Advertisement
Advertisement
Netaji Subhas Chandra Bose

নেতাজির শিল্প ও অর্থনৈতিক ভাবনা

নেতাজিই ছিলেন ভারতের ‘জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন’-এর প্রবর্তক।

Here is a thought about Netaji Subhas Bose's industrial and economic thought। Sangbad Pratidin

ফাইল চিত্র

Published by: Krishanu Mazumder
  • Posted:January 17, 2023 1:00 am
  • Updated:January 17, 2024 4:35 pm  

কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র বসু বুঝেছিলেন স্বাধীনতা বেশি দূরে নয়। তাই স্বাধীন ভারত সরকারের কথা ভেবে পরিকল্পনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে ‘জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি’ গঠন করা হয়। ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে, অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক জাতীয় পর্যায়ে একটি উপদেষ্টা পরিকল্পনা বোর্ড গঠন করা হয়, যা স্বাধীন ভারতে পরিকল্পনা কমিশন গঠনের পথ প্রশস্ত করে। আজ, তাঁর ১২৬তম জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ। লিখলেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর (Subhas Chandra Bose) স্বাধীনতা আন্দোলন তথা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা আলোচিত হলেও তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের আর-একটি দিক তেমনভাবে আলোচিত নয়। তা, তাঁর শিল্প ও অর্থনৈতিক ভাবনা। ট্রেড ইউনিয়ন নেতা হিসাবে একসময় জামশেদপুরে ‘টাটা স্টিল’ কারখানার ধর্মঘট মিটিয়েছিলেন খোদ নেতাজি। পাশাপাশি তিনিই ছিলেন ভারতের ‘জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন’-এর প্রবর্তক।

Advertisement

১৯২৮ সালে টাটাদের কারখানার সেই ধর্মঘট সুভাষচন্দ্র মেটানোর পর আর ওই কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ হয়নি বলেই দাবি করতে দেখা যায় কর্তৃপক্ষকে। শুধু তাই নয়, কারখানায় মালিক-শ্রমিক সম্প্রীতি বজায় রয়েছে দাবি করে পরবর্তীকালে ৫০ কিংবা ৭৫ বছর পূর্তি উৎসব পালন করতেও দেখা গিয়েছে এই শিল্পগোষ্ঠীকে। তবে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে সমর্থন করে ১৯৪২ সালে ‘টোকেন স্ট্রাইক’ হলেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ওই ধর্মঘটকে ম্যানেজমেন্ট সমর্থন করেছিল। ফলে টাটা স্টিল ম্যানেজমেন্ট ১৯২৮ সালের ধর্মঘটকেই শেষ প্রকৃত ধর্মঘট বলে অ্যাখ্যা দিয়ে এসেছে।

[আরও পড়ুন: নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে তৃতীয় ওয়ানডের আগে মহাকাল মন্দিরে সূর্যরা, পন্থের আরোগ্য কামনায় পুজো]

১৯২৮ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত জামশেদপুরে টাটা স্টিল প্ল‌্যান্টের কর্মী ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯২০ সালে গঠিত ওই ইউনিয়নের তৃতীয় সভাপতি ছিলেন সুভাষচন্দ্র। ওই সময় সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে বিদেশিদের বদলে দেশীয়দের বসানোর জন্য টাটা কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি তুলে তা আদায় করতে সক্ষমও হন তিনি। এজন্য টাটা স্টিলের তৎকালীন কর্তা এন. বি. সাকলাতওয়ালাকে চিঠি দেন সুভাষচন্দ্র। সেই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘এই কোম্পানির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল উচ্চপদে কোনও ভারতীয় নেই। আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে, যদি টাটা স্টিল ভারতীয়করণ নীতি নিয়ে এগিয়ে চলে তবে আপনারা আপনাদের ভারতীয় কর্মচারীদের পাশাপাশি গোটা দেশ ও দেশের বিভিন্ন মতাদর্শের নেতাদের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হবেন।’

এর কিছুদিন পরই টাটা স্টিল (Tata Steel) পায় তাদের প্রথম ভারতীয় জেনারেল ম্যানেজার। পাশাপাশি নেতাজিই চাপ দিয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি আদায় করাতে পেরেছিলেন এবং শ্রমিকদের দাবিমতো প্রথম মুনাফাভিত্তিক বোনাস চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। এদিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এমন এক সময়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন যখন অধিকাংশ জাতীয় নেতাদের মনে ভারতের শিল্পায়নের বিষয় মাথায় এসেছিল। তবে প্রশ্ন উঠেছিল, ভারতে শিল্পায়ন হবে কোন পথে? বহু নেতা খাদি ও কুটির শিল্পের দিকে ঝুঁকে থাকলেও এর পাশাপাশি সুভাষচন্দ্র বৃহৎ ও যন্ত্রশিল্পের মাধ্যমে শিল্পায়নের দিকেও জোর দিতে চেয়েছিলেন।

১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সভাপতির ভাষণে স্বাধীন ভারতের জন্য যে নীল নকশা তুলে ধরেছিলেন, তাতে জাতীয় পুনর্গঠন এবং জাতীয় পরিকল্পনার বিষয়ে ধারণাই দেওয়া হয়েছিল। এরপর নেতাজি ১৯৩৮ সালের ২ অক্টোবর, দিল্লিতে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রীদের সম্মেলনে দেওয়া প্রদত্ত ভাষণে তঁার জাতীয় পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণার রূপরেখা তুলে ধরেন। এইভাবে নেতাজি জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠনের দিকে এগিয়ে যান, যা তিনি ১৯৩৮ সালে ১৭ ডিসেম্বর বোম্বাইতে (অধুনা মুম্বই) উদ্বোধন করেন।

