বিজেপি কুরে-কুরে খাচ্ছিল জেডি(ইউ)-কে। নীতীশ কুমার তাই বেরিয়ে এলেন। এনডিএ-র ছত্রছায়া থেকে। সাহসী চাল দিয়েছেন, বিরোধিতার পরিসরকে বলিষ্ঠও করেছেন, এমনকী, বেশ খানিকটা সময় বন্দি করতেও সক্ষম হলেন। কিন্তু ‘আহত’ বিজেপি তো আর চুপ করে বসে থাকবে না। পাটনা কি তাহলে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের মুগুর ভাঁজার পরবর্তী গন্তব্য হতে চলেছে? সময় বলবে। কলমে রাজদীপ সরদেশাই
অলিম্পিকে যদি ‘রাজনীতির জিমন্যাস্টিক’ বলে কোনও খেলা থাকত, সে-খেলায় নীতীশ কুমার সোনা জেতার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হতেন নিশ্চিত! হালের শপথগ্রহণ মিলিয়ে, গত ১৭ বছরে তিনি রেকর্ড ৮বার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করলেন। দেখিয়ে দিলেন, তাঁর মতো ‘অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা’ প্রয়োগ করতে খুব কম চোস্ত রাজনীতিক-ই পারেন। ডিগবাজি খাওয়া, পাল্টি খাওয়া- এসব তো সেখানে মিশে আছেই। তাঁর প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতায় বড়সড় ঘাটতি দেখা দিল এর ফলে, তা ঠিকই। কিন্তু একইসঙ্গে এই ‘এনডিএ’ জোট থেকে বেরিয়ে নতুন করে নীতীশ কুমারের বিধানসভা গঠন করার ঘটনা দেখিয়ে দিল- দেশজুড়ে বিজেপির শালপ্রাংশু উপস্থিতি এবং ‘বিরোধীমুক্ত ভারত’ অ্যাজেন্ডার বিরুদ্ধে অ-বিজেপি বিরোধী শিবিরগুলি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কীভাবে এবং কতদূর যেতে পারে।
সত্যি বলতে, বিজেপিকে যদি নীতীশ কুমারের ‘অচেনা বন্ধু’ ভাবা হয়, তবে তাদের সঙ্গে জোট ছিন্ন করে পুনরায় ‘চেনা শত্রু’ লালুপ্রসাদ ও তাঁর পুত্র তেজস্বীর সঙ্গে জোট স্থাপন অবশ্য কোনওভাবেই ভাবধারার বদল নয়। বরং, এই সিদ্ধান্ত বিজেপির প্রতি ভয় থেকে উদ্ভূত। কারণ, বিজেপি ক্রমশ জনতা দল (ইউনাইটেড)-কে কুরে-কুরে খেয়ে নিচ্ছিল। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে ক্রমশ আধিপত্য কায়েম করছিল বিজেপি। এই বিজেপি-ফোবিয়া জেডি(ইউ) দলের প্রধান নীতীশবাবুর একার নয়। গত তিন বছরে, ২০১৯-এর আরও দু’টি বিজেপির জোটসঙ্গী অকালি দল এবং শিব সেনা, ‘এনডিএ’ জোট থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আবার ওদিকে, ‘এআইএডিএমকে’ এবং ‘লোকজনশক্তি’ (এলজেপি)- দল দু’টির মধ্যে ক্রমশ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে। অকালি দল ‘মোদি প্রকল্প’ থেকে বেরিয়ে এসেছিল কারণ, পাঞ্জাবে কেন্দ্রবিরোধী কৃষক আন্দোলনের জোর দেখে তাদের কাঁপুনি লেগে গিয়েছিল রীতিমতো। ওদিকে, মহারাষ্ট্রে শিব সেনার দাবি ছিল আরও ক্ষমতার জোর। অকালি দল তবু দুর্বল, কিন্তু শিব সেনা দলের এখন একদম হাটে হাঁড়ি ভাঙা অবস্থা।
এক অর্থে, এনডিএ জোটের অস্তিত্ব প্রায় ‘নেই’ হয়ে গিয়েছে। তাকে প্রতিস্থাপিত করেছে নতুন রাজনৈতিক বুনো শক্তি- বিজেপি স্বয়ং (মোদি-শাহ) কিংবা ‘এমএস’ প্রতিরূপ। এনডিএ-র মূল অবতারের কথা ভাবলে দেখা যাবে, সেখানে ছিল বিজেপির ‘আদবানি-বাজপেয়ী’ সংস্করণ। সেখানে ছিল বড় বড় আঞ্চলিক দল, যাদের চরিত্র মূলত তীব্র কংগ্রেস-বিরোধিতা এবং সমর্থনসুলভ বাজপেয়ী-পন্থা। সেখানে ছিলেন সোশ্যালিস্ট জর্জ ফার্নান্ডেজ যেমন, তেমনই ছিলেন রণং দেহি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আবার ওদিকে ছিলেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী বাল ঠাকরে। এঁরা প্রত্যেকেই এই ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স’-এ আশ্রয় পেয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৪ থেকে যেই না বিজেপির মোদি-শাহ সংস্করণ এল, এনডিএ তারপর থেকে ছোট-বড় মিলিয়ে ২০টি জোট হারিয়েছে। আর একটাও জোটসঙ্গী নেই বিজেপির, লোকসভায় যাদের দুই অঙ্কের আসন রয়েছে। এর থেকে যা পরিষ্কার, বিজেপির মোদি-শাহ সংস্করণ একাই চরম আধিপত্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। পরিণতিতে তীব্র এক ক্ষমতার দিকবদল ঘটেছে। আর, সেখানে জোটসঙ্গীদের থাকা বা না-থাকা এখন অমূলক, কিছু যায়-আসে না।
