ফাইল ছবি
২০০৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগর ও আরবসাগরে ৬৪টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রবল এবং অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়-ই সংখ্যাগুরু। যেভাবে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে প্রবল, অতি প্রবল, সুপার সাইক্লোনের সংখ্যা আরও বাড়বে। ফলে, বাড়বে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যাও। লিখলেন দেবদূত ঘোষঠাকুর।
১৯৯৫ সালের নভেম্বর মাসের দুপুর। আবহাওয়া দফতরের পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে দেখছি: আকাশ কালো হয়ে আছে। থমথমে পরিবেশ। সকাল থেকেই বসেছিলাম আলিপুর আবহাওয়া দফতরের আবহাওয়ার হাল-হকিকত সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্য। বঙ্গোপসাগরে একটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হচ্ছে। সেটা আঘাত করতে পারে পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে।
সরকারি কর্মীদের ছুটি বাতিল হয়েছে। আমরাও ব্যাগ গুছিয়ে চলে এসেছি অফিসে। রাতে থাকতে হতে পারে। দুর্গত এলাকায় যেতে হতে পারে। তখন ইন্টারনেটে আমরা অভ্যস্ত হইনি। আবহাওয়া দফতর অনেকক্ষণ পর-পর পূর্বাভাস দিত। যদি আগাম কোনও খবর পাওয়া যায়, তার জন্য আবহাওয়া দফতর তখন ঘঁাটি বানাতাম আমরা। মনে রাখতে হবে, তখন ল্যান্ডলাইনই ভরসা। ট্রাঙ্কল, টেলিগ্রামের প্রয়োজনীয়তা তখনও অটুট। ওই দিন রাত পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, আমাদের সাগরদ্বীপের উপরে আছড়ে পড়বে ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়। তখন উপগ্রহ চিত্র, ওয়েদার অ্যাপ জাতীয় কিছুই ছিল না, ফলে ঘূর্ণিঝড়ের (Super Cyclone) সম্ভাব্য গতিপথ আমরা দেখে নিতে পারতাম না। সেদিন রাতটা অফিসে থাকতে-থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানি না। সকালে উঠে রেডিও খুলে দেখি, ভোরের দিকে ওই ঝড় আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে।
শুধু ওই ঘূর্ণিঝড়টাই নয়, এর পরবর্তী সময়ে দেখেছি বঙ্গোপসাগরে যে-ক’টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়, তার সিংহভাগই অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা উপকূল ধরে ধরে উত্তর দিকে এগয়। পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের দিকে একবার চোখ রাঙিয়ে সে হয়তো ঘোঁট পাকাতে শুরু করে ওড়িশা উপকূলে, কিংবা পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে আঘাত করতে-করতে গতি বাড়িয়ে ঝড় গিয়ে আঘাত হানে বাংলাদেশে।
১৯৯১ সালের মহাঝড়, ১৯৯৫ সালের প্রবল ঘূর্ণিঝড়, ১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোন, ২০০৯ সালের ‘আয়লা’, ২০১৪ সালের ‘ফণী’, ২০২১ সালের ‘ইয়াস’ কিংবা গত রবিবারের ‘রেমাল’ থেকে অনেকটা রক্ষা পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। কখনও ওড়িশা, কখনও-বা বাংলাদেশ সেই ঝড়ের সামনে নিজেদের বুক পেতে দিয়েছে। এমনই অভিমত আবহবিজ্ঞানীদের অনেকের। ব্যতিক্রম, ২০২০ সালের ঘণ্টায় ২৩০ কিলোমিটার গতিবেগের ‘আমফান’ বা ‘উমপুন’, যা সরাসরি আঘাত করেছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার উপকূলবর্তী এলাকা। ১৯৯৫ সালের পরিস্থিতির সঙ্গে এবারের রেমালের মিল রয়েছে। কীভাবে?
প্রযুক্তির উন্নতিকে হাতিয়ার করে দিনচারেক আগেই বলে দেওয়া সম্ভব হয় যে, বঙ্গোপসাগরের উপর তৈরি হওয়া নিম্নচাপটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হবে। শুধু তা-ই নয়, ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য গতিপথও বলে দেওয়া হয়েছিল। ২৬ মে, রবিবার সকাল থেকেই কলকাতায় ছিল দুর্যোগের ঘনঘটা। বৃষ্টি, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমগুলি দুর্যোগের এমন বর্ণনা দিতে শুরু করল যে, সেদিন রাতেই বুঝি ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবন সংলগ্ন দক্ষিণ ২৪ পরগনা। ঝড়ের অভিমুখ যে ইতিমধ্যে পরিবর্তিত হয়েছে, তা তেমন খেয়াল করল না। সাগরদ্বীপ আর বাংলাদেশের পটুয়াখালি জেলার খেপুপাড়ার মধ্যের একটি এলাকা দিয়ে ঘূর্ণিঝড় রেমাল ঢুকবে, সেটাই তারা দেখাতে লাগল। মানুষ আতঙ্কিত। ঘরে-ঘরে শঁাখ বাজতে শুরু করল। ঘূর্ণিঝড়ের অ্যাপ খুলে দেখলাম, পশ্চিমবঙ্গীয় উপকূলের বিপদ অনেকটা কমের দিকে। কারণ, ঘূর্ণিঝড় তার অভিমুখ বদলেছে। পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকা ছেড়ে সে এবার বাংলাদেশের খুলনা ডিভিশনের মংলার কাছে স্থলভূমিতে আঘাত করবে। অভিজ্ঞ আবহবিদের সঙ্গে কথা বললাম, যিনি দীর্ঘকাল পূর্বাঞ্চলীয় আবহাওয়ার পূর্বাভাস কেন্দ্রের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে দিকে আসতে আসতে কীভাবে ওড়িশায় আটকে গিয়েছিল, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন তিনি। তঁার অভিমত ছিল, মায়ানমার উপকূলে বায়ুমণ্ডলে তৈরি হওয়া একটি উচ্চচাপ বলয়ই বিপরীত দিক থেকে চাপ দিয়ে ইয়াসকে আর উত্তর দিকে সরতে দেয়নি। ওড়িশা উপকূলের কাছেই ইয়াসকে ধরে রেখেছিল।
আর, রেমালের ক্ষেত্রে কী হয়েছিল? ওই আবহবিদের ব্যাখ্যা, এবার ওই ঘূর্ণিঝড় যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন কিন্তু মায়ানমার উপকূলের বায়ুমণ্ডলে একটি উচ্চচাপ বলয় তৈরি হচ্ছিল। তার ভিত্তিতেই মনে করা হচ্ছিল ঘূর্ণিঝড় রেমাল বেশি দূর যেতে পারবে না। তার ভিত্তিতেই তার গতিপথ নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু রবিবার একটি পশ্চিমি ঝঞ্ঝা রেমালকে ঠেলে পাঠিয়ে দেয় মংলার দিকে। বেঁচে যায় পশ্চিমবঙ্গ উপকূল। স্থলভূমিতে প্রবেশ করার আগে গতিবেগও কিছুটা কমে যায়। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় পরিণত হয় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে।
আবহবিদেরা ঘূর্ণিঝড়ের যে-প্রকারভেদ তৈরি করেছেন, তাতে কোনও অতি গভীর নিম্নচাপের কেন্দ্রে যখন বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত থাকে, তখন তাকে ‘ঘূর্ণিঝড়’ বলা হয়। বাতাসের গতিবেগ ৮৯ থেকে ১১৯ কিলোমিটার হলে তাকে বলা হয় ‘প্রবল ঘূর্ণিঝড়’। গতিবেগ ১২০ থেকে ২১৯ কিলোমিটার হলে তা ‘অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়’। ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটারের বেশি বাতাসের গতিবেগ হলে ‘সুপার সাইক্লোন’। ১৯৯৯ সালে ওড়িশায় আছড়ে পড়া ঝড়টি যেমন সুপার সাইক্লোন, তেমনই ২০০৮ সালে বাংলাদেশে আঘাত করা ‘সিডার’ কিংবা ২০২০ সালে পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আছড়ে পড়া আমফানও ছিল ‘সুপার সাইক্লোন’। সেদিক থেকে রেমাল প্রবল ঘূর্ণিঝড়। শেষ মুহূর্তে গতিপথ পরিবর্তনের জন্যই অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আর হয়ে উঠতে পারেনি সে।
২০০৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলির মধ্যে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের নিচে থাকা ঘূর্ণিঝড়গুলির মধ্যে ‘রেশমি’, ‘বিজলি’, ‘ভিয়ারু’, ‘কোমেন’, ‘রোয়ানু’, ‘ডিয়ামু’ উল্লেখযোগ্য। আবহাওয়া দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৪-’১৮ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে ৬৪টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রবল এবং অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়েরাই সংখ্যাগুরু। যেভাবে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে প্রবল, অতি প্রবল, সুপার সাইক্লোনের সংখ্যা আরও বাড়বে। ফলে, বাড়বে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যাও।
২০২৩ ছিল এখনও অবধি উষ্ণতম বছর। আমেরিকার কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী জেমস হ্যানসেন গত বছর সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, “২০২৪ সালে ‘এল নিনো’-র প্রভাব আরও বাড়বে। বাড়বে বায়ুমণ্ডল এবং সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা।” অর্থাৎ, ২০২৪ হতে পারে পূর্বতর রেকর্ড ভেঙে উষ্ণতম বছর। সমুদ্রের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা যত বাড়বে, ততই বেশি পরিমাণে জল বাষ্পীভূত হয়ে উপরে উঠে যাবে। সমুদ্রে তৈরি হবে নিম্নচাপ বলয়। বাষ্পীভবনের হার বাড়লে ঘূর্ণিঝড় তৈরির প্রবণতা বাড়বে। বাড়বে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তিও। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, মায়ানমারের উচ্চচাপ বলয় আর পশ্চিমি ঝঞ্ঝা তৈরি হওয়া বা না-হওয়াও নির্ভর করে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্যের উপর। আমরা কি এখনও হাত গুটিয়ে বসে থাকব?
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.