কিংশুক প্রামাণিক: এতদিন জানা ছিল, বীরভূমের জাঁদরেল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের মাঝে মাঝে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। তখন তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসে। হাঁসফাঁস অবস্থা কাটাতে অক্সিজেন দিতে হয়। ক্রমে ক্রমে কেষ্টবাবু চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। ফিরে আসেন নিজস্ব মেজাজে। তবে ‘দম’ নিতে তাঁকে দলবদল করতে হয় না। একুশের মহারণ যত এগিয়ে আসছে, কিছু তৃণমূল নেতার দম এমনভাবে বন্ধ হয়ে উঠছে যে, তাঁরা রাজনৈতিক প্রাণবায়ু সেবন করতে অভ্যাসের নীল-সাদা আকাশ ছেড়ে অন্য আকাশের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ছেন।
সবার স্ট্র্যাটেজি মোটামুটি একইরকম। কিছুকাল নিজের অবস্থান ‘বেসুরো’ রাখার পর ‘অন্তরাত্মা’-র ডাকে জোড়াফুল ছেড়ে বড়ফুলে ঝাঁপ। সেখানে গিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে তৃণমূল কত খারাপ- তার পক্ষে সওয়াল। ফলে সংঘাত। বলতে দ্বিধা নেই, পুরনো দলের নেতাদের সঙ্গে দলত্যাগী নেতাদের বাগযুদ্ধ এখন খেউড়ে পরিণত হয়েছে। ভোটের মুখে দলবদলে বড় চমক দিয়েছে বিজেপি। শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো হেভিওয়েট মন্ত্রীকে তারা তুলে নিয়েছে। সঙ্গী কিছু অতৃপ্ত বিধায়ক। আরও কেউ কেউ ‘বেসুরো’ বাজছেন। বোঝা যাচ্ছে, সময় এলে তাঁরাও খসবেন বিজেপির (BJP) বাগানে।
নয়-নয় করে গত তিন-চার বছরে তৃণমূলের কম নেতা তো গেলেন না বিজেপিতে! কলকাতা, বিধাননগর, হাওড়ার প্রাক্তন মেয়র হোক, মুকুল রায়, শোভন চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দুর মতো প্রথম সারির নেতৃত্ব- রাজ্য বিজেপির মুখ হয়ে উঠেছেন ঘাসফুলের নেতারাই। এখন বোঝা যাচ্ছে, সব স্তরের ভোটে জয়জয়কার হওয়ায় নেতার ভিড় একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল শাসক দলে। তবে কালের নিয়মে তারারা খসলেও তৃণমূলে (Trinamool Congress) ধ্রুবতারা জ্বলজ্বল করছেন। কর্মীদের আশ্বস্ত করে পোস্টারে মমতার বার্তা, ‘ম্যায় হুঁ না’। গ্রামে সমর্থকদের ফ্লেক্স, ‘যা হয় হোক বঙ্গে, অামরা দিদির সঙ্গে।’ মানে, ‘দাদা’-রা একে একে বেরিয়ে গেলেও ‘দিদি’ তো আছেন। সেজন্য দাদারা চলে গেলেও অনুগামীরা যাননি। ভোটের মুখে সেটা বাড়তি অক্সিজেন বইকি।
একঝাঁক ‘দমবন্ধ’ হওয়া নেতা-মন্ত্রীকে জয়েন করানোর পর দিলীপ ঘোষরা যখন বলছেন, দরজা এবার বন্ধ, তখনই অন্তরাত্মা জেগে উঠল বর্ষীয়ান সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদীর। তিনিও কার্যত দাবি করলেন, তৃণমূলে তাঁরও দমবন্ধ হয়ে উঠছিল। তাই ‘অক্সিজেন’ নিতে দল ছাড়লেন। যত দূর দীনেশবাবুকে চিনি, তিনি একজন সুভদ্র সুসভ্য মানুষ। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, গুজরাতি-সহ বহু ভাষা জানেন, বলতে পারেন। দিল্লির বুরোক্র্যাট থেকে কর্পোরেট লবি, সেলিব্রিটি মহল- সব স্তরে তাঁর অবাধ গতি। স্বভাবতই মমতাও (Mamata Banerjee) তাঁকে ততটাই গুরুত্ব দিতেন।
