যে গভীর ক্ষত এখনও দগদগে, তা চাপা দিয়ে একটা দেশ কতদূরেই পা পৌঁছবে? নির্ভয়ার মায়ের এ খেদ যেন দেশের মুখের উপর একখানা আয়না তুলে ধরল৷ নিজেকে দেখে কি একটুও চমকাবে এই দেশ? লিখছেন সরোজ দরবার
দিন ফিরে ফিরে আসে৷ না চাইলেও আসে৷ ঠিক যেভাবে ফিরে এসেছে ১৬ ডিসেম্বর৷ অনেকের স্মৃতিতেই হয়তো আজকের দিনটি ফিকে হয়ে গিয়েছে৷ কেননা এতদিনে নিভে গিয়েছে সহানুভূতির মোমবাতিগুলি৷ এতদিনে কাগজে কাগজে বন্ধ লেখালিখি৷ এতদিনে থেমে গিয়েছে বিক্ষুব্ধ সোশ্যাল মিডিয়া৷ দিনের মর্জি ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে নোট বাতিলের যুক্তি-তক্কো-গপ্পোয়৷ আলোচনারা জায়গা করে নিয়েছে শিক্ষাবিলের যৌক্তিকতায়৷ শীত দিনকাল নানা অছিলায় খুঁজে নিচ্ছে কফি কাপের উষ্ণতা৷ উলেল আরামের দিন স্বস্তি আরাম দিচ্ছে তামাম দেশের নাগরিককে৷ কিন্তু স্বস্তি কোথায় আশা দেবীর? তিনি যে নির্ভয়ার মা৷
হ্যাঁ, এই সেই ১৬ ডিসেম্বর, যেদিন গণধর্ষিতা হয়েছিলেন নির্ভয়া৷ চলন্ত বাসে তাঁকে তুলে নেওয়া হয়েছিল৷ তারপর কিছু পুরুষের বিকৃতকাম উদ্ধত অহংকার ঢুকে পড়েছিল তাঁর যোনিতে৷ সে রক্তক্ষরণ থামেনি৷ চলে গিয়েছিলেন নির্ভয়া৷ সেদিন যে দেশবাসী যন্ত্রণা অনুভব করেছিলেন, আজ তা যেন সময়ের মলমে উপশম পেয়েছে৷ কিন্তু নির্ভয়া জননী তা পাবেন কী করে! তিনি তাই জানাচ্ছেন তাঁর খেদ৷ চার চারটে বছর কেটে গিয়েছে৷ এখনও সুবিচার নেই৷ আইনের গেরোয় পড়ে এখনও দিব্যি আছে অভিযুক্তরা৷ এখনও মেলেনি সুপ্রিম রায়৷ নির্ভয়ার তাই মৃত্যু হয়েছে শুধু৷ মৃত্যুদণ্ড পায়নি তাঁর ধর্ষকরা৷
যেদিন এ খেদ জানাচ্ছেন নির্ভয়ার মা, সেদিনও চলন্ত গাড়িতে ধর্ষিতা হয়েছেন একজন৷ বস্তুত ক’টা ধর্ষণের খবরই বা সামনে আসে! কটা ধর্ষণই বা বিচার পায়! যে সভ্য দেশ নিজেকে ক্যাশলেস করে তুলতে চায়, যে দেশ অর্থনীতিতে বিশ্বের প্রথম সারিতে বসতে চায়, সে দেশ আজও তার নির্যাতিতা কন্যাকে বিচার দিতে পারেনি৷ এ কি বড় গৌরবের কথা? কোথায় রাজনীতিবিদরা! কোথায় সেই সমাজকর্মীরা! প্রতিটা দিন এক ইস্যু থেকে সরে যাচ্ছে আর এক ইস্যুতে৷ সেখানে বছর চারেকে আগেকার একটা ঘটনা গৌণ হয়ে পড়বে, এই যেন দস্তুর৷ কিন্তু যে গভীর ক্ষত এখনও দগদগে, তা চাপা দিয়ে একটা দেশ কতদূরেই পা পৌঁছাবে? নির্ভয়ার মায়ের এ খেদ যেন দেশের মুখের উপর একখানা আয়না তুলে ধরল৷ নিজেকে দেখে কি একটুও চমকাবে এই দেশ? কে জানে!
