প্রণব মুখোপাধ্যায় বলতেন- বিদেশনীতি নিয়ে সর্বদলীয় অভিন্ন ঐকমত্য প্রয়োজন। একই কথা প্রযোজ্য ভারতের সার্বভৌম স্বার্থের জন্য সম্প্রতি মোদির মার্কিন সফরের ক্ষেত্রে। এ ঘটনাকে নেহাত বিরোধী রাজনীতির প্রিজমে দেখা অনুচিত। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
এ সপ্তাহে ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার প্রচ্ছদ নিবন্ধ- কেন আজ আমেরিকার ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ হল ভারত? প্রচ্ছদের কার্টুন হল: ভারতের বাঘকে জড়িয়ে ধরেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। মন্তব্য করা হয়েছে, ভারত পশ্চিমকে যতই অপছন্দ করুক, আমেরিকার কাছে আজ ভারত ‘প্রিয় বন্ধু’।
‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকাটির সদর দপ্তর লন্ডন হলেও আমরা জানি এটি মার্কিন রাষ্ট্রনীতিকেই সমর্থন করে, পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতিও ঘোরতর চিন-বিরোধী। নরেন্দ্র মোদির মার্কিন সফরের দিনগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যাচ্ছে, ‘আঙ্কল স্যাম’ মোদিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। মনে করি, শত চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে ন্যাটোর সদস্য না হওয়া, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের নিন্দা করেও মার্কিন অঙ্গুলিহেলনে দীর্ঘদিনের রুশ-বন্ধুত্বকে ছিন্ন না করার অবস্থান নেওয়া, খুব সহজ কাজ নয়।
আবার এটা ভাবাও মূর্খামি, যদি বলি, আমেরিকা এখন গভীর আর্থিক সংকটে। তিন-তিনটে ব্যাংক বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাইডেনকে সংসদের মুখোমুখি হতে হয়েছে ঋণগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগে। তাই আমাদেরকে ওদের যেমন প্রয়োজন, তেমনই আমাদেরও ওদেরকে প্রয়োজন। আসলে বিশ্ব কূটনীতিতে প্রয়োজন উভমুখিতা, তা কখনওই একমুখী নয়। মোদির মার্কিন সফরের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কয়েকটি কথা তাই বলা প্রয়োজন।
প্রথমত, আমেরিকা জনসমক্ষে ভারতকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছে রাষ্ট্রীয় সফরের মর্যাদা মোদিকে দিয়ে। নেহরুর মতো ‘সোনার চামচ’ মুখে নিয়ে তিনি জন্মাননি। কিন্তু বিশ্বনেতাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। নিজেকে ‘এলিভেট’ করেছেন। বিশ্ব কূটনীতির আদবকায়দা, প্রোটোকল, ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস অনেকটাই রপ্ত করেছেন।
যখন তিনি বাইডেন বা কমলা হ্যারিসের সঙ্গে কথা বলেছেন, তখন পাবলিক পারসেপশনে তাঁকে অনেকটাই ‘কনফিডেন্ট’ বলে মনে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমেরিকার এই সাম্প্রতিকতম ভারতপ্রেমকে শুধু মোদির প্রিজমেই দেখা অবৈজ্ঞানিক ও অকূটনৈতিক বিশ্লেষণ। বুশ থেকে ওবামা, ট্রাম্প থেকে এখনকার বাইডেন- প্রত্যেকেই ভারতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তৃতীয়ত, এই ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পিছনে মস্ত বড় ফ্যাক্টর হল চিন। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ ও পশ্চিম সংবাদমাধ্যমও সে-কথা স্বীকার করছে।
শি জিনপিং আমৃত্যু চিনের প্রেসিডেন্ট থাকবেন। চিনা সংবিধান সংশোধন করে সর্বশেষ পার্টি কংগ্রেসে এ ব্যবস্থাকেই স্থায়ী করা হয়েছে। চিন এখন নয়া সম্প্রসারণবাদের পথে হাঁটছে। ভারত ও অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র সম্পর্কেও চিনের ভূ-কৌশলগত অবস্থান বদলাচ্ছে কই? চিন-রাশিয়া-পাকিস্তান অক্ষ-ও মজবুত। এদিকে চিনের ডোকলাম ভূখণ্ড দখল, হিমালয়ের পাদদেশে চিনা সেনা অনুপ্রবেশ ঘটছে। এখনও সেখান থেকে চিন সেনা প্রত্যাহার করেনি। আবার আমেরিকার তাইওয়ান নীতি থেকে শুরু করে উত্তর কোরিয়া নিয়ে জটিলতা- সে সবও অব্যাহত। চিনের সঙ্গে এখন আমেরিকার প্রযুক্তিগত যুদ্ধ অদূর ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বই কমবে বলে মনে হয় না।
তৃতীয়ত, আমেরিকা ও চিনের আর্থিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতাও অদ্ভুত। চিন শ্রম ও বিনিয়োগ মার্কিন বাজার থেকে প্রত্যাহত করে নিলে আমেরিকা বিপদে পড়বে। আর চিন যদি সত্যি সত্যি তা প্রত্যাহার করে, তবে চিনের অর্থনীতিও ধসে যাবে। এখন বিশ্বের নতুন ঠান্ডা যুদ্ধ আমেরিকা বনাম চিনের। ভারত-চিনের বিবাদ যেমন সত্যি, তেমনই আর্থিক ও বাণিজ্য পারস্পরিক বিনিময়ও প্রাসঙ্গিক। মার্কিন সফরের আগে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোদি বলেছেন, ভারত চিনের সঙ্গেও বিবাদ মেটাতে আগ্রহী। আবার মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবও গেলেন চিনে। আসলে কূটনীতিতে অনেক স্তর আছে। এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ব কূটনীতির স্নায়ুকেন্দ্র ভারত।
মোদি ‘জি২০’-র বস। আবার জুলাই মাসে ‘সাংহাই কো অপারেশন’-এর বৈঠক। সেখানেও এবার ভারত অধিনায়ক। ‘গ্লোবাল সাউথ’ নামে এক নতুন ক্লাব শক্তিশালী হয়ে উঠছে। জানুয়ারি মাসে মোদি দিল্লিতে এ ক্লাবেও বৈঠক ডাকছেন, যাতে ১২৫টি দেশ আমন্ত্রিত। ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকেই গ্লোবাল নর্থ ও গ্লোবাল সাউথ বিভাজন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
উত্তর দুনিয়া ধনী, দক্ষিণ দুনিয়া ছিল গরিব। এখন সেই দক্ষিণ দুনিয়া অনেক এগিয়ে গিয়েছে। এর মধে্য দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু ও আবহাওয়ার সংকট বেশি। এজন্য মোদি এই অঞ্চলে প্রথম বিশ্বের সঙ্গে ক্লাইমেট ফিনান্স নিয়ে লড়ছেন, আবার আমেরিকার মতো প্রথম বিশ্বের বড়কর্তা ভারতকে খাতির করছেন। এর কারণ হল ‘জি৭’-এর অন্য অনেক সদস্য এখন দুর্বল। গুরুত্ব হারাচ্ছে। ফ্রান্সের মতো দেশ বেসুরো গাইছে।
‘ব্রিকস’-এ ফ্রান্স আমন্ত্রিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করছে। ব্রিটেন, জার্মানি, কানাডা, ইতালির চেয়েও আমেরিকার কাছে ভারত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশেষত যখন ইউক্রেন যুদ্ধ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে।
এ অবস্থায় মধ্যস্থতাকারী হিসাবে ভারতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ‘জি৭’-এ সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও ভারতকে সম্প্রতি জাপানে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ডাকা হয়। জি৭ এবং ইউরোপ মোদিকে অনুরোধ করছে, যাতে ভারত রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে কথা বলে। এজন্য মোদি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও জাপানে সম্প্রতি বৈঠক করেছেন।
এই ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে মোদির মার্কিন সফরকে বোঝা প্রয়োজন। ভারতীয় বংশোদ্ভুত বিপুল মার্কিন সমাজ সে-দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা ক্লিন্টন, ওবামা, ট্রাম্প প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই দেখেছি। কিন্তু ভারতেরও প্রয়োজন ষোলো আনার উপর আঠেরো আনা। তাই এই সফরকে নেহাত বিরোধী রাজনীতির প্রিজমে দেখা অনুচিত। প্রণব মুখোপাধ্যায় বলতেন- বিদেশনীতি নিয়ে সব দলের ঐকমত্য প্রয়োজন। অভিন্ন বিদেশনীতি হওয়া দরকার। কেননা, তা দেশের সার্বভৌম নীতি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.