Advertisement
Advertisement

সম্পাদকীয়: মোদির সপ্তম, বিরোধী স্বরও সপ্তমে

কুসুমকোমল পথ অনায়াসে পার হয়ে এই প্রথমবারের মতো তিনি থমকেছেন।

Narendra Modi's invincibility cloak sustains damage | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:May 26, 2021 4:22 pm
  • Updated:May 26, 2021 4:22 pm  

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: আজ ২৬ মে। সাত বছর আগে, ২০১৪ সালের এই দিনে, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কুসুমকোমল পথ অনায়াসে পার হয়ে এই প্রথমবারের মতো তিনি থমকেছেন। দুশ্চিন্তার আঁকিবুঁকি তাঁর মুখাবয়বে। আচরণে। শরীরী ভাষায়। গভীরতর বলিরেখায়। এমন ক্ষুরধার চ্যালেঞ্জ এতদিন অদৃশ্য ছিল। নিঃসঙ্গ নিশ্চিতই তিনি নন। দল ও সরকারের উপর যে-কর্তৃত্ব এতদিন কায়েম রেখেছেন, এমন নয় যে, তা শিথিল হয়েছে। কিন্তু সত্য এই, দেশবাসীর সামনে মায়াময় যে-মোহজাল বিছিয়ে নিজেকে সব ধরাছোঁয়ার হাত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাজপাট সামলাচ্ছিলেন, সযত্নে গড়ে তুলেছিলেন যে-ভাবমূর্তি- আজ তা মলিন হয়ে তাঁকে পরিহাস করছে যেন! অসহায়তার প্রতীক এই নরেন্দ্র মোদি এতদিন দৃশ্যমান ছিলেন না।

[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: ‘নিরাশা’ না ‘জুঁই’ ঝড়ের কাছে কার ঠিকানা]

কোভিড নামক সংকট মাত্র একবছরে ছবিটা কীভাবে বদলে দিল, ভাবলে অমোঘ সেই আপ্তবাক্য মনে পড়ে যায়, ‘পরিবর্তনই একমাত্র চিরন্তন’। পরিবর্তনের সেই রূপ কী বিচিত্র, তা-ও ভেবে চলেছি। একবছর আগে যাঁর আহ্বানে প্রশ্নহীন আসমুদ্রহিমাচল থালা-বাসন বাজিয়েছিল, উদ্বেলিত হয়েছিল, আজ তিনিই পরিহাস ও করুণার পাত্র! কটূক্তি ও কটাক্ষের ভাণ্ডার আজ নিত্য পূর্ণ হচ্ছে তাঁর। দেশে তো বটেই, বিদেশেও আজ তিনি উপহাসের পাত্র। পরিবর্তন কীভাবে সর্বগ্রাসী হয়, তা-ও দেখার। এতদিন ধরে যাবতীয় সমালোচনা হেলায় উড়িয়ে তাঁকে রক্ষা করতে পাত্র-অমাত্য যারা মুখিয়ে থাকত, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের বন্যা বইয়ে দিত, আজ তারাও স্তিমিত। কোথায় যেন বড় হয়ে জেগে উঠেছে বিশ্বাসের অভাব। সপ্তম বর্ষপূর্তির আনন্দ অনুষ্ঠানে শামিল না হয়ে জনতার পাশে দাঁড়ানোর যে-নিদান আজ দেওয়া হচ্ছে, সাত বছরের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরতে বলা হচ্ছে, সেখানেও আস্থার অভাব। আয়নায় নিজেকে দেখে নরেন্দ্র মোদিও সম্ভবত আজ অবাক হচ্ছেন। ভাবছেন, পরিবর্তন এমন নিষ্ঠুর ও এত দ্রুত হয়?

Advertisement

নিঃসাড়, নিরুচ্চার ও কটাক্ষপূর্ণ এহেন বর্ষপূর্তির জন্য মোদি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দায়ী করতে পারবেন না। এতদিন সব কৃতিত্ব যেমন নিজে নিয়ে এসেছেন, ব্যর্থতার দায়ও তাঁরই একান্ত। ‘কুম্ভীরাশ্রু’ কটাক্ষের অপরাধীও তিনি।

