অরিঞ্জয় বোস: তর্কাতীত ভাবে, আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী তিনি। শচীন তেন্ডুলকরের পর এমন ঐশ্বরিক প্রতিভার সাক্ষাৎ শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্বই পায়নি। বিরাট কোহলি- এই নাম শুধু একজন ক্রিকেটারের নয়; বরং একটা গোটা প্রজন্মের ক্রিকেটকেই চিহ্নিত করে। সেই কোহলিরও সেঞ্চুরির অশ্বমেধের ঘোড়া যেন হারিয়ে গিয়েছিল কোন অজানা প্রান্তরে। বহু চেষ্টা করেও নিজের ফর্ম, নিজের ক্রিকেটীয় শিল্পীসত্তার ধারেকাছে ফিরতে পারছিলেন না বিরাট। অবশেষে ফিরলেন। রাজার মতোই হল তাঁর প্রত্যাবর্তন। ঊষর মরুতে বৃষ্টির মতোই ফিরল সেঞ্চুরির তৃপ্তি। তবে এর নেপথ্যে থেকে গেল এক হিন্দুগুরুর আশীর্বাদ ও দর্শন। জীবনের খারাপ সময়ে তাঁরই শরণ নিয়েছিলেন কোহলি-দম্পতি। তিনি নিম করোলি বাবা। দেশ-বিদেশের বহু মানুষই তাঁকে ‘মহারাজজি’ নামেই চেনেন।
যখন অফ ফর্মের মরীচিকা বিরাটকে ঘুরিয়ে মারছে, একের পর এক সমালোচনার বাণে রক্তাক্ত হচ্ছেন বিরাট, তখন তাঁর মুখে একটা কথা শুনে চমকে উঠেছিলেন অনেকেই। মুখে সারল্যের হাসি ধরে রেখেই আধুনিক ক্রিকেটের সবথেকে সফল ব্যক্তি বলে চলেছিলেন, ‘দিলে ঈশ্বরই যা দেওয়ার তা দেন। নইলে আর কারও কোনও ক্ষমতা নেই। কেউ কিছু করে উঠতে পারে না।’ এতদিন ধরে যে বিরাটকে আমরা দেখে এসেছি, চিনেছি, যে আগুনে আগ্রাসন তাঁর ইউএসপি, সেই কলার-তোলা উদ্ধত বিরাটের মুখে এমন আধ্যাত্মিক কথা যেন একটু বেমানানই লেগেছিল অনেকের কাছে। কিন্তু সত্যিই কি বেমানান! অন্তত তাঁর জীবনযাত্রার দিকে তাকালে তা মনে হওয়া উচিত নয়। ক্রিকেটার হিসাবে অফ ফর্ম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যেরকম কঠোর অনুশীলনের প্রয়োজন হয়েছিল, তা তো করছিলেনই; পাশাপাশি জীবনচর্যার দিক থেকেও নিজেকে অনেকখানি বদলে ফেলেছিলেন বিরাট। না, তা কেবল ডায়েট কিংবা জিমে সময় কাটানোর পরিবর্তন নয়। বিরাট তাঁর জীবনের অভিমুখ বদলে নিয়েছিলেন ঈশ্বরের প্রতি। আর সে-পথ তাঁকে দেখিয়েছিলেন নিম করোলি বাবার আদর্শ এবং দর্শনই।
কে এই নিম করোলি বাবা? তাঁর পূর্বাশ্রমের নাম লক্ষ্মণ নারায়ণ শর্মা। জন্ম উত্তরপ্রদেশে। ছোট থেকেই রত ঈশ্বর সাধনায়। তবে পরিবারের চাপে তাঁকে সংসার ধর্ম পালন করতে হয়েছিল। বিয়ে হয় প্রায় বালকবেলাতেই। তবে সেই বাঁধনও তাঁকে বেঁধে রাখতে পারেনি। তিনি গৃহত্যাগী হয়েছিলেন। তবে আবার পরিবারের ডাকেই তাঁকে ফিরতে হয়েছিল এবং গার্হস্থ্য জীবন পালন করেছিলেন তিনি। তবে তাঁর মন পড়েছিল প্রভু রামের চরণতলে। ভক্ত হনুমানের মতোই তিনি তাঁর ভজনা করতেন। প্রভু রাম ও হনুমানই ছিলেন তাঁর আরাধ্য। তাঁকে ঘিরে আছে বহু জনশ্রুতি। শোনা যায়, একবার বিনা টিকিটে ভ্রমণ করছিলেন বলে তাঁকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেন টিকিট পরীক্ষক। তিনি নেমে একটি গাছের তলায় বসে পড়েন। এদিকে সবুজ সংকেত পেয়ে ট্রেন ছাড়ে বটে, কিন্তু কিছুতেই এগোতে পারে না।
এই ঘটনায় বাবার দৈব মহিমা ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। সাধুকে যখন আবার ট্রেনে ফিরিয়ে নেওয়া হয়, তখনই নাকি ট্রেনের চাকা গড়াতে শুরু করেছিল। এরকম বহু অলৌকিক কাহিনি ছড়িয়ে আছে তাঁর নামে। ঈশ্বরসাধনা ও শান্তির খোঁজই তাঁর জীবনের একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায়। গোটা দেশে শতাধিক হনুমান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে নৈনিতালে গড়ে তোলেন কাইচি ধাম আশ্রম। বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে নিম করোলি বাবার খ্যাতি। স্টিভ জোবস তাঁর দুঃসময়ে এই আশ্রমে গিয়েই সঠিক পথের সন্ধান পান। একই ভাবে এই ভারতীয় সাধুর আদর্শ পথ দেখিয়েছিল মার্ক জুকারবার্গকেও। হলি-স্টার জুলিয়া রবার্টসও এই আশ্রমে ঘুরে যাওয়ার পরই হিন্দুধর্মসাধনাকে নিজের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে নেন। এঁরা সকলেই জীবনে শান্তি ও সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছিলেন এই নিম করোলি বাবার আদর্শ ও দর্শনের কাছে পৌঁছেই।
দুঃসময়ের আগুনপথে হাঁটতে হাঁটতে একদিন সেই পথ চিনতে পারলেন বিরাট কোহলিও (Virat Kohli)। চলতি বছরের গোড়ার দিকেই বৃন্দাবনে এই সাধুর আশ্রমে গিয়েছিলেন বিরাট-অনুষ্কা। ফেরার পরই কাটে ১০৪৩ দিনের খরা। ৮৭ বলে ১১৩ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলেন বিরাট। এই কিছুদিন আগেই তাঁদের দুজনকে দেখা গিয়েছিল নৈনিতালের আশ্রমে। আর তারপরেই এল জীবনের ৭৫তম সেঞ্চুরি। তা-ও টেস্টে প্রায় সাড়ে তিন বছরে খরা কাটিয়ে। কিছুদিন আগে অনুষ্কা নিজেই তাঁদের এই অধ্যাত্ম-যাত্রা সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করেছিলেন। সন্দেহ নেই, এই হিন্দু গুরুর আশীর্বাদ বিরাটের কেরিয়ার আর জীবনের গতিপথটাও বদলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আধুনিক সময়ে একজন চূড়ান্ত সফল মানুষ যখন আধ্যাত্মিক গুরুর কাছে জীবনের সঠিক পথের সন্ধান পান, তখন তা বিশেষ গুরত্ববাহী হয়ে ওঠে এই প্রজন্মের কাছে। অর্থ, কীর্তি, সচ্ছলতা হয়তো সব নয়। পথিক পথ হারালে, কোনও এক লাইটহাউসের দরকার হয়। আমাদের ধর্মসাধনার সংস্কৃতিতেই তাঁকেই আমরা গুরু বলে মান্য করি। সন্দেহ নেই, বিরাটের এই প্রত্যাবর্তনের জীবনে, সেই অবিস্মরণীয় গুরুর ভূমিকাতেই অধিষ্ঠিত রইলেন নিম করোলি বাবা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.