ময় জাগবে এরপরও হ্যাটট্রিক হলে! অনেকে এখনই উৎফুল্ল। বিজেপির সম্ভাব্য পরাজয়ের ঢাক তারা পেটাতে শুরু করে দিয়েছে।
আমি কিন্তু সংশয়ী। জমিনি সত্য, বিরোধী দাবি, ভোটার আচরণ ও ইভিএম চরিত্র অভিন্ন হলে কর্নাটক, মহারাষ্ট্র ও বিহারে চতুর্থ দফার ভোটের পর শাসক জোটের অন্তত ৬০টি আসন কমার কথা। কিছুটা হলেও বিজেপির আসন বাড়বে অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা ও তেলেঙ্গানায়। একটি-দু’টি বাড়তে পারে তামিলনাড়ু ও কেরলেও। পশ্চিমবঙ্গ সাসপেন্স ধরে রেখেছে। দু’-চারটি করে আসন রাজস্থান, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, দিল্লি, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ডে কমতে পারে। তাতে এনডিএ-র ঝুলির ৩৫৩ ঝুপ করে আড়াইশোর নিচে নামবে কি? যদি নামেও, নবীনবাবু, চন্দ্রবাবু, জগন্মোহনেরা কি মুখ ঘোরাবেন? অতীত সাক্ষী, পাউরুটির কোন দিকে মাখন লাগানো তা বুঝতে তঁারা ভুল করেননি। ইডি, সিবিআই, আয়কর, এনআইএর খঁাড়া এখনও যে একবগ্গা। বিজেপির নার্ভাস শীর্ষ নেতারা এখন দমকলের ভূমিকায় নেমেছেন। যদিও বেছে বেছে। কীরকম?
অরবিন্দ কেজরিওয়াল দুটো বোমা ছেড়েছেন। প্রথমটির সারাৎসার, ৭৫ পেরলেই মোদির উত্তরাধিকারী হবেন অমিত শাহ। মোদির নিজের তৈরি নিয়ম তেমনই। শোনা মাত্র রে-রে করে উঠেছেন অমিত শাহ। জানিয়েছেন, ২০২৯ পর্যন্ত মোদিই চালক। কেজরিওয়ালের দ্বিতীয় বাক্যটি আরও মারাত্মক। জিতলে মোদি নাকি শেষ করে দেবেন যোগী আদিত্যনাথকে। দু’-মাসের মধ্যেই। আশ্চর্য, যোগীর সমর্থনে কিন্তু কেউ দঁাড়ালেন না! তবে কি যোগী-প্রদেশ বেসুরো গাইছে? প্রশ্নটা আলোড়িত হচ্ছে। শেয়ার বাজার নিত্য পড়ছে। মোদি সরকারের সম্ভাব্য বিদায়ের শঙ্কায়। এই প্রচার নস্যাৎ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন
অমিত শাহ, নির্মলা সীতারমন, জয়শঙ্করেরা।
লক্ষণ ভাল নয়। দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। ভোট চালচিত্রও উজ্জ্বল হয়েছে। নির্বাচন কমিশন যদিও অবিচল। ইভিএম বিজেপির মুশকিল আসান হয়ে উঠবে কি না, সেই সন্দেহ দিন-দিন প্রবল হচ্ছে। বিশ্বাসের এই ঘাটতির জন্য কমিশনই কিন্তু দায়ী। গণতন্ত্রের কাঠগড়ায় তারা-ই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.