বিশ্বদীপ দে: নজরুল আমাদের রক্তের ভিতরে মিশে রয়েছেন আলোয় উদ্ভাসিত এক অমল উত্তরাধিকার হয়ে। কবি লিখেছিলেন, ‘রাজার বাণী বুদ্বুদ্, আমার বাণী সীমাহারা সমুদ্র।’ সেই সমুদ্র বাঙালির চেতনায় জেগে রয়েছে এই অন্ধকার সময়েও। ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ নিয়ে বিতর্ক নতুন করে তা বুঝিয়ে দিচ্ছে।
এ আর রহমান গোটা দেশের মতো এখানেও প্রবল জনপ্রিয়। সেই ‘রোজা’ থেকেই তাঁর সুরের জাদু বঙ্গদেশেও একই রকম ভাবে ছড়িয়ে গিয়েছে। সেই মানুষটিই এমন ভাবে নজরুলের গানকে বিকৃত করায় অসন্তুষ্টি, ক্ষোভ বেড়েই চলেছে। ‘পিপ্পা’ নামের এক ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে নজরুলের (Nazrul Islam) গানটি। যে রহমান (A R Rahman) ‘বন্দে মাতরম’ কিংবা ‘জয় হো’ সৃষ্টি করেছেন, রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ত যথা ভয় শূন্য’ কবিতায় সুর দিয়েছেন, তিনি কেন নজরুলের গানটির স্পিরিট বুঝতে পারলেন না প্রশ্ন উঠছে। তিনি কি খোঁজ পাননি এই গানের পিছনে রয়েছে কোন দৃপ্ত ইতিহাস? যা আজও রোমকূপে আগুনের নেশা ধরিয়ে দেয়!
নজরুল লিখিত এই গানটির নাম ‘ভাঙার গান’। যা তাঁর ১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের একেবারে শুরুতেই রয়েছে। যে বইটির প্রথম সংস্করণ ব্রিটিশদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল প্রকাশের পর থেকেই। দ্রুত বাজেয়াপ্ত করা হয় বইটি। নিষিদ্ধও করা হয়েছিল। যা জারি ছিল প্রায় আড়াই দশক। ১৯৪৯ সালে স্বাধীন ভারতে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ।
তবে তারও আগে ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘ভাঙার গান’। সেই সময় চিত্তরঞ্জন দাশ কারাবন্দি। তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে খানিকক্ষণের মধ্যেই অবিস্মরণীয় গানটি লিখে গেয়ে শুনিয়ে দিয়েছিলেন নজরুল। সেই গানে নজরুল আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘লাথি মার, ভাঙ রে তালা!/ যত সব বন্দী-শালায়-/ আগুন জ্বালা,/ আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি!’ এই ডাক সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে জেগে ওঠা দেশপ্রেমের তরঙ্গকে আরও বহু গুণ বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।
আসলে প্রথম থেকেই বাংলার কাব্য জগতে নজরুল ছিলেন প্রকৃত প্রস্তাবেই এক ‘রকস্টার’! মাত্র ২২ বছরের এক তরুণের কলম সেদিন রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল বিপ্লবীদের। খোদ চিত্তরঞ্জন না হলে জেলের ভিতরে বসে গেয়ে ওঠেন ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’!
একশো বছরেরও বেশি সময় আগে লেখা গানটি আজও একই রকম ‘জীবন্ত’। এই গানের যে তীব্রতা, সেটাই এর মূল স্পিরিট। যে দুর্দম চেতনার কথা বলে এই গান, তা যেন স্বাধীনতা সংগ্রামী বাঙালির ইতিহাসকে ধারণ করে রেখেছে। সেই গানকে এমন মিহি রোম্যান্টিক মেজাজে কেন যে ব্যবহার করলেন রহমান সাহেব, তা ভেবে ওঠাই দুষ্কর। এ গান তো যে কোনও গান নয়! তাঁর রিসার্চ টিম তাঁকে হদিশ দিতে পারল না এমন বিখ্যাত এক গানের?
নজরুলের দুর্ভাগ্য, সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর নাম উঠে এসেছে কোনও না কোনও বিতর্কে। গত মে মাসের কথা। নবদ্বীপের রাধারাণী মন্দিরের হিন্দু নাটমন্দিরে আয়োজিত হয়েছিল একটি রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা। সেখানে নজরুলের ছবি রাখা যাবে না– এমনই আপত্তি নাকি জানিয়েছিল খোদ মন্দির কমিটি! শুরু হয়েছিল বিতর্ক। এবার রহমানের সুরকে কেন্দ্র করে ফের বিতর্ক ঘনিয়েছে। এই বিক্ষোভের মধ্যেও তা যেন এক অন্য প্রশান্তির বার্তাও দিয়ে যায়। ক্রমশ আত্মবিস্মৃতির পথে হেঁটে চলা বাঙালি আজও তবে তাঁর প্রিয় নায়কের অপমানে প্রতিবাদের আগুনে জ্বলে ওঠে! ১৯৪৯ সালে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো নজরুল’। এই অমোঘ উচ্চারণেই ধরা আছে বাঙালির কাছে নজরুলের আসল ছবিটা। গত কয়েক দশকে আমূল বদলেছে বাঙালি। কিন্তু তার নজরুল-প্রেম এতটুকুও বদলায়নি। এই অস্থির সময়ে সেটাই যেন সান্ত্বনার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.