সম্ভবত, যে-গতিতে এবং নৈপুণ্যের সঙ্গে এই মোদি-শাহর বিজেপি তথা নব্য বিজেপি তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে, তা রীতিমতো হকচকিয়ে দিয়েছে পুরনো জোটসঙ্গীদের। বিহারে, ২০২০-র বিধানসভা নির্বাচন অবধি জেডি(ইউ)-ই ছিল বিজেপির প্রধান ও জ্যেষ্ঠ জোটসঙ্গী। আর, এই নির্বাচনে বিজেপির আসন সংখ্যা জেডি(ইউ)-র চেয়ে বেশ ভালরকম এগিয়ে ছিল। এমন পরিস্থিতিতে, এনডিএ-র এক পুরনো জোটসঙ্গী চিরাগ পাসওয়ান (রামবিলাস পাসওয়ানের পুত্র), হঠাৎ করে বিজেপি নেতৃত্বের কথায় উত্তেজিত হয়ে জেডি(ইউ)-র বিরুদ্ধে প্রার্থী ঘোষণা করলেন। আর তাতেই অস্বস্তি একদম খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এল। মহারাষ্ট্রেও একইরকম ঘটনা। শিব সেনা দেখল, হঠাৎই জোটে তাদের অবস্থান ক্ষুদ্রতর হয়ে গিয়েছে। বাল ঠাকরে থাকাকালীন এমন আচরণের কথা ভাবা-ই যেত না! কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতে সেটাই হল। এমনকী, পাঞ্জাবে অকালি দলও বুঝতে পারল, বিজেপি মোটেই আর তাদের আগের মতো পাত্তা দিচ্ছে না, যখন প্রকাশ সিং বাদল জোটের হাল ধরলেন, এবং সেখানে একগুচ্ছ অস্বস্তি। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই জোটসঙ্গ থেকে একটার বেশি ক্যাবিনেট মন্ত্রক কারও কপালেই জুটল না মোদি সরকারে, দিল্লির মসনদে।
আদবানি-বাজপেয়ীর বিজেপি তথা সাবেক বিজেপির রাজত্বকালে, দেশের প্রধান প্রধান রাজ্যে কূল পেতে বিজেপি মূলত এই জোটসঙ্গীদের উপরই নির্ভরশীল ছিল। কংগ্রেস-শাসিত মহারাষ্ট্রকে উদাহরণ ধরি যদি, বিজেপির ডানায় হাওয়া লাগানোর জন্য সে-সময়ে দরকার ছিল কট্টর আঞ্চলিক দল শিব সেনার আশ্রয়। একইভাবে পাঞ্জাবে অকালি দলের শিখ পরিচয় সেখানে বিজেপির ব্যাপ্তি প্রসারিত করতে সাহায্য করেছিল। বিহারে জাতপাতের জটিল গোলকধাঁধায় জেডি(ইউ)-এর মতো একটি ‘মণ্ডলীকৃত’ শক্তির সমর্থন বিজেপিকে সেখানে বিজেপির মূলত উচ্চবর্ণের সমর্থন ভিত্তির বাইরে যেতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু গত দশকে, মোদি-শাহ পরিচালিত নব্য বিজেপি যেভাবে রীতিমতো ছক কষে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির সঙ্গে সামাজিক জোট তৈরি করল, বিশেষ করে হিন্দি বলয়ে, তাতে পূর্বতর জোটসঙ্গীদের প্রতি বিজেপির নির্ভরশীলতা কমল অনেকটাই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং অমিত শাহের যুদ্ধং দেহি ভাবমূর্তি এমনই মানে তৈরি করল যে, নব্য বিজেপির জোটসঙ্গীরা ভয় পেতে শুরু করল। অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি যাকে বলে! সর্বশক্তিমান এই জুটির উপস্থিতিতে তারা আর নিরাপদ বোধ করল না। পরিণতিতে, যারা এই জুটিকে আক্রমণ করার সামর্থ্য রাখল, তারা সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের অপমানের চেয়ে তুলনায় কম আত্মসম্মানে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পন্থা বেছে নিল।
