Advertisement
Advertisement

Breaking News

মিডিয়া তাঁর কাছে নিষ্প্রয়োজন, কেন বললেন প্রধানমন্ত্রী?

যেখানে দায়বদ্ধতা নেই, সেখানে জবাবদিহির বাধ্যবাধকতাও নেই।

National Media and PM Modi

ফাইল চিত্র।

Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:May 22, 2024 8:31 pm
  • Updated:May 22, 2024 8:31 pm  

সম্প্রতি অনুগত এক নিউজ চ্যানেলের চার সাংবাদিককে প্রধানমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, তিনি একমাত্র সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। যেখানে দায়বদ্ধতা নেই, সেখানে জবাবদিহির বাধ্যবাধকতাও নেই। তাই ঘটা করে সাংবাদিক সম্মেলন তিনি ডাকেন না। মিডিয়া তাঁর কাছে নিষ্প্রয়োজন। দরকারে মিডিয়া তাঁকে খুঁজে নেবে। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

মাঝে মাঝে ভাবি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বোধহয় দেশের অধিকাংশ মানুষকে বোকা ভাবেন। অথবা মনে করেন, সবাই তঁার ‘অন্ধভক্ত’। যা বোঝাবেন তা-ই বুঝবে। প্রশ্নহীন। তা না হলে দশ বছরে একবারও তিনি কেন সাংবাদিক সম্মেলন করেননি, তার এমন আজগুবি ও হাস্যকর যুক্তি দিতেন না। ভোট চলাকালীন অনুগত এক নিউজ চ্যানেলের পরিচিত চার ‘অন্ধভক্ত’ সাংবাদিককে সেই ব্যাখ্যা শুনিয়ে বলেছেন, তিনি একমাত্র সংসদের কাছেই দায়বদ্ধ। অর্থাৎ, আর কারও কাছে জবাবদিহিতে তিনি বাধ্য নন। যেখানে দায়বদ্ধতা নেই, সেখানে বাধ্যবাধকতাও নেই। তাই ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন ডেকে গুচ্ছের সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দেন না।

Advertisement

সে যাই হোক, সাংবাদিক সম্মেলন কেন করেন না দশ বছরে– এই প্রথম সে নিয়ে কিছু অন্তত তঁার মুখ থেকে শোনা গেল। এই-বা কম কী? তবে হঁ‌্যা, তা করতে গিয়ে তিনি এমন সব কথা বলেছেন, যা আগে বলেননি। তার সঙ্গে সংবাদ সম্মেলন না করার কোনও সম্পর্ক যদিও নেই। যেমন, তিনি বলেছেন, ইদানীং সংবাদপত্র
ও সাংবাদিকদের চরিত্র পুরো বদলে গিয়েছে। এখনকার সাংবাদিকতা নিরপেক্ষ নয়। পক্ষপাতদুষ্ট।

 

[আরও পড়ুন: শাহ-যোগী ‘বিভেদ’ উসকে দেওয়ার কৌশল, দিল্লি জয়ে নয়া চাল কেজরির

সাংবাদিকরা প্রত্যেকেই নিজস্ব অভিমতের মধ্যে আবদ্ধ। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তঁারা কিছু দেখতে চান না। বলতে চান না। লিখতেও চান না। ‘নিরপেক্ষতা’ বলে যে-বিষয়টা আগে (কত আগে তা অবশ্য বলেননি) ছিল, এখন তা নেই। বিষয়টা কীরকম, প্রধানমন্ত্রী সেই উদাহরণও দিয়েছেন। উপস্থিত চার অনুগতের একজনের
নাম করে বলেছেন– যেমন ধরুন, আপনাকে সাক্ষাৎকার দিতে বসলেই লোকে বলবে, ওঃ, অমুক? উনি তো দু’দিন আগে ওই বিষয়ে টুইট করেছিলেন। তিনি তো মোদির পক্ষেই কথা বলবেন!

প্রধানমন্ত্রী এখানেই থেমে থাকেননি। বরং ‘আগেকার’ সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘এখনকার’ সাংবাদিকদের পার্থক্য কেমন সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, আগে মিডিয়া (সাংবাদিকরা) ছিল ‘ফেসলেস’। অবয়বহীন। মানে, কে লিখছেন, তঁার আদর্শ বা রাজনৈতিক মতাদর্শ কী, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। হালে স্পষ্ট বোঝা যায় কার কী আদর্শ। কার রাজনীতি কেমন।

একশ্বাসে এরপর তিনি খোলসা করেছেন তঁার নীতি। বলেছেন, কিছু বছর আগেও ধারণা ছিল, মিডিয়াকে হাতে রাখলেই সব হয়ে যায়। মিডিয়াকে কিছু জানিয়ে দিলেই সারা দেশে তা ছড়িয়ে যাবে। তারাই প্রচার করে দেবে। কিন্তু তিনি সে রাস্তায় হঁাটেননি। তঁার কথায়, ‘আমি এক অন্য সংস্কৃতি তৈরি করেছি। খাটতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে। গরিবের কাছে যেতে হবে। আমি তো বিজ্ঞান ভবনে ফিতে কেটে ছবি তুলে মিডিয়া মারফত প্রচার করে, দিন কাটাতে পারতাম। কিন্তু তা না করে আমি ঝাড়খণ্ডের অনামী গ্রামে গিয়ে ছোট প্রকল্পের জন্য কাজ করেছি। এটাই নতুন সংস্কৃতি। আমার কাজ মিডিয়ার পছন্দ হলে প্রচার করবে, না চাইলে করবে না।’
মোদ্দাকথা তাহলে কী? কী বোঝাতে
চাইলেন প্রধানমন্ত্রী?
এক, তিনি স্রেফ সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। তাই অন্য কোথাও জবাবদিহি করেন না। দুই, এখনকার সাংবাদিকরা ‘নিরপেক্ষ’ নন। তাই তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করেন না। তিন, মিডিয়াকে তঁার প্রয়োজন নেই। মিডিয়ার তঁাকে প্রয়োজন হলে সেটা তাদের বিষয়। তিনি আরও বুঝিয়েছেন, আগে মিডিয়া বলতে ছিল খবরের কাগজ। কাগজ ছাড়া কারও গতি ছিল না। সেটাই ছিল যোগাযোগের একমাত্র উপায়। সেই যোগাযোগ ছিল একমুখী। এখন বিভিন্ন মাধ্যমের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। সেসব মাধ্যমের সাহায্যে জনতাও তার আওয়াজ পৌঁছে দিচ্ছে। যে কোনও বিষয়ে মতামত জানাতে পারছে। ‘কমিউনিকেট’ করার অনেক পন্থা
রয়েছে এখন। তিনি তা ব্যবহার করেন। তাই ‘মিডিয়া’-কে বিশেষ পাত্তা দেন না। তাই সাংবাদিক সম্মেলনও করেন না।

 

[আরও পড়ুন: ধর্মীয় লাইনে প্রচার নয়, পাঁচ দফা ভোটের পর বিজেপিকে নির্দেশ কমিশনের, সতর্কবার্তা কংগ্রেসকেও

চার-চারজন সাংবাদিক ওই মোদি-ভাষ্য শুনে গেলেন বিনা বাক্যে। কেউ পাল্টা প্রশ্ন তুললেন না। যেমন জানতে চাইলেন না, তঁার কাছে শুরু থেকেই ‘মিডিয়া’ যদি এত গুরুত্বহীন হয়ে থাকে, তাহলে ২০১৪-এ ক্ষমতায় এসে সাড়ে চার বছরে কেন তঁার সরকার পঁাচ হাজার কোটি টাকা সরকারি বিজ্ঞাপনে খরচ করেছে– যে টাকা মনমোহন সিং খরচ করেছেন তঁার দশ বছরের রাজত্বে? কেন কেউ তঁাকে বললেন না, এই হিসাব তঁারই সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের অধীন ‘ব্যুরো অফ আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন’-এর দেওয়া।

২০১৮ সালের অক্টোবরে। দ্বিতীয় হিসাবটা তারও পঁাচ বছর পর, ২০২৩ সালের জুলাই মাসের। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক রাজ্যসভায় জানায়, ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর চার বছরে সরকার বিজ্ঞাপন মারফত খরচ করেছে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি। সবচেয়ে বেশি পেয়েছে প্রিন্ট মিডিয়া।
১ হাজার ৩৩৮ কোটি। তারপর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, ১ হাজার ২৭৩ কোটি। আর আউটডোর পাবলিসিটি হয়েছে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার। সরকারি বিজ্ঞাপনের এই গুড় যারা চেটেপুটে খেয়েছে– এখন তারাই ‘গোদি মিডিয়া’ নামে পরিচিত।

আমার জানতে বড় ইচ্ছা হয়, মিডিয়াকে প্রয়োজন যদি না-ই হয়, তাহলে কেন ভোটের মুখে তিনি ও তঁার ‘ম্যান ফ্রাইডে’ অমিত শাহ মিডিয়ার মুখোমুখি হন? তঁাদের ইন্টারভিউ নেন যঁারা, তঁারা কেন প্রশ্নের পিঠে পাল্টা প্রশ্ন করেন না? তঁারা কি শুধু কথায় কথায় ‘বাঃ বাঃ’ বলতেই ওস্তাদ?

প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এসব সাক্ষাৎকারের আবার মেলা ফ্যাচাং ও শর্ত। প্রশ্নাবলি আগে থেকে পাঠিয়ে দিতে হয়। অপছন্দের প্রশ্ন পিএমও বাদ দিতে বাধ্য করবে। ‘সিলেবাসের (স্ক্রিপ্ট) বাইরে’ পাল্টা প্রশ্নের অধিকার নেই। যে কোনও সাক্ষাৎকার শুনলেই তা বোঝা যায়। প্রিন্ট ও টেলিভিশন সর্বত্র এমনই শর্ত। ভরসার সাংবাদিক ছাড়া প্রধানমন্ত্রী মোদি এখনও পর্যন্ত কাউকে ইন্টারভিউ দেননি। ২০০৭ সালে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সাংবাদিক করণ থাপারের সঙ্গে কী হয়েছিল দুনিয়া তা জানে। করণের ‘অপরাধ’, গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে তিনি এমন সব প্রশ্ন করছিলেন, যা নরেন্দ্র মোদি পছন্দ করেননি।

২ মিনিট ৪১ সেকেন্ড কথোপকথনের পর স্টুডিও ছেড়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন। ৩ মিনিট ২৩ সেকেন্ডের সেই বিখ্যাত ভিডিও এখনও ইউটিউবে রয়ে গিয়েছে। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক মোদি তা চান না।
প্রধানমন্ত্রী শুধুমাত্র সংসদের কাছে দায়বদ্ধতার কথা শুনিয়েছেন। অথচ দশ বছরে একবারের জন্যও সেই দায়িত্ব পালন করেননি। একদিনের জন্যও সংসদে তোলা কোনও প্রশ্নের উত্তর দেননি। বিতর্কিত, অপছন্দের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন অবলীলায়। লোকসভায় রাহুল গান্ধীর তোলা ‘আদানি’ প্রশ্নাবলি তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ।

এমন ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রী’-কে ভারতবাসী কি আরও একবার সুযোগ দিতে চলেছে? প্রশ্নটা প্রতিদিন নতুনভাবে শুনতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে হ্যাটট্রিক নিয়ে একশো ভাগ নিশ্চিত। অন্য ধারণা, এবার পাশার দান ওল্টাবে। এই দুই বিপরীতধর্মী আশার মাঝে নির্বাচনী ফলের সত্যিটা কোথাও লুকিয়ে আছে।

পঁাচ দফা ভোট চুকে গেল হাওয়াহীন। উদ্দীপনাহীন। জ্যৈষ্ঠের প্রবল দাবদাহে বাকি দুই দফার হালও তেমনই হবে বলে অভিমত। বহু বছর পর লোকসভা ভোট হচ্ছে আঞ্চলিক ও রাজ্যভিত্তিক ইস্যুতে। রাজ্যে-রাজ্যে জমিনি বাস্তবতায় শাসকের আসন কমার ইঙ্গিতও স্পষ্ট। কিন্তু সেই আভাস এমন জোরালো নয়, যা পালাবদল ঘটায়। দশ বছর শাসনের পর মোদির নেতৃত্ব ২৫০ আসন এনে দিলে আর যা-ই হোক তাকে ‘বিপর্যয়’ বলা যাবে না। ভোটের আগে ছন্নছাড়া বিরোধী শিবিরের কাছেও তা ‘সাফল্য’ হিসাবেই গণ্য হবে।
সেখান থেকেই শুরু হবে রাজনীতির নতুন প্রবাহ। তা-ই বা মন্দ কী? একঘেয়েমি কেটে একটু নতুনত্ব তো আসবে!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement