করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় ৩ সন্তানকে এক রাতে হারালেন মা। যুদ্ধেও মাঝে মাঝে এমনটা হয়। তার প্রমাণ স্টিভেন স্পিলবার্গের সিনেমা।
মৃতদের পরিবারের জন্য রাষ্ট্রের তরফে যে-শোকবার্তা পাঠানো হয়, সেটি টাইপ করতে গিয়ে টাইপিস্ট মহিলার চোখে পড়ে গেল ছোট্ট একটি সংগতি, বা অন্যভাবে দেখলে, নিয়তির চরম পরিহাস, যা আখেরে বিরাট অসংগতিই। তিনি দেখলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর হয়ে যুদ্ধে গিয়ে একই পরিবারের তিনজন রায়ান ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। এই পরিবারের আরও একটি ছেলে এখন যুদ্ধে।
এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের ‘সোল সারভাইভার’ নীতি প্রযুক্ত হওয়ার কথা। কোনও পরিবারের সিংহভাগ সদস্যের যুদ্ধে মৃত্যু ঘটলে, অবশিষ্ট মানুষটি যদি রণক্ষেত্রে থাকে, তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে অবিলম্বে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ছোট যে-ছেলেটি নাৎসি অধ্যুষিত ফরাসি ভূমিতে রণ-রক্তের সংঘর্ষে লিপ্ত, সেই জেমস ফ্রান্সিস রায়ানকে খুঁজে বের করতে হবে, আর বাড়ি পাঠাতে হবে। এই নির্দেশ বর্তায় অভিজ্ঞ আর্মি ক্যাপ্টেন জন এইচ. মিলারের কাঁধে। ছোট্ট একটি দল নিয়ে তিনি বেরন- রায়ানকে খুঁজতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে এই ঘটনাক্রমের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে স্টিভেন স্পিলবার্গের কালজয়ী সিনেমা ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ (১৯৯৮)। ‘প্রাইভেট’ শব্দটির অর্থ এখানে ‘ব্যক্তিগত’ নয়। তা জুনিয়র আর্মি অফিসারের ‘র্যাঙ্ক অ্যান্ড পোস্ট’ বাচক। কিন্তু যুদ্ধের তীব্র ঘনঘটায়, সমষ্টিগত-নিধন এবং সভ্যতার সার্বিক সংকটের আড়ালে, এই ‘প্রাইভেট’ শব্দটি অলক্ষ্যে যেন ব্যক্তি-মানুষের অপ্রতিহত অস্তিত্বের সূচক হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বযুদ্ধে নিরীহ প্রাণের বির্সজন চলছে বেঘোরে। অস্ত্র হাতে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় কেউ ভাবছে না অন্যের দোষ কী। শুধু ভাবছে, অন্যকে না মারলে, সে নিজে মরে যাবে। এমন বীভৎস রসের ভিয়েন যেখানে টগবগাচ্ছে, সেখানে তিন সন্তানকে হারানো কোনও এক মায়ের কথা ভেবেই মার্কিন সেনার একটি দল হন্যে হয়ে সন্ধান করছে জেমস ফ্রান্সিস রায়ানের। এটুকুই বা কম ‘প্রাইভেট’ পরিসর না কি?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত স্পিলবার্গের আগ্রহের অন্যতম প্রিয় বিষয়। ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’-এর বীজধানও তিনি সংগ্রহ করেছিলেন বাস্তবের মাটি থেকে। সার্জেন্ট ফ্রেডেরিক ফ্রিটজ নিলান্ডের তিন ভাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। দুই ভাই রবার্ট ও প্রিস্টন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। অন্য এক ভাই এডওয়ার্ড ‘মিসিং’ হয়েছে খবর আসে। ধরে নেওয়া হয়, সে-ও মৃত। এরপর নরম্যান্ডি ইনভেশনের সময় ফ্রেডেরিক নিলান্ড ‘নিখোঁজ’ হতেই চূড়ান্ত তৎপর হয়ে ওঠে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর। এ-ও সেই ‘সোল সারভাইভার’ নীতির প্রতিফলন। তাঁকে পাওয়া গিয়েছিল। অধিকন্তু পরে জানা যায়, এডওয়ার্ড মারা যায়নি। সে-ও ফিরে আসে ঘরে। সম্প্রতি করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় বাসন্তীর একটি গ্রামের তিন ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। এক রাতে তিন সন্তান হারিয়ে কোলশূন্য মা। এই অনুষঙ্গে ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ মনে পড়ে- বাধ্যত। নিয়তি যেখানে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ সেখানে মানুষের হাত-পা ছোড়া যেন অর্থহীন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.