এই ঘটনা নীতীশ কুমারের সঙ্গে এনডিএ-র সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বের অনিবার্যতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে। মনে রাখতে হবে, নীতীশ কুমার-ই প্রথম এনডিএ নেতা হিসাবে ২০১৩ সালে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। পরে যদিও মোদিকেই বিজেপির নির্বাচনী প্রচার কমিটির প্রধান হিসাবে উন্নীত করা হল। সেই সময় নরেন্দ্র মোদিকে তখনও বিজেপির প্রধানমন্ত্রীর আসনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়নি, আর নীতীশ কুমার ১৭ বছরের জোটে সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। তাঁর দাবি ছিল যে, তিনি তাঁর ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ পরিচয়ের সঙ্গে আপস করবেন না। নীতীশ কুমার যখন ২০১৭ সালে এনডিএ-তে ফিরে আসেন, সেই ফেরা যেন এটা অস্পষ্টভাবে গ্রহণ করে নেওয়া যে, মোদির নাটকীয় আরোহণকে চ্যালেঞ্জ করার মতো মুরোদ বা জোর তাঁর নেই। কিন্তু ফিরে আসার সিদ্ধান্তটি যে তিনি খুব দায়ে পড়েই করেছিলেন, তার প্রমাণও রয়েছে বেশ। ২০১৮ সালে তাঁর স্মৃতিকথায়, লালুপ্রসাদ দাবি করেছেন যে, নীতীশ এনডিএ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ‘মহা-গঠবন্ধন’-এ ফিরে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিশ্বাসের অভাব তাঁর ফিরে আসায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
নীতীশ কুমারের দুর্দশা আসলে আঞ্চলিক দলগুলির নেতাদের দুর্দশাকেই প্রতিফলিত করে। এই নেতাদের অবস্থা এখন শাঁখের করাত- হয় নিঃশব্দে নব্য বিজেপি নেতৃত্বের ইতিমধ্যে চারিয়ে থাকা আধিপত্যবাদকে গ্রহণ করো, অন্যথায় বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে শেষমেশ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলির বলপূর্বক ক্ষমতার কাছে ধরাশায়ী হও। নবীন পট্টনায়েক এবং জগনমোহন রেড্ডি কৌশলগতভাবে কেন্দ্রের সঙ্গে এক প্রকারের সহবাস-প্রস্তাব তৈরি করেছেন বলে মনে হচ্ছে। অন্যদিকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বরে এখনও জোরালো প্রতিবাদ, কিন্তু উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচন থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্তে অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে। অন্যান্য অভিজাত ও রাজ পরিবারসুলভ আঞ্চলিক দলের ‘পারিবারিক ভাগ্য’ সম্পূর্ণভাবে বিজেপি এবং ‘এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট’-এর আওতায় ঝুলছে।
এসব ভেবে দেখলে, বিহারের পরিস্থিতি এখন অনেকটা সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্র বনাম চতুর আঞ্চলিক শাসনকর্তার মধ্যে দ্বন্দ্ব। নীতীশ কুমার হয়তো সাহসী চাল দিয়ে বিরোধিতার পরিসরকে বলিষ্ঠ করেছেন, নিজের হাতেও বেশ খানিকটা সময় বন্দি করতে সক্ষম হলেন। কিন্তু ‘আহত’ বিজেপি তো আর চুপ করে বসে থাকবে না! পাটনা কি তাহলে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের মুগুর ভঁাজার পরবর্তী গন্তব্য হতে চলেছে? সময় তা বলবে।
পুনশ্চ বিজেপি কীভাবে তার জোটসঙ্গীদের সঙ্গে ক্ষমতার সমীকরণ বদলায় সময়ে সময়ে, তার সবচেয়ে ভাল উদাহরণ ছোট্ট রাজ্য গোয়া। ১৯৯০ নাগাদ বিজেপি তার শাখা আঞ্চলিক ‘মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টি’-কে (এমজিপি) ব্যবহার করে গোয়ায় নিজের জায়গা সুরক্ষিত করার ঘঁুটি সাজিয়েছিল। হালে, সেই এমজিপি-ই গোয়ার বিজেপি-শাসিত সরকারে একটি প্রান্তিক শক্তি। এমজিপি-র এক নেতা যেমন দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করেছিলেন- ‘আমরা বিজেপিকে আমাদের হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের একটি অংশ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু তারা সেখানে রীতিমতো শত্রুতাপূর্ণ দখলদারি করল !’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.