তবে দু’বার বারাকপুরের মতো আসনে জিতলেও দীনেশবাবু মোটেই ‘জননেতা’ নন। তাঁর মতো গ্ল্যামারের মানুষের জন্য রাজ্যসভার আসন যথার্থ। ঘটনাচক্রে তৃণমূলে দমবন্ধ হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত এক বছর রাজ্যসভার সদস্যই তিনি ছিলেন। লোকসভা ভোটে হারের দুঃখ ভুলিয়ে দিতে দলনেত্রী তাঁকে রাজ্যসভা থেকে সংসদে পাঠাতে চান। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে দীনেশকে টিকিট দেওয়ায় অর্জুন সিং দল ছাড়েন (Arjun Singh)। তৃণমূলের প্রার্থী-তালিকা ঘোষণার দিনও নেত্রীর পাশে ছিলেন অর্জুন। কিন্তু ক্ষোভে বিজেপির টোপ গিলে নেন। বারাকপুরে দীনেশকে হারান। সেই দীনেশবাবু চলে গেলেন অর্জুনের দলে। রাজনীতি এমনই নির্দয়!
এর আগে ২০১১ সালে মমতা যখন মুখ্যমন্ত্রী হন, তখন দেশের রেলমন্ত্রী অাসনে বসিয়েছিলেন এই দীনেশ ত্রিবেদীকে। অতএব বলার অপেক্ষা রাখে না, অ-বাঙালি নেতাকে অনেক দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী। তাঁর ক্ষোভ থাকার কথা নয়। তারপরও আচমকা কী করে ত্রিবেদী সাহেবের দম বন্ধ হল, তা নিয়ে বিস্তর চর্চা! দীনেশবাবু বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও। একটুও ভুল বলেননি। একথা মমতাও জানতেন। এই বন্ধুত্ব নিয়ে কারও কিছু বলার ছিল না। কেউ বাধাও দেননি।
দীনেশবাবুর দলবদলে দলের সেই অর্থে কোনও ক্ষতিও হবে না বলেই নেতৃত্ব মনে করছে। কিন্তু ভোটের মুখে কেন বন্ধুদের কাছে ফিরে গেলেন দীনেশবাবু, তা নিয়ে সমালোচনা চলবে। এটা স্বাভাবিক। যদিও একটা ভাল কাজ তিনি অবশ্যই করেছেন, ইচ্ছা করলেই সাংসদ পদে ইস্তফা না-ও দিতে পারতেন। পদ ছেড়ে তিনি নৈতিকতার পরিচয় দিয়েছেন। দীনেশবাবুর মতো তৃণমূল থেকে যাঁরা বিজেপিতে গিয়েছেন, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই বলছেন, মানুষের জন্য কাজ করতে চান, তাই বিজেপিতে। প্রশ্ন, তাহলে এতদিন তাঁরা কার জন্য কাজ করছিলেন? আর, মানুষের জন্য কাজ করতে শুধু বিজেপিতেই যেতে হবে কেন? সিপিএম, কংগ্রেস অথবা অন্য কোনও দল কি মানুষের জন্য কিছু করে না? বস্তুত, গত কয়েক বছর ধরেই তৃণমূল নেতাদের গন্তব্য বিজেপি। ফলে রাজ্য বিজেপিতে তৃণমূলি মুখের ভিড়।
এটা ঠিক, বিজেপিতে নেতার খুব অভাব ছিল। সম্ভবত কখনও রাজে্য ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়নি বলে বিজেপিতেও তত বেশি নেতা উঠে আসেননি। একসময় তপন সিকদার, সুকুমার বন্দে্যাপাধ্যায়, তথাগত রায়, অসীম ঘোষের মতো সজ্জন মানুষ বিজেপির চালিকাশক্তি ছিলেন। এখনকার নেতৃত্বের মধে্য সামনের সারিতে রয়েছেন দিলীপ ঘোষ, রাহুল সিনহা, শমীক ভট্টাচার্য, সায়ন্তন বসু প্রমুখ। কিন্তু এর বাইরে তৃণমূলের নেতারাই রাজ্য বিজেপিতে সামনের সারিতে। মুকুল রায়, শোভন চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্জুন সিং, সব্যসাচী দত্তর সঙ্গে সংযোজিত হল দীনেশ ত্রিবেদীর নামও। বেশ কিছু বিধায়ক, দ্বিতীয় সারির নেতা, জোড়াফুলের জনপ্রতিনিধিরা অন্তরাত্মার জাগরণে বিজেপিতে গিয়েছেন।
মমতার দলে বেসুরোদের তথাকথিত অন্তরাত্মার ডাক নতুন নয়। স্বর্গত অজিত পাঁজা, সোমেন মিত্র, পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়দের দলের শীর্ষে বসিয়েছিলেন মমতা। তাঁরা তাঁদের প্রয়োজনে দল ছেড়েছেন। সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এখনও দলের প্রথম সারিতে থাকা নেতৃত্ব তৃণমূল ছেড়ে আবার ফিরে এসেছেন। প্রেস ক্লাবে ওই কান্নার পরেও মমতার দলে ফিরেছিলেন অজিতবাবুও।
সেই সময় যাতায়াতটা মূলত কংগ্রেসের দিকে ছিল। কারণ, বিজেপির তেমন শক্তি ছিল না রাজে্য। বাম দলগুলি কখনও অন্য দলের নেতাকে সরাসরি নিজেদের দলে নেয় না। ফলে সবাই কংগ্রেসেই যেত। এখন বিজেপি ক্ষমতা দখলের লড়াই করছে, তাই রাস্তাটা ‘বিধান ভবন’ নয়, মুরলীধর সেন লেনের দিকে ঘুরে গিয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, গান্ধী হোক বা গডসে- শিবির বদলে কোনও সমস্যাই নেই। নেতারাই প্রমাণ করেছেন, নীতি নয়, আসল হল ক্ষমতা। অনেকেই ভাবেন এত ঘনিষ্ঠ, সর্বক্ষণের সঙ্গীরা একে-এক দল ছাড়ছেন, তাঁকে আক্রমণ করছেন, মমতার মনের কী অবস্থা! তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলা যায়, মমতার কাছে এসব নতুন কিছু নয়। গত তেইশ বছর ধরে এত নেতাকে তিনি যেতে দেখলেন, এবং ফিরতেও দেখলেন- সবটা তাঁর কাছে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কারও দলবদল তাঁকে আলাদা করে বিচলিত করে না।
বস্তুত, নেতাদের যাতায়াত কখনও তাঁর সাফল্যের পথে বাধা হয়নি। এই তেইশ বছর কেন্দ্র থেকে রাজ্য- সব স্তরে তৃণমূলকে একাই সজীব রেখেছেন। একাধিকবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছেন, দশ বছর মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন। সংসদে একদা তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি হয়েছে তাঁর দল। বিভিন্ন রাজ্যে আসন পেয়ে সর্বভারতীয় দলের তকমাও পেয়েছে তৃণমূল। জাতীয় রাজনীতিতে তিনি এই মুহূর্তে বিরোধীদের অন্যতম প্রধান নেতৃত্ব। প্রতিবাদী মুখ। তাঁকে বাদ দিয়ে কিছুই ভাবা যায় না। এসবই সম্ভব হয়েছে মানুষের একটানা সমর্থনে। হারুন-জিতুন, গত আড়াই দশক ধরে তিনিই বাংলার ক্ষমতার যাবতীয় কেন্দ্রবিন্দুতে। তাঁকে উপেক্ষা করে রাজনীতি হয়নি। মমতা প্রমাণ করেছেন, নেতাদের হয়তো ভাঙা যায়, কিন্তু তাঁর সমর্থকদের ভাঙা খুব সোজা কাজ নয়। তাঁরা যতদিন প্রাণভরে তৃণমূ্লের বাগানে অক্সিজেন নেবেন, ততদিন জোড়াফুলের অন্তরাত্মা সুখেই থাকবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.