সরোজ দরবার: অদ্ভুত সমাপতন! আশ্চর্য তো বটেই। ঠিক যে দিন কলকাতা। মেতে আছে যিশুর জন্মদিনে, সেদিনই চলে গেলেন কলকাতার যিশু-র কবি। আরও অদ্ভুত, ঠিক যে সময়টায়, রাজাকে প্রশ্ন করা বাচ্চা ছেলেটিকেও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, বাক স্বাধীনতা অনেকখানি প্রশ্নের মুখে, তখনই তাঁর প্রস্থান। হয়তো সময়োচিত। তবু এ সবই কি ইতিহাস নির্ধারিত! নাকি নেহাতই কাকতালীয়। উত্তর মেলে না। কেবল বিস্মিত হতে হয়। আসলে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মানেই পরতে পরতে বিস্ময়। যে কোনও কবিতাপ্রয়াসীর কাছে তিনি শিক্ষক। শুধু কবিতা লেখা নয়, শুদ্ধ বাংলা অন্তত যাঁরা লিখতে চান, তাঁদের কাছেও তিনি শিক্ষক। তবে সম্পাদনা বা ছোটদের জন্য লেখা তুলে রেখেওবলতে হয়, সবার উপরে, তিনি প্রথমত ও প্রধানত কবি।
সেই কবি আমাদের বিস্মিত করেন যখন তিনি বলেন, ‘অনেকে মনে করেন যে, কবিতা একটি অপার্থিব দিব্য, বস্তু, এবং তাকে আয়ত্ত করবার জন্যে, মুনি-ঋষিদের মতো নির্জন পাহাড়ে-পর্বতে কিংবা বনে-জঙ্গলে গিয়ে তপস্যা করতে হয়, আমি তা মনে করি না। আমার বিশ্বাস, জাতে যদিও একটু আলাদা, তবু কবিতাও আসলে সাংসারিক বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়, আমাদের এই সাংসারিক জীবনের মধ্যেই তার বিস্তর উপাদান ছড়িয়ে পড়ে আছে, এবং ইসকুল খুলে, ক্লাস নিয়ে, রুটিনমাফিক আমরা যেভাবে ইতিহাস কি ধারাপাত কি অঙ্ক শেখাই, ঠিক তেমনি করেই কবিতা লেখার কায়দাগুলোও শিখিয়ে দেওয়া যায়।’ এর মধ্যে বিস্ময়ের কী আছে? আছে এই কারণে যে, এত সহজ করে কবিতার দর্শন ও কবিতা লেখার পদ্ধতির শিক্ষা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করিয়ে দেওয়া যায়, সেটাই বিস্ময়ের। লেখা যে শেখার জিনিস, এই ধরতাইটা বরাবর আমাদের ধরিয়ে দেন নীরেন্দ্রনাথ। কিন্তু কোথাও তিনি গুরুমশাইটি নন। কবিকঙ্কণ ছদ্মনামে একদা কবিতার ক্লাস খুলেছিলেন। পরে যখন তা বই হিসেবে প্রকাশিত হয়, মনে হয় সমস্ত লিখিয়ের প্রথম পাঠ হয়ে দাঁড়ায়। অন্তত আমার মনে হয়, তরুণ কবির প্রতি লেখা রিলকের চিঠি যতটা জরুরি, তার থেকে নীরেন্দ্রনাথের এই ক-টি মাত্র কথার গুরুত্ব কম কিছু নয়। কবিতাই একমাত্র অবলম্বন হবে কি হবে না, সেটা জরুরি কথা বটে, কিন্তু যদি তাই-ই হয়, তবে বাঁচতে গেলে যেমন শ্বাস নিতে হয়, লিখতে গেলেও সেরকম তার উপকরণ খোঁজা, ছন্দ, কলাকৌশল জানতে হবে।
অর্থাৎ বাঁচার উপায়টি জানতে হবে। নীরেন্দ্রনাথ সেই সত্যটি জানিয়ে দেন মাত্র কটা কথায়। বহু অগ্রজ কবিই তরুণ কবিকে এই কৌশল শিখিয়ে দেন। খাতা টেনে কারেকশন করে দেন, ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেন, সম্পাদনা করে দেন। আর নীরেন্দ্রনাথ সকল কবিতা শিক্ষার্থীর জন্য করেন সেই কাজটি। সকলের খাতা তিনি টানতে পারেন না, কিন্তু সকলের খাতা তৈরির গোড়াটি তিনি বেঁধে দেন। নীরেন্দ্রনাথের কলমের পিছনে এক সরস মন যে চিরটাকাল সক্রিয় ছিল, তা তাঁর পাঠকমাত্রই জানেন। কী কবিতা, কী গদ্য, এমনকী যখন তিনি ছন্দ বা বাংলা ব্যাকরণের খুঁটিনাটি শেখাচ্ছেন, তখনও তাঁর যে সরস উপস্থাপনা, তা শিক্ষণীয়।
