বিরোধীরা কি সত্যিই বুঝবেন, এটিএম-ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ বড় ক্লান্ত৷ ভোগান্তির উপর দুর্ভোগ, কটাক্ষের উপর শ্লেষ, আর কত সহ্য করবে মানুষ! লিখছেন সরোজ দরবার
Advertisement
তুমি গান গাইলে, বিশেষ কিছুই হল না
যা ছিল আগের মতোই রয়ে গেল….
সক্কাল সক্কাল উঠে গ্রেগর সামসা দেখেছিল সে পোকা হয়ে গিয়েছে৷ এই নভেম্বরের গোড়ায় এক সন্ধেয় ভারতবাসীও দেখল তারা বোকা বনে গিয়েছে৷ হাতে টাকা আছে৷ টাকার মূল্য নেই৷ ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট ভরা৷ কিন্তু টাকা তোলার উপায় নেই৷ লক্ষ্মীর ঝাঁপি আছে৷ কিন্তু ঝাঁপিতে লক্ষ্মীর বসত নেই৷ প্রধানমন্ত্রীর এক চালে সব ওলটপালট হয়ে গিয়েছে৷ এবার কী উপায়! মানুষ জানে, বিশেষ কিছুই হবে না৷ যা হওয়ার তাই হবে৷ ভোগান্তি বলো ভোগান্তি, দুর্ভোগ বলো দুর্ভোগ-যা হওয়ার তাই হবে৷ এদিকে বিরোধীরা রে রে করে উঠেছে৷ হাতে হাত রেখে বেঁধে বেঁধে থেকে বিরোধীদের অভূতপূর্ব মানববন্ধন রাজধানীর বুকে৷ কিন্তু কী আশ্চর্য, মানুষের, সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে, সেই বিরোধিতার তাগিদ নেই৷ দিব্যি দলে দলে লাইন দিয়ে টাকা বদলাচ্ছেন, এটিএমে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷
ধরে নেওয়া হচ্ছে, জাতীয়তাবাদের জনপ্রিয় হাওয়ায় মানুষের মন একেবারে তোলপাড়৷ তা হয়তো পুরোপুরি অস্বীকার করা যাবে না৷ হায়দরাবাদের প্রৌঢ় বলছেন, বিরিয়ানি কাল খাব, আগে তো দেশ স্বচ্ছ হোক৷ উলের পোশাকের পাহাড়ি বিক্রেতা বলছেন, আজ অসুবিধা হচ্ছে হোক, আদতে তো আমার ছেলেরই ভাল হবে৷ সন্দেহ নেই জাতীয়তাবাদের মোড়কে সরকারি সিদ্ধান্তের যে বিপণন হয়েছে, তা নজিরবিহীন সাফল্য হয়েছে৷ মানুষ তাই ভাবছেন, সীমান্তে যদি সেনারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা না খেয়ে দেশের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন, আর আমরা কয়েক ঘণ্টা পারব না! তবে মুশকিল হল, মোটে তিন অক্ষরে কিছুতেই ‘মানুষ’কে এঁটে তোলা যায় না৷ এই জাতীয়তাবাদী হাওয়ার বাইরেও তাই বহুসংখ্যক মানুষ থেকে গিয়েছেন৷ তাঁরা ধরেই নিয়েছেন সরকার জালে ঢাকা রাজা৷ তাকে দেখাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না৷ শুধু যা আদেশ দেন তাই পালন করে যেতে হয়৷ অতএব কী হবে আর কী হবে না, তার ভাবনা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে৷ ধরেই নিয়েছেন, এটাই ভবিতব্য৷
এ ভাবনা তো অমূলক নয়৷ প্রত্যাশামতোই বিরোধীরা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় পথে নেমেছেন৷ কিন্তু বিরোধিতায় ফল কী হচ্ছে! বহুদলীয় গণতন্ত্রে স্বার্থের ছোট ছোট কুঠুরিগুলো মোদি মহাশয়ের অজানা নয়৷ বিরোধী জোটের ভিতরে যে বহু ফাঁকফোকর আছে তা তিনি বিলক্ষণ জানেন৷ তাই তাঁর মুখে কুলুপ৷ বিরোধী রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রাহুল গান্ধীর থেকে ধারে-ভারে-অভিজ্ঞতায় কয়েক যোজন এগিয়ে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই৷ নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতার আসরে তিনিই প্রথম অবতীর্ণ হন৷ কিন্তু মাত্র একটা পদক্ষেপেই বুঝে যান, তাঁর নেতৃত্ব বাকিরা মেনে নেবে না৷ অতএব সাময়িক হলেও নিজের জাতীয় বিরোধী নেত্রী হয়ে ওঠার বাসনাটি তুলে রাখেন তিনি৷ প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলকে নিজস্ব পরিসরটুকু ছেড়ে দেন৷ ফলস্বরূপ বহুকাল বাদে বৃহত্তর বিরোধী জোট দেখল দেশ৷ কিন্তু বিরোধিতার অপ্সরা যে মোদির মৌনব্রত ভাঙাতে পারবে না তা অন্তত জানা গেল৷ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি উঠেছিল, বিরোধীদের মুখে একরকম কালি ছিটিয়ে তা নাকচ হয়েছে৷ সংসদে ঝড় উঠেছে৷ তুমুল জনদরদি বক্তৃতায় হাততালি কুড়িয়েছেন বিরোধী সাংসদ৷ মন্ত্রীসভার বৈঠক ডাকলেন প্রধানমন্ত্রী৷ মনে হল, এতদিনে বোধহয় খানিকটা সাফল্য লাভ করলেন বিরোধীরা৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছু হল না৷ নোট বদলের সময়সীমা যে বাড়বে না তা জানিয়ে দেওয়া হল৷ তাহলে বিরোধিতায় লাভ কী হল? এরপর হাতে থাকল মানুষের ভোগান্তি৷ সে তো প্রথম দিন থেকেই ছিল৷ যত দিন যাবে তত তা কেটে যাবে৷ একদিন সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে৷ বিরোধীরা আঞ্চলিক রাজনীতিতে মনোযোগী হয়ে উঠবেন৷ বলবেন, কেন্দ্রকে এত বলা হল কিছুই শুনল না৷ উল্টে শাসকদল বলবে(বলছেও বটে) আঁতে ঘা লেগেছে তাই সবাই একজোট হয়েছে৷ দেখ এত বিরোধিতা সত্ত্বেও দেশকে আমরা স্বচ্ছ করতে পেরেছি৷ কেন্দ্র আর আঞ্চলিক দলগুলির এই শাশুড়ি-বউমাসুলভ দ্বন্দ্বের সম্পর্ক দিব্য চলছে বছরের পর বছর৷ এতেই ঘুরছে নির্বাচনের চাকা৷ এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু হল না৷
মনমোহন সিংয়ের মতো দুঁদে অর্থনীতিবিদ মুখ খুললেন বটে৷ কিন্তু অনেক দেরিতে৷ এই বহুদলীয় রাজনীতির গেরোয় আটকে আর তাঁর নিজের দলের বাধ্যবাধকতার চৌকাঠে হোঁচট খেয়েই প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি নিজে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি৷ কাজেই তাঁর কথা মানুষ মন দিয়ে শুনলেন বটে৷ কিন্তু শেষমেষ উপলব্ধি, এখন আর এসব বলে কী লাভ! নিজের জমানায় এর কিছু করলে কাজের কাজ হত৷ হ্যাঁ, অনেক কিছুই হয়তো বর্তমান শাসকদলের বিরোধিতাতেই সম্ভব হয়নি৷ কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যেভাবে সিকি বাতিলকে ছুঁচো মেরে হাত গন্ধের মতো করে প্রাক্তনদের একহাত নিয়েছেন, তা প্রাক্তনরা করে উঠতে পারেননি৷ ফলে বিরোধিতা হল বটে, যুক্তিনিষ্ঠভাবেই হল, কিন্তু বিজ্ঞাপনটা হল না৷ ফলে বৃহত্তর মানুষের কাছে তা পৌঁছাল কই!
অর্থাৎ তুমি বিরোধিতা করলে, কিন্তু কোথাও বিশেষ কিছুই যেন হল না৷ এদিকে এ পোড়া বঙ্গের মানুষকে শুধু দেখতে হল, এই সেদিন রাহুল-বুদ্ধ বাঁধা পড়লেন এক মালায়৷ ক’দিন পেরতে না পেরতেই রাহুলের হাতে হাত রেখে মানবশৃঙ্খল তৈরি করলেন সুদীপ, ডেরেকরা৷ অথচ এ সবের অনেক আগেই মানুষের ভিতর বহু মানুষ বুঝে গিয়েছিল, যা হওয়ার তাই হবে৷ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রিডম্যান যাকে অর্থনীতিতে ‘শক থেরাপি’ বলেন, তার ছায়া না মাড়িয়েও এই মানুষরা জানেন, এরপর বুঝে ওঠার আগেই প্রশাসন যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিয়ে নেবে৷ ফলে সুদের হার যদি কমে তো কমবে৷ মেনে নিতে হবে যা হচ্ছে তা দেশের ভালর জন্যই হচ্ছে৷ যেমনটি পাহাড়ি মানুষটি ভাবেন, ভোগান্তি পেরলে, তার বাচ্চারই ভাল হবে৷ ছাপোসা দেশবাসীর কাছে এই মেনে নেওয়ার থেকে ভাল উপায় আর কিছু নেই৷ বস্তুত নির্বাচনের সময় থেকেই এই মানুষ জানে, দুই খারাপের মধ্যে কম খারাপটাকেই তারা বেছেছে৷ হ্যাঁ, চমস্কি সাহেব এ ব্যাপারে বিস্তারিত তত্ত্বে ব্যাখ্যা রেখেছেন বটে৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ নিজের অভিজ্ঞতাতেই এসব জানে৷ জানে, এর বাইরে বিকল্প নেই৷ এই মেনে নেওয়ার মানসিকতাতেই শাসকের স্বৈরাচারি হয়ে ওঠার বীজ নাকি লুকিয়ে৷ কিন্তু নাগরিক সমাজের পরিসর অঙ্কুরেই বিনষ্টপ্রায়৷ পরিবর্তে বাজার গরম করছে সোশ্যাল মিডিয়ার বিপ্লব ও প্রতিবাদ৷ সুতরাং মানুষ ধরেই নিয়েছে, ওসবে কান দিয়ে কী লাভ! বরং সে সময়ে ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়ালে হাতে টাকা আসবে৷ ঘণ্টাকয়েক দাঁড়িয়ে পা টাটায় বটে৷ তা ফেরার পথে একটা ওষুধ কিনে নিলেই হল৷ কিন্তু কী জ্বালা, পকেটে দু’হাজারি নোট৷ ওষুধের দোকান আবার তা নিতে নারাজ৷ কী আর করা যাবে! ভোগান্তি যে হবে সে তো জানা কথাই৷
আর এসবের মধ্যেই চলবে বিরোধিতার ক্রমাগত রংবদল৷ কিন্তু সত্যি তাতে কি কিছু হচ্ছে? যদি না হয় তবে এই নাটকীয়তায় কাজ কী? কোনও ভোগান্তির কি বিন্দুমাত্র উপশম হচ্ছে? উল্টে নতুন ভোগান্তি যোগ হয়েছে৷ এ রাজ্যের কথাই ধরা যাক৷ রাহুল-বুদ্ধের গাঁটছড়ায় এই সেদিন যাঁরা কটাক্ষ করেছিলেন, তাঁদের কাছেই আজ সে শ্লেষ ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে৷ বিরোধীরা কি সত্যিই বুঝবেন, এটিএম-ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ বড় ক্লান্ত৷ ভোগান্তির উপর দুর্ভোগ, কটাক্ষের উপর শ্লেষ, আর কত সহ্য করবে মানুষ!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.