কুণাল ঘোষ: আপাতত, এখনও পর্যন্ত, শুধু ফোনেই। তাতেই নিয়ন্ত্রিত দিল্লি দরবারের হাল-হকিকত।
ফোন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কানে। কখনও বাড়ি থেকে, কখনও নবান্নে। ফোনের ওপাশে কখনও দিল্লি থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, কখনও অন্যান্য দলের নেত্রীবৃন্দ। রাজধানী রাজনীতির ওঠা-পড়ার মুহূর্তে যার ভূমিকা, মতামত এবং পরামর্শ কুশীলবদের জরুরি প্রয়োজন, তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার থেকে শুরু, বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্তও সমান সক্রিয়।
সর্বশেষ রিপোর্ট: শরিকদের টেনেটুনে দাবির চাপ হজম করে জোড়াতালির সরকার হয়তো গড়ে দিচ্ছেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি (Narendra Modi), কিন্তু সেই সরকার হতে চলেছে নড়বড়ে। এবং নেপথ্য কাহিনিতে থাকছে এমন কিছু চিত্রনাট্য, যা কমবেশি মাসখানেকের মধ্যে থেকেই নাটকীয় উলটপুরাণের উপাদান সরবরাহ করবে। এমনকী, শপথের আগেই হোঁচটের গল্পও শোনা যাচ্ছে। সাতবারের সাংসদ, চারবারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, দু’বারের রেলমন্ত্রী, তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী, সাতের দশক থেকে রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতিতে থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের(Mamata Banerjee) সঙ্গে সারা ভারতের বিভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীদের পরিচয় এবং যোগাযোগ থাকবে, এটা অতি স্বাভাবিক। আপাতত তারই পুরোদস্তুর প্রভাব চলছে। জাতীয় রাজনীতিতে এখন অনেকটাই অভিভাবকের ভূমিকায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। নতুনরা পরামর্শ নিতেও রীতিমতো ফোন করছেন। যেমন, সরকার পরিচালনার নানা খুঁটিনাটিতে কোনও মতামতের দরকার হলে পাঞ্জাব থেকে আপের মুখ্যমন্ত্রীর ফোন আসে। উত্তরপ্রদেশের অখিলেশ বিশেষ গুরুত্ব দেন মমতার কথায়।
জেলবন্দি হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী কল্পনা (Kalpana Soren) কোনও দরকার হলেই ফোন ঘোরান দিদিকে। এই তালিকা দীর্ঘ। বড় দলের সিনিয়র মোস্ট নেতানেত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য সব শক্তির নেতারা কখনও সরকারি পদক্ষেপের পরামর্শে, কখনও রাজনৈতিক সমীকরণের জন্য মমতার কথার উপর নির্ভর করেন। সিনিয়রদের সঙ্গে দীর্ঘ রাজনীতি করেছেন নেত্রী। আবার জুনিয়র দেখেছেন বেড়ে উঠতে। এমনকী, রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত লড়াই থাকলেও উল্টো মতের দলের অনেকের সঙ্গেও ব্যক্তিগত সম্পর্কে তৃণমূল নেত্রী কিন্তু সৌজন্যের প্রতীক। আপাতত কলকাতায় বসেই নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে সামলাচ্ছেন সব। দিল্লি পাঠিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। যে কোনও বৈঠকের পরেই দুজনের একপ্রস্থ কথাবার্তা হয়ে যাচ্ছে। পরের বৈঠক কার সঙ্গে, দিল্লির পর কোথায়, কার কাছে গিয়ে পরবর্তী ঘুঁটি সাজাতে হবে, সেনাপতিকে পরিচালনা করছেন নেত্রী। সেনাপতিও যোগ্য হস্তে কর্তব্য পালন করে চলেছেন।