আসলে জীবনে সম্পৃক্ত না হলে এই রস খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কবিতার ভুবনেও তিনি তন্ন করে ওই জীবনকে খুঁজেছেন, নেমে এসেছেন গলিঘুঁজিতে। চোখ রেখেছেন ইতিহাসে। নইলে কে আর, এমন করে বলতে পারেঃ মন্দির না মসজিদ না বিতর্কিত কাঠামো, এই ধুন্ধুমার তর্কের ভিতর থেকে কানা-উঁচু পিতলের থালা বাজাতে-বাজাতে বেরিয়ে এল পেটে-পিঠে এক হয়ে যাওয়া, হাড়-জিরজিরে দুটি লেংটি-পরা মানুষ। তাদের মাথার উপরে দাউদাউ করে জ্বলছে মধ্যদিনের সূর্য। তবে পরপর কয়েকটা দিন যেহেতু বৃষ্টি হয়েছে, তাই তাদের ফুটিফাটা পায়ের তলায় আর্যাবর্তের ঘাস এখনও হলদে হয়ে যায়নি। হ্যাঁ, আমরা জানি এই দুই ব্যক্তির নাম হতেই পারেন সিকান্দর শাহ এবং সেলুকাস। এবং এই কবিতা কোনও সময়ে বাঁধা না থেকেও প্রাসঙ্গিকতা হারায় না। এটাই বোধহয় নীরেন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য। সময়ের ভিতর বসেও তিনি শাশ্বতকে তুলে আনতে পারেন। বহমানের ভিতর থেকেও আবহমানকে ছুঁতে পারেন। সামান্য উপকরণেই তিনি তাঁর কবিতাকে কালোত্তীর্ণ করে দিতে পারেন। ইতিহাসের এমন কক্ষপথে স্থাপনা করতে পারেন তাঁর কবিতাকে, যে ইতিহাস মানুষের, আগামীর। তাই সমস্ত করুণা-কৌতুক-ব্যঙ্গ সত্ত্বেও তিনি মনে করতেন, বিশ্বাস করতেন, অন্তত তাঁর কবিতায় জানিয়ে গিয়েছেন, পৃথিবীটাকে এখনও পুরোপুরি আমরা নষ্ট করে তুলতে পারিনি। এই ঋত বিশ্বাসে তিনি তাঁর পাঠককেও টেনে আনতে পারেন। ফলে সেই পাঠক জানে, এখানে রাজা তোর কাপড় কোথায়- এ প্রশ্ন তোলা যায় অনায়াসে। অন্তত তোলা উচিত।এখানে অমলকান্তিরা রোদ্দুর হওয়ার সাহস রাখে। কিংবা যেতে নাহি দিব-র বেদনা অতিক্রম করে বলে ফেলা যায়, দাঁড়িয়ে থাকতে নেই যাত্রার পথে কারো। কারণ তিনি জানেন,
যখন যা বলি, নিজেকেই বলি,
কাউকে তো কিছু বলত হবে।
পথে যদি কোনো সঙ্গী না পাই
একা-একা পথ চলতে হবে।
নিজ-হাতে যদি জ্বেলেছি আগুন
তবে নিজেকেই জ্বলতে হবে।
মানুষের কথা, ব্যাপ্ত জীবনের কথা, আবিল জীবনের কথা সহজ করে বলতে পারা এক সাধনা। সহজের সাধনা। যে সাধনায় ঋষি ও কবি এক হয়ে যান। কবিতা লেখার জন্য ঋষির মতো হিমালয়ে গিয়ে সাধনা করার দরকার নেই, কিন্তু নীরেন্দ্রনাথ দেখিয়ে দেন, কবিতা লিখতে লিখতেই আসলে ঋষি হয়ে ওঠা যায়। শেষ প্রার্থনায় তাই তিনি কামনা করেন, ‘আর-কিছু নয়, আলোর ভালবাসা।’ কেবল কবি কিংবা ঋষিরাই মানুষের জন্য প্রার্থনা করতে পারেন এই শুশ্রূষা। আলোর ভালবাসায় কোনও বিভাজন থাকে না, কার্পণ্য থাকে না, শ্রেণীবৈষম্য থাকে না। সেই উজ্জ্বল পৃথিবীই কবির অঙ্গীকার। তা আত্মস্থ করাই বোধহয় হবে কবিকে জানানো আমাদের প্রণাম।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.