অগ্রগতির সোপান ধরে দেশ নাকি তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে৷ অন্তত একশ্রেণির নাগরিকরা সে ব্যাপারে নিশ্চিত৷ পরম ভক্তিতে তাঁরা জানেন, এই দেশ এই জমানায় যেভাবে হাঁটছে, সেভাবে আর কখনও হাঁটেনি৷ পাকিস্তানি জঙ্গিকে তছনছ করার খবর তাই আমাদের কলার উঁচু করে দেয়৷ সত্যি তো সন্ত্রাকে দুরমুশ করার খবরে কোন দেশবাসীর না মাথা উঁচু হবে! এদিকে জাতীয়তাবাদের হাওয়া যাতে একটুও ফিকে না হয়, তার জন্য সিনেমা হলে হলে জাতীয় সংগীত বাজানোর নিদান দেওয়া হয়েছে৷ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ শুধু একটু খটকা লাগে৷ নির্ভয়ার বিচারের থেকেও কি জাতীয় সংগীত বাজানোর বিধান দেওয়ার দরকার বড় হয়ে পড়েছিল? অগ্রগতির সোপানে কি এভাবেই সবকিছু পিছু ফেলে দেওয়া বিধেয়! হবেও বা!
বিচারব্যবস্থার বেহাল দশা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই সরব সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি৷ প্রকাশ্যে কেঁদেও ফেলেছিলেন৷ তাঁর দুঃখ, বিচারপতি নিয়োগের অভাবে দেশবাসীকে যথাসময়ে বিচার পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না৷ ফাইলের পাহাড় জমছে৷ নির্ভয়ার ঘটনাও সেরকমই বিরাট পাহাড়ের একটা ফাইল মাত্র৷ কিন্তু কী এক অজ্ঞাতকারণে সে নিয়োগ আর কিছুতেই হয় না৷ বিচারব্যবস্থার এই বেহাল দশা আজকের নয়৷ রোগের সূত্রপাত আরও আগে থেকেই৷ এমনকী বলিউডি সিনেমাও সে কথা জানে৷ বারবার বলিয়েছে ভিলেনের মুখ দিয়ে৷ তারা পুলিশকে হুমকি দিয়ে বলেছে, তাকে পাকড়াও করে কী লাভ! আইন তার বিচার করতে করতে নিয়মে ফাঁক গলে চিড়িয়া ফুড়ুৎ৷ এ যদি চিত্রনাট্য জানে, বাস্তবের অপরাধীরা কী আর তা জানে না৷ জানে বলেই দিব্যি চলছে যেমন চলার৷ সময় সময় কিছু মোমবাতি খালি জ্বলে ওঠে৷ কোথাও বিশেষ কিছু বদলায় না৷
দেশ ভাল থাকুক- কোন দেশবাসী না চায়! কিন্তু প্রশ্ন হল পচাগলা ক্ষত স্যুট দিয়ে ঢেকে দেশ আর কতদিন ভাল থাকবে? একদিকে ফেমিনিজমের ফোর্থ ওয়েভ বেডসাইডে সেক্স টয় রাখার দিনের ব্যবস্থা করে ফেলেছে৷ অন্যদিকে নির্ভয়ার মা আজও সুবিচার পাচ্ছেন না৷ কোনটা তাহলে দেশের মুখ আর কোনটা মুখোশ? এ প্রশ্নে আবার হয়তো কিছু আলোড়ন উঠবে৷ খানিকটা শোক, খানিকটা খেদ, অনেকটা হতাশা আবার আমাদের গ্রাস করবে৷ তারপরই হয়তো কাল কোনও প্রবল জাতীয়তাবাদী হাওয়ায় আবার বেসামাল হয়ে যাবে আমাদের ঘরবাড়ি৷ ফলত আবারও একটা ডিসেম্বর আসবে৷ আবারও হয়তো কাঁদবেন নির্ভয়ার মা৷ শুধু সংখ্যার বিচারে চার থেকে পাঁচ হয়ে যাবে সে খেদের বয়স৷ কোথাও কিছু বদলায় না৷ শুধু ওই বিপন্ন মুখের সামনে, ওই অশ্রুর সামনে মাথা নিচু হয়ে আসে৷ ক্ষমা করো মা-আর কীইবা বলার থাকে!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.