ইন্ডিয়ার (INDIA) প্রাথমিক রণকৌশল, মোদিদের সরকার গড়তে দিয়ে পাল্টা চাপ আর ল্যাজেগোবরে করার খেলা, এর পেছনেও মমতার মস্তিষ্ক। এই নড়বড়ে সরকারকে গদিতে বসিয়ে তাকে ভিতর এবং বাইরে থেকে সমানে উত্ত্যক্ত করার রণনীতি তৈরি করছেন তিনি। সবাইকে সবটা বলছেন না। যদি এনডিএ-কে (NDA) শপথ অবধি না পৌঁছতে দেওয়া যায়, তার আগেই কোনও অঘটনের চাল দাবার ছকের জন্ম নেয়, সেই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। দিল্লিতে খেলা হচ্ছে, রিমোট যেন কলকাতার হাতে। বাংলায় বিপুল সাফল্য এবং বর্ধিত সাংসদ সংখ্যা যেন এই দাপট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভোটপ্রচারের সময় নেত্রী প্রতি সভায় বলেছিলেন, ‘‘বিজেপি যতই বলুক না কেন, চারশো পার করবে না। আগে ওরা দুশো পার করে দেখাক। তারপর দফারফা। বিজেপি ধাক্কা খেতে চলেছে। মোদির গ্যারান্টি মানুষ বিশ্বাস করছে না।’’ এখন ভোটের পর সেটাই মিলছে দেখে নেত্রীর আফসোস, কংগ্রেস যদি তাঁর পরামর্শ মেনে অনেক আগে থেকে আসন সমঝোতা করত, বা পরিকল্পিতভাবে রাজ্যে রাজ্যে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের যৌথ কর্মসূচি নিত, তাহলে হয়তো এনডিএকে আরও পেছনে ফেলে সরাসরি সরকার গঠন করতে পারত ‘ইন্ডিয়া’। যাই হোক, এখন যা পরিস্থিতি তার উপর দাঁড়িয়েই পরবর্তী অঙ্ক কষছেন নেত্রী। সূত্রের খবর, ত্রিমুখী লক্ষ্য। এক, সামগ্রিক ‘ইন্ডিয়া’কে এককাট্টা রেখে এনডিএর উপর চাপ তৈরি। দুই, ‘ইন্ডিয়া’র মধ্যে অকংগ্রেসি দলগুলির সমন্বয় বাড়ানো। তিন, আপাতত এনডিএতে থাকলেও উইকেট পড়তে পারে এমন কিছু শক্তির সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিক যোগসূত্র রাখা। দিল্লির বহু উত্থানপতনের সাক্ষী মমতা। নিজেও বহুবার রাজধানীতে ছিলেন মোক্ষম সময়ে। এবারও হয়তো ক’দিন পরে যাবেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ফোনে ফোনে চলছে তাঁর জোট-রসায়ন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোন এক এমন ফোন, যাতে জাতীয় রাজনীতির সবদিকের সব ইনপুট এসে ঢুকছে। ‘ইন্ডিয়া’ কীভাবে সরকার গড়ার আগে থেকেই চাপ দিচ্ছে এনডিএকে, কিংবা এনডিএর ভিতরে কী শরিকি দরাদরি চলছে, সে খবর যেমন আসছে, তেমনি রাজধানীর অলিন্দের শীর্ষমহল থেকে এই খবরও আসছে, বিজেপির অন্দরমহলেও ভয়ংকর চোরাস্রোত। নরেন্দ্র মোদি, বিশেষত অমিত শাহর বিরোধীরা দলের মধ্যে থেকেই কীভাবে চোরাবালি ছড়াচ্ছেন, এর খুঁটিনাটিও স্রোতের মতো চলে আসছে নেত্রীর কাছে। ভাগ্য ভালো তিনি সাংবাদিকতা করেন না। এই মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোনে যা আছে, তা যদি তিনি তাঁর কাগজে লিখে বসতেন, তাহলে অন্য কোনও চ্যানেল বা কাগজ পাল্লা দিতে পারত না। দারুণ মুডে আছেন নেত্রী। এখানকার অন্য সব কাজকর্ম করছেন। আর তার সঙ্গে সক্রিয় থাকছেন ফোনটিতে। কালীঘাটের টালির চালের ঘর আর নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এক তরুণী আজ নানা পাহাড় ভাঙার গান গাওয়ার পর আজ সেই উচ্চতায় নিজেকে তুলে নিয়ে গিয়েছেন, তাঁর সৃষ্টি করা দলকে তুলে এনেছেন, যেখানে দিল্লি দরবারের সরকার গড়ার ভাঙাগড়ার প্রক্রিয়া তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন এখানে কলকাতায় বসে, স্রেফ ফোনে ফোনে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.