তবে তার আগে ১৯৩৮ সালের ২১ আগস্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে নেতাজি জাতীয় পুনর্গঠনের সমস্যাগুলি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘আমাদের যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে তা হল শিল্প পুনরুদ্ধার নয়, বরং শিল্পায়ন। ভারত এখনও রয়েছে প্রাক-শিল্প পর্যায়ে। যতক্ষণ না আমরা একটি শিল্প বিপ্লবের পথ অতিক্রম করি ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও শিল্প অগ্রগতি সম্ভব নয়।… প্রথমেই নির্ধারণ করতে হবে যে এই বিপ্লব, অর্থাৎ শিল্পায়ন, গ্রেট ব্রিটেনের মতোই ক্রম বিবর্তনের পথে আসবে, নাকি সোভিয়েত রাশিয়ার মতো বাধ্যতার দ্রুত পথে এগিয়ে আসবে।’

হরিপুরা অধিবেশন এবং পরবর্তীকালে ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অনুমোদন পাওয়ার পর, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিশাল সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, তিনি সরকারি ফোরাম ব্যবহার করে জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তৎকালীন এই উপমহাদেশ ব্রিটিশ ভারত এবং ভারতীয় শাসিত রাজ্যে বিভক্ত ছিল। জাতীয় পরিকল্পনার ধারণার কথা
বলার সময়, নেতাজি মনে মনে নিশ্চিত ছিলেন যে, পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় ব্রিটিশ ভারতের সমস্ত প্রদেশের পাশাপাশি সমস্ত ভারতীয় রাজ্যকেও এর আওতায় আনতে হবে। তিনি যখন কংগ্রেসশাসিত সাতটি প্রদেশের সরকারের কাছে তঁার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন, তখন একই সঙ্গে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেসশাসিত নয় এমন ব্রিটিশ ভারতীয় রাজ্যগুলিকে ও ভারতীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত রাজ্যগুলিকেও এই পরিকল্পনা আওতায় আনা, যাতে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একত্রিত করে ভারতের পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করা যায়।  

[আরও পড়ুন: শুরুর আগেই শেষ, বায়োপিক ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’ থেকে সরে দাঁড়ালেন শোয়েব]

নেতাজি সভাপতি হওয়ার আগে ১৯৩৭ সালে ওয়ার্ধায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে শুধুমাত্র একটি শিল্প পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল, যেখানে সুভাষচন্দ্র জাতীয় পরিকল্পনার ধারণায় দ্রুত শিল্পায়নের প্রয়োজনের পাশাপাশি দারিদ্র‌ ও বেকারত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা এবং জাতীয় পুনর্গঠনের ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন।

জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির প্রথম সভার স্থান হিসাবে বোম্বাইকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। যেহেতু বোম্বাই প্রদেশের তৎকালীন সরকারের জন্য পরিকাঠামোগত সহায়তা প্রদান করবে বলে আশা করা হয়েছিল। জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির প্রথম বৈঠকটি নেতাজি উদ্বোধন করেন এবং সেখানে সভাপতিত্ব করেন জওহরলাল নেহরু। ওই সময় নেতাজি নেহরুকে জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির চেয়ারম্যান করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩৮ সালের ১৯ অক্টোবর একটি চিঠিতে জওহরলাল নেহরুকে চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব দিয়ে নেতাজি লিখেছিলেন, ‘আমি আশা করি আপনি পরিকল্পনা কমিটির চেয়ারম্যান পদটি গ্রহণ করবেন। এটিকে সফল করতে হলে আপনাকে অবশ্যই থাকতে হবে।’

 কংগ্রেস সভাপতি এবং জাতীয় পরিকল্পনার ঐতিহাসিক ঘটনাটির স্থপতি হিসাবে নেতাজি নিজে প্রথম চেয়ারম্যান হতেই পারতেন। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন, এই পরিকল্পনা সফল করতে ঐকমত্য হওয়া আবশ্যিক। ঘটনাচক্রে সুভাষচন্দ্র যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তখন জাতীয় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আদর্শগত দিক থেকে মতবিরোধ দেখা যাচ্ছিল দলের অন্দরে। সেক্ষেত্রে সকলকে সঙ্গে নিয়ে যেতে এবং ভারতে পরিকল্পনা ও শিল্পায়নের বীজ উর্বর জমিতে বপন করার উদ্দেশ্যে সুভাষচন্দ্র প্রথম জাতীয় পরিকল্পনা কমিটিতে নিজেকে শীর্ষে বসাতে চাননি, যদিও কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে মূলত তঁার উদ্যোগেই ওই কমিটি গঠন সম্ভব হয়েছিল৷

কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র বুঝেছিলেন স্বাধীনতা বেশি দূরে নয়। তাই স্বাধীন ভারত সরকারের কথা ভেবে পরিকল্পনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। সেই লক্ষ্য অর্জনের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। স্বাধীনতার প্রাক্কালে, ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে, অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক জাতীয় পর্যায়ে একটি উপদেষ্টা পরিকল্পনা বোর্ড গঠন করা হয়, যা স্বাধীন ভারতে পরিকল্পনা কমিশন গঠনের পথ প্রশস্ত করে। যদিও পরবর্তীকালে ২০১৪ সালে মোদি সরকার ‘পরিকল্পনা কমিশন’ তুলে
দেয় এবং বদলে ‘নীতি আয়োগ’ গঠন করা হয়। 

(মতামত নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement