সরোজ দরবার: আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছে অমলের কথা। থেকে থেকেই; যেদিন ‘বাইরে’ মুছে গিয়ে কেবল রইলাম সবাই ‘ঘরে’, সেদিন থেকেই যেন কানে বেজে উঠছে, কবিরাজের বারণ। এখন, রাজার চিঠির জন্য অপেক্ষমাণ অমল, আমরা প্রত্যেকেই।
Advertisement
এ কথা ঠিক যে, রবি ঠাকুর যে-কোনো যক্ষপুরীর ভিতরেও একটুখানি আলো দেখার বন্দোবস্ত করে দেন। নন্দিনীর মুখের দিকে যখন তাকাল বিশুপাগল, তখন সে বুঝল, ‘আমার মধ্যে এখনও আলো দেখা যাচ্ছে’। বুঝল, ‘এই বন্ধ গড়ের ভিতরে কেবল তোমার-আমার মাঝখানটাতেই একখানা আকাশ বেঁচে আছে। বাকি আর-সব বোজা।’ এই আকাশটুকুর অবকাশ প্রত্যেকের জন্য রেখে দেন রবি ঠাকুর। এমনকি যে অমলের বেরতে মানা, তাকেও তো তিনি একটু মনে-মনে ঘুরিয়ে আনেন। কোথাও যে তার হারিয়ে যাওয়ার মানা নেই, সেই কথাটা ফকির তাকে বেশ করে বুঝিয়ে দেন।
ফকির – এতে আশ্চর্য হও কেন? তোমাদের মতো আমাকে পেয়েছ? আমার তো যেতে কোনও খরচ নেই। আমি যেখানে খুশি যেতে পারি। অমল। (হাততালি দিয়া) তোমার ভারি মজা। আমি যখন ভাল হব, তখন তুমি আমাকে চেলা করে নেবে বলেছিলে, মনে আছে ফকির?
ঠাকুরদা – খুব মনে আছে। বেড়াবার এমন সব মন্ত্র শিখিয়ে দেব যে সমুদ্রে পাহাড়ে অরণ্যে কোথাও কিছুতে বাধা দিতে পারবে না।
যেখানে খুশি যাওয়ার আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠা অমলের শেষমেশ আর ফকিরের চেলা হওয়া হয়নি; কিন্তু আমরা কি আজ জানি না যে, হাততালি দিয়ে যেখানে খুশি যাওয়া যেতেই পারে। কারণ, কোথাও হারিয়ে যাওয়ার মানা অন্তত আমাদের জন্য দস্তুর নয়, যেহেতু আমাদের একজন রবি ঠাকুর আছেন।
আসলে রবি ঠাকুরের সঙ্গে ব্যক্তিগত চিঠি চালাচালির একটা গোপন ডাকঘর আমাদের প্রত্যেকেরই আছে। যে কোনও বন্দিদশাতেই সেখানে একটা চিঠি আসে। খাম খুললে আমরা পেয়ে যাই বেরিয়ে আসার সেই আশ্চর্য মন্ত্র। আমাদের মনে পড়ে, এক তরুণ তাঁর ফুলশয্যার রাতে নবপরিণীতা বধূটির কাছে শুনতে চেয়েছিল- জীবন মরণের সীমানা পেরিয়ে, বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে। এ কি বিয়ের রাতে শোনার মতো গান! বধূ তবু গাইলেন, একবার নয়, দু’বার। বহুদিন পর, যখন আর তিনি নববধূটি নন, তখন জানতে চাইলেন, কেন এমন দিনে এই গান শোনার অনুরোধ ছিল? শাহাদুজ্জামান আমাদের জানান, জীবনানন্দ দাশ সেদিন স্ত্রীকে বলেছিলেন, ওই যে দুটি পঙক্তি – ‘আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া/ তোমার বীণা হতে আসিল নামিয়া’ – এ তো যে কোনও শুভারম্ভেরই গান হওয়া উচিৎ।
