গোটা দেশে একই আইন থাকবে৷ সব জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মানতে হবে৷ তবে তার জন্য দেশের জনগণের কাছে মতামত চাইছে বিজেপিশাসিত কেন্দ্রীয় সরকার৷ তাতেই রে রে করে উঠেছে সর্বভারতীয় মুসলিম পারসোনাল ল’ বোর্ড৷ বিরোধিতা করছে কংগ্রেসও৷ এমন অবস্থায় কী করবেন মোদি? লিখছেন শুভময় মণ্ডল
দেশের ভিতরেই গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার তাল করেছেন নরেন্দ্র মোদি!
এমন কথা শুনলেই মোদিভক্তরা রে রে করে উঠবেন বৈকি৷ কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে দেখতে গেলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপে এখন দেশের ভিতরেই অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসছে৷ আগে জানা দরকার, এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি খায় না মাথায় দেয়! দেশের সব ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে একই আইনের ছাতার তলায় আনার পদ্ধতিই হল অভিন্ন দেওয়ানি বিধি৷ গোটা দেশেই ধর্মভেদে আলাদা আলাদা আইন চালু রয়েছে৷ হিন্দুদের জন্য আলাদা দেওয়ানি বিধি৷ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা৷ খ্রিস্টানদের জন্য আলাদা৷ এইভাবে দেখতে গেলে সব ধর্মাবলম্বীদের জন্য পৃথক আইন চালু রয়েছে ভারতে৷
হিন্দু বা খ্রিস্টানদের বিষয়ে জানা নেই, তবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড প্রথা চালু করার আগে খেপে গিয়েছে দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ৷ খেপারই কথা, কারণ কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিজেপির হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়েছে৷ তা সে অযোধ্যায় ফের রামমন্দির নির্মাণ ইস্যু মাথাচাড়া দেওয়াই হোক কিংবা গোহত্যা নিষিদ্ধই হোক৷ সবেতেই নরেন্দ্র মোদির উপর চটে রয়েছে মুসসিম সম্প্রদায়ের মানুষ৷ প্রকাশ্যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় সর্বত্রই মোদির মুণ্ডপাত করতে উঠেপড়ে লেগেছে তাঁরা৷ এবার মোদি হঠাও এজেন্ডায় ঘৃতাহুতি করল অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর সিদ্ধান্ত৷ অল ইন্ডিয়া মুসলিম পারসোনাল ল’ বোর্ড সবার আগেই সরকারের তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়েছে৷ তিন তালাক, বহুগামিতার মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে হাত দিলে কেন্দ্রেরই হাত পুড়বে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে দিয়েছে সর্বভারতীয় মুসলিম পারসোনাল ল’বোর্ডের নেতা-মাতব্বররা৷ কারণ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে সবার আগে বিলুপ্ত হবে শরিয়ত আইনে উল্লেখিত তিন তালাক ও বহুগামিতা৷ শরিয়ত আইন মেনেই নীতি-নির্ধারণ করে মুসলিম পারসোনাল ল’ বোর্ড৷ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে গুরুত্ব হারাবে এই বোর্ড৷ আর তাতেই লম্ফঝম্ফ শুরু হয়েছে নেতা-মাতব্বরদের৷
কিন্তু সরাসরি সংঘাতের পথে যায়নি সরকার৷ তিন তালাক, বহুগামিতা বিষয়গুলি নিয়ে জনমত সংগ্রহ করতে চাইছে কেন্দ্র৷ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নাইডু বলেও দিয়েছেন, সরকার জোর করে কোনও কিছু জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দেবে না৷ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু নিয়ে জনগণের মতামত চেয়েছেন৷ আর তাতেই সেরা চাল খেলেছেন মোদি৷ জনগণ, বিশেষ করে মুসলিম মহিলারা তিন তালাক, স্বামীদের বহুগামিতা থেকে মুক্তি পেতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিতে আপত্তি জানাবেন না তা মোদি বিলক্ষণ জানেন৷ মোদির হাতে আরও তাস রয়েছে৷ কারণ দেশের মধ্যে গোয়াই একরাত্র রাজ্য যেখানে আগে থেকেই ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু রয়েছে৷ আর গোয়া যে বর্তমানে বিজেপিশাসিত রাজ্য তা সবাই জানে৷ ল’ বোর্ডের অভিন্ন দেওয়ানি বিধিতে আপত্তি থাকলে গোয়ার উদাহরণ দিতে পারেন মোদি৷ সেখানকার ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সমস্যা তো হচ্ছে না, তাহলে শরিয়ত আইনকে কেন আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে ল’ বোর্ড?
অভিন্ন দেওয়ানি বিধিতে আপত্তি রয়েছে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের৷ কংগ্রেসের বক্তব্য, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়ন করে আরেকটা ক্রুসেড বাধাতে চাইছেন মোদি অ্যান্ড কোং৷ ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দিয়ে দলের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন মোদি৷ কিন্তু বরাবরের মতো এবারেও চালে ভুল করেছে শতাব্দীপ্রাচীন দল কংগ্রেস৷ এই কথা বলার আগে ইতিহাসটা একবার ঘেঁটে দেখা উচিত ছিল রাহুল গান্ধীদের৷ কারণ, স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুই প্রথম অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন৷ কিন্তু ব্রিটিশ উত্তর ভারতে বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে চটিয়ে এই বিধি চালু করার পক্ষে সায় মেলেনি সংসদে৷ তাই তা সিন্দুকেই তোলা ছিল৷ মোদি শুধু ধুলো পড়া দস্তাবেজ ফের খুলতে চেয়েছেন৷ নিজেদের ইতিহাস ভুলে যাওয়া কংগ্রেসের বরাবরেরই রোগ৷ ঠিক তেমনই ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির অভিযোগ তোলা কংগ্রেস এটাও ভুলে গেল, বিজেপি মুসলিম ভোট কম পায়নি লোকসভা ভোটে৷ যদি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হয় তাহলে সব ধর্মের মানুষই কেন্দ্রের উপর চটবে৷ তিন তালাক ও বহুগামিতাকে হুকুমত-এ-পাকিস্তানও সায় দেয় না৷ তাহলে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে কেন নিষিদ্ধ হবে না এগুলি? যাঁরা অসহিষ্ণুতা ইস্যুতে এতদিন চিল চিৎকার জুড়েছিলেন, সেই বিদ্বজ্জনদেরও দেখা যাচ্ছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে নীরব থাকতে৷ কেন মুক্তমনারাই বা নীরব যেখানে মুসলিম মহিলাদের তিন তালাকের শাপমোচন করতে চাইছে কেন্দ্র?
সার্জিক্যাল স্ট্রাইক থেকে শুরু করে সব পদক্ষেপেই মোদি সরকারকে নিশানায় দাঁড় করিয়েছে বিরোধীরা৷ এবার কেন্দ্রর সঙ্গে ল’ বোর্ডের সংঘাতে জড়াতে চাইছে না কেউ৷ কংগ্রেস সরাসরি বিরোধিতা করলেও ধরি মাছ না ছুঁই পানি মত বামপন্থীদের৷ মুখোশধারী মুক্তমনাদের নিয়ে আর কিছু বলার নেই৷ তাঁরা হোমেও লাগে না যজ্ঞেও না৷ তবে এখন বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? অভিন্ন দেওয়ানি বিধি দেশে আদৌ চালু করতে পারবেন কি না মোদি তা তো সময়ই বলবে৷ কিন্তু এমন অসাধ্যসাধন করতে পারলে তাঁর ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতি ফুলে দ্বিগুণ হতে বেশি দেরি হবে না!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.