আক্রমণকারী দু’টি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাচ্ছে আক্রান্ত দেশের প্রতিনিধিও! ইউক্রেন, বেলারুশ, রাশিয়া। সমালোচকদের মতে, রাশিয়াকে কিছুটা খুশি রাখার ভারসাম্যের রাজনীতির মধ্য দিয়ে ইউরোপের অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত করার চেষ্টা রয়েছে। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
শান্তির নোবেল ফের এক ‘ইতিহাস’ স্থাপন করল। দু’টি দেশ একসঙ্গে আক্রমণ করেছে তৃতীয় একটি দেশকে, অথচ শান্তির নোবেলে এক বন্ধনীতে তিনটি দেশের নাম! ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি-র অন্যতম উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোল্যাকের কটাক্ষ, “নোবেল কমিটির শান্তির ধারণা সত্যিই চমৎকার। আক্রমণকারী দুই দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পুরস্কৃত হচ্ছে আক্রান্ত দেশের প্রতিনিধিরাও। মনে রাখতে হবে, রাশিয়া বা বেলারুশের কোনও সংগঠনই যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। এই বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার ‘অসাধারণ’!”
ক্ষোভ গোটা ইউক্রেনে (Ukraine)। সে-দেশের এক প্রখ্যাত আইনজীবী ও সমাজকর্মীর বক্তব্য, ‘মূল্যবোধ রক্ষা করার লড়াইয়ে আমার দেশের মানুষ চরম মূল্য চোকাচ্ছে। এটা বেলারুশ এবং রাশিয়ার মানুষের মূল্যবোধ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা যুদ্ধপরাধকে নীরব সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে।’ নোবেল শান্তি পুরস্কারের দৌড়ে এই বছর সবার আগে ছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি। যদিও তিনি নির্বাচিত হলেও শান্তি পুরস্কার বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকত না। কিন্তু নরওয়ের নোবেল কমিটি রাতারাতি সব হিসাব উলটে শান্তি পুরস্কারের তালিকায় তিন দেশকে এক সারিতে তুলে এনে চমকে দিয়েছে বিশ্বকে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যমে অবশ্য মুহূর্তে ঢাক পেটানো শুরু হয়ে যায় এই বলে যে, নরওয়ের নোবেল কমিটির এই সিদ্ধান্ত নাকি ৭০ বছরের জন্মদিনে ভ্লাদিমির পুতিনকে এক বিরাট ধমক! ইউক্রেনের মানবাধিকার সংগঠন ‘সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিজ’ (সিসিএল) ও রাশিয়ার মানবাধিকার সংগঠন ‘মেমোরিয়াল’-এর সঙ্গে পুতিন-মিত্র বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্দার লুকাশেঙ্কো-র প্রবল বিরোধী হিসাবে পরিচিত অ্যালেস বায়ালিয়াৎস্কি-কে শান্তির নোবেল দেওয়া নাকি প্রবল প্রতাপশালী রুশ প্রেসিডেন্টকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা! নরওয়ের নোবেল কমিটির এই বার্তাকে অবশ্য হেলায় উড়িয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেনে আক্রমণ প্রবল থেকে প্রবলতর করেছেন পুতিন। একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ‘কড়া বার্তা’-র পালটা জবাব রুশ প্রেসিডেন্টের।
নরওয়ে নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তের পর বস্তুত ইউক্রেনের আম ও ছালা দুটোই গিয়েছে। একদিকে আক্রমণকারী রাশিয়া ও বেলারুশের সঙ্গে একসারিতে তাদের দাঁড় করিয়ে তাদের লড়াইকে বিশ্বের দরবারে লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। যা প্রবল হতাশা তৈরি করেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনীয়দের মধ্যে। অন্যদিকে, ফের লাগামছাড়া আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে পুতিনকে। দেশের একের পর এক শহরে প্রতি মুহূর্তে আছড়ে পড়ছে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র। কয়েক দিনের মধ্যে বরফে ঢেকে যাবে কিয়েভের রাস্তাঘাট। তার আগে নতুন করে আরও কয়েক লক্ষ মানুষের ঘরছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা।
প্রতিষ্ঠা-লগ্ন থেকেই শান্তির নোবেল নানারকম বিতর্কে জড়িয়ে। আলফ্রেড নোবেল ১৮৯৫ সালে মারা যাওয়ার আগে তাঁর উইলে লিখে গিয়েছিলেন- পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও সাহিত্যে নোবেল সুইডেনের কমিটি দিলেও শান্তির নোবেল দেবে নরওয়ের কমিটি। নরওয়ের সংসদ সেই কমিটি তৈরি করে দেয়। এই কমিটির কাছে প্রস্তাব পৌঁছয় গোটা বিশ্ব থেকে। প্রস্তাব পৌঁছনোর সময় থেকেই প্রতি বছর বিতর্ক শুরু হয় প্রাপকদের নাম নিয়ে। ‘শান্তি’ বলতে নোবেল কমিটি কী বোঝে, বিতর্ক বরাবর তা নিয়েই। এবারও জেলেনস্কির অন্যতম উপদেষ্টা সেই বিতর্ক উসকে দিয়েছেন। মহাত্মা গান্ধী নোবেল শান্তি পুরস্কার পাননি। একাধিকবার তাঁর নাম প্রস্তাবিত হয়েছে। এমনকী, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরও তাঁর নাম বিবেচনা করেনি নোবেল কমিটি। যে কমিটি মহাত্মাকে শান্তি পুরস্কার দিতে পারেনি, সেই কমিটির কাছে শান্তির অর্থ কী, তা বরাবরই রহস্য! দু’-বছর আগে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম শান্তি পুরস্কারের জন্য প্রস্তাবিত হওয়ার পর দুনিয়া জুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। বিশ্বজুড়ে হানাহানি রুখতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার জন্য নাকি যে পুরস্কার দেওয়া হয়, সেই পুরস্কারের জন্য কেন বিবেচিত হবেন ট্রাম্প, যাঁর আমলে খোদ আমেরিকাতেই সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব বেড়েছে?
নোবেল শান্তি পুরস্কার যে আদতে একটি রাজনৈতিক বিবৃতি, তা নিয়ে সংশয় বহুদিন আগেই দূর হয়েছে। এই রাজনৈতিক বিবৃতি অবশ্যই আমেরিকার ঠিক করে দেওয়া। বিশেষত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রতি বছরই শান্তি পুরস্কারের মধ্য দিয়ে আমেরিকা বিশ্ব রাজনীতিকে তার মতো করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। মার্কিন প্রভাবিত প্রচারমাধ্যমের পক্ষ থেকে প্রতি বছরই ফলাও করে ঘোষণা করা হয়, বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের ভয়ে মূক হয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন কাটায়। শাসকের অবাধ দুর্নীতি দেখে, শূন্যগর্ভ স্লোগান শুনেও এরা চুপ করে থাকে। এসব শাসকের বিরুদ্ধে যাঁরা সাহস দেখিয়ে মুখ খোলেন, তাঁরাই নাকি বিবেচিত হন শান্তি পুরস্কারের জন্য। আসলে মার্কিন লবির বিপ্রতীপে থাকা শাসকদের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই শান্তি পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হওয়া যায়। এটাই নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রায় সোওয়াশো বছরের ইতিহাসের বাস্তব। মায়ানমারের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সু কি-কে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত যে কতটা ভুল ছিল, সেই প্রসঙ্গ রোহিঙ্গা সমস্যার পর বিশ্বের নজরে এনেছিল বাংলাদেশ। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ব্লক বারবার প্রশ্ন তুলে এসেছে শান্তি পুরস্কার প্রাপকদের বাছাই নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছে, কমিউনিজমের বিরোধিতা করা সবসময় শান্তি পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে কেন মাপকাঠি হবে?
পুতিনের (Vladimir Putin) এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী শান্তি পুরস্কার নিয়ে নির্লিপ্ততা দেখিয়েছেন। তিনি স্পষ্টই জানিয়েছেন, কাকে শান্তি পুরস্কার দেওয়া হল তাতে রাশিয়ার কিছু আসে-যায় না। কিন্তু পুতিনকে ‘কড়া বার্তা’ দেওয়ার আড়ালে কি শান্তি পুরস্কারের মাধ্যমে এবার কিছুটা ভারসাম্য রক্ষারও চেষ্টা হল? ইউক্রেনীয়দের প্রতিবাদ থেকে এই প্রশ্ন উঠেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে ন্যাটো দু’-পা এগিয়ে এক পা পিছনোর রণনীতি নিয়ে চলছে। এক্ষেত্রেও কি সেই কৌশলই নেওয়া হল? অর্থাৎ ৭০তম জন্মদিনে পুতিনকে কড়া ধমকের কথা বলেও ইউক্রেনের মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে রুশ মানবাধিকার সংগঠন বা বেলারুশের মানবাধিকার কর্মীকে এক বন্ধনীতে রেখে তাঁকে কিছুটা খুশি রাখারও চেষ্টা! রাশিয়ায় এখনও পর্যন্ত যুদ্ধবিরোধী যেটুকু প্রতিবাদ হয়েছে, তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। মার্কিন সংবাদমাধ্যম দু’-একটা প্রতিবাদকে যতই বড় করে দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন, সাধারণ রুশ নাগরিকরা এই যুদ্ধে এখনও পর্যন্ত পুতিনের পাশেই। নোবেলজয়ী ‘মেমোরিয়াল’ নামে রুশ সংস্থাটি স্তালিন আমলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে মৃত ও অত্যাচারিতদের আর্কাইভ তৈরি করে। এই সংগঠনের পুতিন-বিরোধিতার জোরালো ইতিহাস নেই। বেলারুশের যে মানবাধিকার কর্মীকে শান্তির নোবেলের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে, তাঁর আন্দোলনের প্রভাবও খুব সীমিত। বেলারুশের সরকার বলে থাকে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে তিনি জেলবন্দি।
শান্তি পুরস্কারের জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে আলাদা করে বেছে না নেওয়ার মধ্যেই আসলে বার্তা স্পষ্ট। রাশিয়াকে কিছুটা খুশি রাখার ভারসাম্যের রাজনীতির মধ্য দিয়ে ইউরোপের অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত করার চেষ্টা রয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের পূর্বাভাস, আগামী বছর আর্থিক মন্দার মধ্যে পড়তে চলেছে আমেরিকা-সহ প্রায় সমগ্র ইউরোপ। ফলে এই মুহূর্তে রাশিয়ার গ্যাসকে কীভাবে উপেক্ষা করতে পারে ইউরোপ? শান্তি পুরস্কারের মধ্য দিয়ে সরাসরি পুতিনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি মার্কিন মদতপুষ্ট ন্যাটো লবির পক্ষে। বরং রাশিয়া ও বেলারুশের নাম শান্তির নোবেলে যুক্ত করে ইউক্রেনের সঙ্গে দু’-দেশের সংঘাতকে লঘু করে দেখানোর প্রচেষ্টা স্পষ্ট।
পুতিন তাঁকে করা তথাকথিত কড়া ধমকের জবাব দিচ্ছেন লাগাতার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার মধ্য দিয়ে। এই যুদ্ধ কোনদিকে যাবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু, ২০২২-এ শান্তি পুরস্কারের বাছাই নিয়ে বিতর্ক যে আগামী দিনে ঘনীভূত হবে, তা স্পষ্ট করেই বলা যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.