হারার আগে হারতে কেই-বা চায়? কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক তাই সরকারি সাফল্যের খতিয়ান তৈরি করেছে। নির্দেশ গিয়েছে তা প্রচারের। গৃহবন্দি কর্মীদের সেজন্য প্রকাশ্যে আসতে বলা হয়েছে। ‘নতুন ভারতের উত্থান’ ও ‘নতুন ভারত নির্মাণ’-এর সাফল্য হিসাবে যা যা চিত্রিত, বিজেপির কোর অ্যাজেন্ডাগুলোই সেখানে জ্বলজ্বল করছে। অযোধ্যায় রাম মন্দির, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল, তিন তালাক আইন, করতারপুর ও কাশী-বিশ্বনাথ করিডর এবং নাগরিকত্ব সংশোধন আইন। সাত বছর আগে শোনানো ‘অচ্ছে দিন’ উপাখ্যান ওখানেই শেষ। সেই সঙ্গে দেখানো হয়েছে নতুন স্বপ্ন, যা কিনা ‘এক দেশ, এক বিধান, এক নিশান’-এর সঙ্গে একদিন ‘এক দল, এক নেতা’ তত্ত্বকেও প্রতিষ্ঠা করবে। সেগুলোই নাকি নরেন্দ্র মোদির ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার ভিত, যে-আয়নায় প্রতিভাত হবে তাঁর স্বপ্নের ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’!

কিন্তু মানুষ সেখানে কোথায়? কোথায় সাধারণের পছন্দ-অপছন্দ? ভাল-মন্দ? জীবন ও জীবিকা? প্রাণরক্ষার রসদ? ছ’বছর তরতরিয়ে এগনোর পর কোভিডাক্রান্ত ভারত, তার অগণিত জনতা আজ এই প্রশ্নেই বিদ্ধ করছে দেশের ‘প্রধান সেবক’-কে। উপেক্ষা ও অবজ্ঞার কোনও উপায়ই আর নেই! নেই, কেননা, সাধারণের কথা ভেবে দেশ চালনার ক্ষমতা ও দক্ষতা যে তাঁর ছিল না, স্কোরবোর্ডের মতো সাত বছরের পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। যেমন, অর্থনীতি। সাত বছর আগে ক্ষমতালাভের সময় উত্তরাধিকার-সূত্রে আট শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির যে-হার পেয়েছিলেন, বছর-বছর তা কমেছে। তবু ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন। প্রবৃদ্ধির হারে ভারত আজ এশিয়ার ১৪টি দেশের মধ্যে সবার নিচে। অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতকে ছাপিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ ও মায়ানমার। কোভিডের ছোবলে প্রতি ১০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ভারতের মৃত্যুর হারও সবার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে মৃত্যু যেখানে ৭৪ জনের, ভারতে সেখানে ২১২। অথচ প্রধান সেবক দম্ভের সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন, টিকা উৎপাদনে ভারত বিশ্বে প্রথম! রিজার্ভ ব্যাংক জানিয়েছে, গত সাত বছরে ভারতে প্রথমবার মূল্যবৃদ্ধির হার ছয় শতাংশ পার হয়েছে। চলতি আর্থিক বছরেও তার পাঁচ শতাংশের নিচে নামার কোনও লক্ষণ নেই। অথচ সত্য হল, সাত বছর আগে মনমোহন সিংয়ের হাত থেকে মোদির ক্ষমতা গ্রহণের সময় ভারতের গায়ে ছিল বিশ্বের দ্রুততম আর্থিক বৃদ্ধির তকমা!

খুব খুঁটিয়ে এই সাত বছরের সাফল্যের তালিকায় চোখ বোলাতে চাইছি। স্বচ্ছ ভারত, উজ্জ্বলা যোজনা ও প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাইরে সাধারণ মানুষের সরাসরি উপকৃত হওয়ার মতো আর কিছু চোখে পড়ছে না। ‘জনধন প্রকল্প’-র যে কাজ মনমোহন সিং শুরু করেছিলেন, মোদি সরকার তাতে গতি এনেছে। এর বাইরে ‘স্কিল ইন্ডিয়া’, ‘স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া’, খানদুয়েক বিমা যোজনা, ‘আয়ুষ্মান ভারত’ বা মুদ্রা ব্যাংক নিয়ে প্রচার জ্বালানির নিয়মিত দাম বৃদ্ধিতে চাপা পড়েছে। সাধারণ মানুষ তিতিবিরক্ত। পারিষদবৃন্দের ঢক্কানিনাদ ছাপিয়ে যে-প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে, যার উত্তর জানার বিন্দুমাত্র উপায় প্রধান সেবক রাখেননি (কেননা, প্রশ্ন করার অধিকারই দেননি)- তা নিতান্তই সরল। অর্থনীতি এত ভালই যদি, প্রবৃদ্ধি তাহলে কেন ঋণাত্মক? কোভিডের অজুহাত এখানে খাটে না, যেহেতু ২০১৬ সালের নোটবন্দির পর থেকে অর্থনীতির ভাঙা মাজা সোজা হয়নি।

কোভিড শেষ পর্যন্ত মোদির নিয়তি হবে কি না, বলার সময় এখনও আসেনি। এটুকু বলা অসংগত নয়, কোভিড-মোকাবিলায় সরকারের চূড়ান্ত অপদার্থতা তাঁর প্রচারসর্বস্ব মিথ্যাচারিতা ও ঔদ্ধত্যেরই পরিণাম। অর্থনীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে ঠাসবুনট সামাজিক পরম্পরায় বিভাজন ঘটিয়ে ‘হিন্দু ভারত’ প্রতিষ্ঠায় তাঁর প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গিয়েছে। আর্থ-সামাজিক নীতির ব্যর্থতার পাশাপাশি বিদেশ-নীতির ক্ষেত্রেও মোদির উত্থিত ভারত আজ ত্যাজ্য ও ব্রাত্য। স্থল-সীমান্ত চুক্তির পর অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ছাড়া সবচেয়ে বন্ধু প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আত্মিক সম্পর্ক মোদি সরকারের অর্বাচীন নেতৃত্বের অশালীন মন্তব্যের দরুন কোথায় পৌঁছেছে, তার একটা ঝলক দেখা গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ফল প্রকাশের পর। তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ে নয়, বাংলাদেশি জনতা খুশিতে ডগমগ হয়েছে মোদি সরকারের ‘বিভাজন নীতি’-র পরাজয়ে। একটা দেশের সরকারের কাছে এর চেয়ে অপমান ও লজ্জার আর কিছু হতে পারে না।

ব্যর্থতা ধরা পড়ার আশঙ্কায় প্রতিশ্রুতির গোলপোস্ট মোদি বারবার বদলেছেন। তবু জনপ্রিয়তার দক্ষিণমুখী অভিযান অব্যাহত। আমেরিকার ডেটা ইনটেলিজেন্স সংস্থা ‘মর্নিং কনসাল্ট’ ২৭ এপ্রিল জানিয়েছে, মোদির জনপ্রিয়তা এই মুহূর্তে ৩৯ শতাংশ, কোভিডের শুরুতে যা ছিল ৪৬ শতাংশ। দেশি সংস্থা ‘সি-ভোটার’ জানাচ্ছে, মোদির কাজে ‘খুব সন্তুষ্ট’ এখন ৪০ শতাংশ। কোভিডের শুরুতে যা ছিল ৬৪ শতাংশ। ইউটিউব জানাচ্ছে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ‘মন কি বাত’ পছন্দ করেছিলেন ৭৯ হাজার, অপছন্দ ১০ লক্ষ। সর্বশেষ ‘মন কি বাত’ শুনেছেন মাত্র ৫৫ হাজার। পছন্দ করেছেন ১ হাজার, অপছন্দ ৭ হাজার ২০০। সপ্তম বছর পূর্তিতে বিরোধীরা তাঁকে সরাসরি ‘স্বৈরতন্ত্রী’ বলছেন। ‘নৌটঙ্কি’ বন্ধ করে ‘কুম্ভীরাশ্রু’ বিসর্জন না দিয়ে টিকা-সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি পালনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। প্রধান সেবককে তা শুনতে হচ্ছে। অধিকাংশ সেনানীও অদ্ভুত নীরব!

তবু বলা যাবে না, মোদি-জমানার শেষের সেদিন শুরু হয়েছে। কেননা, তিনি নরেন্দ্র মোদি। তাছাড়া লোকসভা ভোটেরও দেরি পাক্কা তিন বছর। যার অভাবে পশ্চিমবঙ্গে তাঁর দলের ভরাডুবি, মুখহীনতার সেই কারণ প্রধান বিবেচিত হলে কে বলতে পারে, জয়ের হ্যাটট্রিক করে ২০২৪ সালে নবনির্মিত ‘মোদি নিবাস’-এ তিনি আসীন হবেন না?

[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: ‘আত্মশাসন’ না মানাটা হবে আত্মহত্যা]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement