ড. মনমোহন সিং ১৯৫৬ সালে “অ্যাডাম স্মিথ পুরস্কার”-এ ভূষিত হন। ২০১২ সালে মাল্টি ব্র্যান্ড রিটেলে ৫১ শতাংশ এবং সিঙ্গল ব্র্যান্ড রিটেলে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে অনুমোদন দেন। আজও তার সুফল ভোগ করছে দেশবাসী। লিখছেন শোভিক মুখোপাধ্যায়।
ভারতের অর্থনৈতিক আঙিনায় উদারনীতি তথা অর্থনৈতিক সংস্কারের রূপকার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং প্রয়াত হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার দিল্লি এইমসে ভর্তি করানো হয় গুরুতর অসুস্থ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে। রাতেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রয়াত হন তিনি। টেলিভিশনের পর্দায় খবরটা দেখে মন ভারাক্রান্ত হয়েছিল। একটি যুগের অবসান হল!
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর, প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান, সাউথ কমিশনের সেক্রেটারি জেনেরাল, তারপর দেশের অর্থমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী হলেও একজন অর্থনীতিবিদ হিসাবেই তাঁর পরিচয় আমার কাছে অগ্রগণ্য। তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বিশ্লেষণ করার ধৃষ্টতা আমার নেই। যখন তিনি যে পদেই ছিলেন, অর্থনীতিই ছিল কেন্দ্রবিন্দুতে। অতএব, অর্থনীতিকে ঘিরে ওঁর বিশেষ কিছু সাফল্য আমি আলোচনা করব। উনি ঠিক কত বড় মাপের অর্থনীতিবিদ ছিলেন তা আন্দাজ করি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অথনীতিতে স্নাতক হওয়ার সময়, যখন আমাদের অন্তিম সেমিস্টারে “ইন্ডিয়ান ইকোনমি” বলে একটি পেপার পড়ানো হয়। বুঝতে পারি, অর্থনৈতিক তত্ত্ব যা বইয়ে আমরা পড়ছি, তা এই মানুষটি বহু আগেই ভারতীয় অর্থনীতিকে প্রগতিশীল করতে প্রয়োগ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
অনেকেই জানেন না, ড. মনমোহন সিং ১৯৫৬ সালে “অ্যাডাম স্মিথ পুরস্কার”-এ ভূষিত হন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় স্মিথের অবদানের জন্য ১৮৯১ সাল থেকে “অ্যাডাম স্মিথ পুরস্কার” দেওয়া শুরু করে। এই “অ্যাডাম স্মিথ পুরস্কার” ত্রিবার্ষিকভাবে (তিন বছরে একবার) সেরা সামগ্রিক পরীক্ষার পারফরম্যান্স এবং ‘ইকোনমিকস ট্রাইপসে’ সেরা গবেষণার জন্য দেওয়া হয়। ‘ইকোনমিকস ট্রাইপস’ হল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির পড়ুয়াদের জন্য স্নাতক পরীক্ষা। মনমোহন সিং সম্ভবত ‘অ্যাডাম স্মিথ পুরস্কারে’র একমাত্র প্রাপক যিনি স্মিথের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে অর্থনৈতিক নীতির সূচনা করেছিলেন। এর থেকে ভালো শ্রদ্ধার্ঘ্য আর কী বা হত!
১৯৯১ সালে ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রী হয়ে মাঠে নামলেন । নরসিমা রাও তখন প্রধানমন্ত্রী । ভারতীয় অর্থনীতি ধুঁকছে। জিডিপি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডারে $১.২ বিলিয়ন ছিল এবং জুনের মধ্যে তা অর্ধেক কমে যায়। মাত্র ৩ সপ্তাহের প্রয়োজনীয় আমদানির মতো বৈদেশিক মুদ্রা ছিল সেই সময়। এই পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়াতে উদারনীতি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়াও দেশের বাইরে বিদেশি মুদ্রা নিয়ে যাওয়া বা দেশে বিদেশি মুদ্রা ঢোকার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা, রুপির (INR) অবমূল্যায়ন ও লাইসেন্স রাজের সমাপ্তি ঘটানো– সবই তাঁর হাত ধরে। আর এইসব সাহসী পদক্ষেপেই বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতি হয়ে উঠেছিল ভারত। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ দেশে বেড়ে যায়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে ইনভেস্ট করতে আগ্রহী হন। যে ধারা আজও অব্যাহত। ২০১২ সালে মাল্টি ব্র্যান্ড রিটেলে ৫১ শতাংশ এবং সিঙ্গল ব্র্যান্ড রিটেলে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে অনুমোদন। আজও তার সুফল ভোগ করছে দেশবাসী।
তাঁর আমলেই ভারতে বিদেশি পণ্য় আমদানি অনেক সহজ হয়ে যায়। আমদানি শুল্ক কমানোর জন্যই এই সুবিধা পায় দেশবাসী। যার ফলে ঘরে ঘরে কম দামে বিদেশি পণ্য় ঢুকে যায়। এক ধাক্কায় আমদানি শুল্ক ৩০০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশ করে দেন ড. সিং। রপ্তানি ভর্তুকিও বাতিল করে দেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী। এমনকী বিদেশি সস্তার পণ্য় দেশে ঢোকায় কম দামে নতুন পণ্য় তৈরি করতে শুরু করে দেশীয় কোম্পানিগুলি। তাঁর উদারনীতির কারণে টেলিকম, খুচরো ব্যবসা ও বিমা খাতে বিদেশি কোম্পানিগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি হয় ভারতে। নরসিমহাম কমিটি দ্বারা সুপারিশকৃত মূলধন পর্যাপ্ততার নিয়ম প্রবর্তনের কাণ্ডারী তিনিই।
২০০৫ সালে জাতীয় গ্রামীণ রোজগার গ্যারান্টি আইনের মধ্যে দিয়ে সূচনা হওয়া ১০০ দিনের কাজ প্রকল্প যা আজ গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর নেতৃত্বেই প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ মকুব ও মিড ডে মিলে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার। দেশবাসীকে আয়কর জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেও উৎসাহ দেন। সেই সময় আয়করের ধাপ চার থেকে কমিয়ে তিনে নামিয়ে আনেন তিনি। আয়করে বেশ ছাড় দেওয়া শুরু হয়। ব্যক্তিগত আয়কর ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশে নিয়ে আসেন তিনি। এই ব্যক্তি-আয়করের ক্ষেত্রে সংস্কারগুলি সরকারের জন্য রাজস্ব উৎপাদনে সহায়তা করেছিল। স্পেশ্যাল ইকোনমিক জোন পরিকাঠামো তৈরি করে বিনিয়োগের পথ সুগম করতে ঢালাও বিনিয়োগ করে মনমোহন সরকার। প্রথমবার দেশের আর্থিক বৃদ্ধি দুই সংখ্যা পেরোয়। ২০০৬-০৭ সালেই দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ১০.০৮ শতাংশের মাত্রা ছোঁয় এবং দেশের অর্থনীতি ১ লক্ষ কোটি ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করে। বিশ্বের তাবড় দেশের তালিকায় নাম লেখায় ভারত। শুধু আর্থিক বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করা নয়, দারিদ্র দূরীকরণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয় মনমোহন সরকার। ২০০৪ সালের দেশে দারিদ্রের হার যেখানে ৩৭.২ শতাংশ ছিল। ২০১২ সালে তা এসে দাঁড়ায় ২১.৯ শতাংশে। এছাড়াও, ২০১৩ সালের জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের সূচনা তাঁরই আমলে। এই আইনের আওতায় দেশের দুই তৃতীয়াংশ লোক ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্য় পাওয়া শুরু করে। অপুষ্টির হার এর ফলে অনেকটাই কমে যায়।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল একবার মানুষটির সাক্ষাৎ পাওয়ার। প্রেক্ষাপট ২০১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিকস আয়োজিত একটি সম্মেলন। আরেকজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসুর ৬৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এটি আয়োজন করা হয়েছিল। প্রধান অতিথি হিসাবে ড. মনমোহন সিং সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমার মতো বেশ কয়েকজন উঠতি গবেষককে তিনি সেদিন উৎসাহ দিয়েছিলেন ভালো গবেষণার জন্য। আজ মনে পরে যাচ্ছে সেই দিনটার কথা।
ইতিহাস যথার্থই ড. মনমোহন সিংকে আধুনিক ভারতীয় অর্থনীতির জনক হিসেবে গণ্য করবে এবং দেশের কল্যাণ সাধনার জন্য নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.