কিন্তু শুধুই কি তাই? তরুণ জীবনানন্দ সেদিন কি তাঁর প্রথম প্রণয়ে ব্যর্থতার বেদনাটিকে গোপন করতে চাননি? একদিকে সেই রক্তক্ষরণ গোপন করে বিবাহ, অন্যদিকে বিবাহের আসরেই সেই প্রথমা রমণীর উচ্ছল-উজ্জ্বল উপস্থিতি সেদিনের জীবনানন্দকে এক অলক্ষ্য কারাগারে কি বন্দি করে ফেলেনি! সেই বন্দিদশা থেকে তাকে কে মুক্তি দিতে পারেন! প্রথম কাব্যগ্রন্থ যাঁর কাছে পাঠিয়ে তিনি কিঞ্চিৎ তিরস্কৃত হয়েছিলেন, এবং নিজের কাব্যবোধ দিয়ে যাঁর যুক্তি ছত্রে ছত্রে খণ্ডন করেছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথের মন্ত্রই কি সেদিন জীবনানন্দকে মুক্তি দেয়নি! একটুখানি আকাশ দেখার যদি অবকাশ যদি কোথাও থেকে থাকে তবে ওই গানে। রবি ঠাকুরের গানেই।
হিটলারের বাহিনী যেদিন ইহুদি হওয়ার অবরাধে ইয়ানুশ কোর্চাকের অনাথ আশ্রমকে দখল করেছিল, তখন ইয়ানুশ জানতেন কী পরিণতি হতে চলেছে তাঁদের। অথচ অতগুলো ফুটফুটে নিষ্পাপ বাচ্চা। তাদের বিশ্বাসের পৃথিবী কেমন করে নষ্ট করবেন তিনি! কেমন করে বলবেন যে, ভয়াবহ এক পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে সকলে; ইয়ানুশ জানতেন, সেই বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়ার মনের জোর বাচ্চাদের থাকা উচিৎ। কিন্তু কী উপায়ে! সহায় হলেন রবি ঠাকুর। ইয়ানুশ বেছে নিয়েছিলেন ডাকঘর নাটকটিকে। বাচ্চাদের নিয়ে হইহই করে মঞ্চস্থ করেছিলেন সে-নাটক। কেন? সেদিন সেই দমবন্ধ পরিস্থিতিতে বন্দি অমলরা অন্তত এটুকু আশ্বাস পেয়েছিল, যে, বন্দিদশাই শেষ কথা নয়। বাইরে এক মুক্তির পৃথিবী অপেক্ষায় আছে। একদিন-না-একদিন রাজার চিঠি আসবেই। যেমনটা অমলকে বোঝাত তার বন্ধু, ফকির। যেমনটা সেদিন পোল্যাণ্ডের বাচ্চাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ইয়ানুশ। হয়তো এ কথা তাঁকে বুঝিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথই। ইতিহাস বলবে, ইয়ানুশ বাচ্চাদের বাঁচাতে পারেননি। নিজেও বাঁচেননি। কিন্তু সেই বদ্ধ পৃথিবীর বাইরের যে পৃথিবী, যে রাজার চিঠি আসার কথা ছিল, ভাবীকাল তা-ও প্রত্যক্ষ করেছিল। আর কেউ না হোক, রবি ঠাকুর জানান বলেই, নন্দিনী দৃঢ় প্রত্যয়ে ঘোষণা করতে পারে, রঞ্জন আসবেই। আর, সে যেখানেই যায়, ছুটি নিয়ে আসে।
যখন ব্যক্তিশোক কি অবসাদে নিজের ভিতরটাই একটা কারাগার হয়ে যায়, তখনও কি আসে না রবি ঠাকুরের চিঠি! নিজের জীবনে শোক তো তিনি কম পাননি! সেই শোকের গণ্ডি ভেঙে বেরনোর মন্ত্র তিনি নিজেই নিজেকে অন্তত শুনিয়েছিলেন, জানান আবু সয়ীদ আইয়ুব, রবীন্দ্রনাথেরই একটি বিস্মৃতপ্রায় কবিতার উল্লেখ করে। স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর তখন মৃত্যু হয়েছে। চোখে অন্ধকার দেখছেন যেন; কোথাও কোনও কিছুতে সান্ত্বনা খুঁজে পান না। সেদিন নিজেই নিজেকে ডেকে কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘তোমার চরণে নাহি তো লৌহডোর।/ সকল মেঘের ঊর্ধ্বে যাও গো উড়িয়া,/ সেথা ঢালো তান বিমল শূন্য জুড়িয়া-’।
গণ্ডিবদ্ধ হয়েও এই দূরে তাকানোর মন্ত্রই তো শিখিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ। সর্বত্র। ইন্দিরা দেবীকে একবার এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সুখের চেষ্টা এবং দুঃখের পরিহার এই আমাদের ক্ষণিক জীবনের প্রধান নিয়ম; কিন্তু এক-একটা সময় আসে যখন আমরা আবিষ্কার করতে পারি যে, আমাদের ভিতরে এমন একটা জায়গা আছে যেখানে সে নিয়ম খাটে না- যেখানে দুঃখ দুঃখই নয় এবং সুখ একটা উদ্দেশ্যের মধ্যে গণ্যই হয় না- সেখানে আমরা সমস্ত ক্ষুদ্র নিয়মের অতীত, স্বাধীন।’ এই হল এক ভিতরের দিকের স্বাধীনতা, মুক্তি; কোনও বন্ধনই এর কাছে যথেষ্ট নয়। বরং বন্ধন যত দৃঢ় হবে, এই মুক্তির বাসনা তত বেশি।
অমলকেও তো ফকির শুনিয়েছিল সেই ‘হালকা দেশের’ কথা। যেখানে ভার নেই। সে-দেশে কোন দিক দিয়ে যাওয়া যায়? না, ভিতরের দিকের রাস্তা ধরে। এবং তা খুঁজে পাওয়া মোটেও শক্ত নয়। যদি ওই ছন্দটি খুঁজে পাওয়া যায়। নিজের জালে আটকে পড়া যক্ষপুরীর রাজামাত্রই জানে, ‘সেই ছন্দে বস্তুর বিপুল ভার হালকা হয়ে যায়। সেই ছন্দে গ্রহনক্ষত্রের দল ভিখারি নটবালকের মতো আকাশে আকাশে নেচে বেড়াচ্ছে।’ কিন্তু সেই ছন্দ আয়ত্তে নেই বলেই, নন্দিনীকে ঈর্ষা করা ছাড়া তার আর কোনও গতি থাকে না।
আজ আমরাও যখন বাহ্যত বন্দি এবং অন্তরেও – ক্লেদ ও কিন্নতা – যখন আমাদের গণ্ডি বেঁধে ছোট করে দিচ্ছে অহরহ, তখন কোথা থেকে আয়ত্ত করব ওই ছন্দ? কোন মন্ত্রবলে বস্তুর বিপুল ভার হালকা হবে, আর, আমরা পৌঁছে যাব হালকার দেশে? যেখানে একটু লাফ দিলেই অমনি পাহাড় ডিঙিয়ে চলে যাওয়া যায়? তখনই এসে দাঁড়ান গণ্ডি কাটার মন্ত্র শেখানোর ফকির – রবীন্দ্রনাথ। হাতে তাঁর গানের ডালি। শঙ্খবাবু আমাদের জানান, রবীন্দ্রনাথের গানই বস্তুত আমাদের নিয়ে যায় দৈনন্দিনের বাইরে, ‘ভারহীন অদীন ভুবনে’। সেখানে সমস্ত কৃত্রিমতা আর ভণিতার অবসান। সমস্ত মিথ্যের ক্লান্তি নামিয়ে রাখা যায় অনায়াসে। এই সেই হালকার দেশ, যেখানে হারিয়ে যাওয়া যায় অনায়াসে। তখন কে বলে আমরা বন্দি! কোথাও হারিয়ে যাওয়ার মানা অন্তত আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কারণ আমাদের আছে রবি ঠাকুর; আছে রবি ঠাকুরের গান। আর, আমাদের সেই আশ্চর্য
ডাকঘরের নাম – গীতবিতান।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.